প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
উই ওয়ান্ট টু হ্যাভ ফান, টু স্টপ ফায়ারিং ইওর গান!’
সালটা ২০০৫! রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে আঁধার নেমে এসেছে আইভরি কোস্টে। রাজনৈতিক বিবাদে বিভক্ত রাষ্ট্র। দিন রাত বন্দুকের আওয়াজ, বারুদের গন্ধ, রাস্তায় মৃতদেহের সারি। আফ্রিকার অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ যেন শ্মশানে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির অনুরোধ, রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তির বার্তা— কোনও কিছুই কাজে আসেনি। সবাই যখন হাত তুলে নিয়েছে, তখন এক ফুটবলার আইভোরিয়ান জাতিকে এক করেছিলেন। গৃহযুদ্ধ থামিয়ে দেশে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন। তিনি আর কেউ নন— দিদিয়ের দ্রোগবা। ফুটবল ইতিহাসে আইভরি কোস্ট প্রথমবার বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জনের পর ড্রেসিংরুমেই হাঁটু মুড়ে সতীর্থদের সঙ্গে তারকা ফুটবলার গান ধরেছিলেন, ‘আমরা আনন্দে বাঁচতে চাই, তাই তোমার বন্দুক থামাও’। দ্রোগবাদের আবেদনে আইভরি কোস্টের দুই বিবদমান গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভেদাভেদ ভুলে দেশবাসী প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নে উদ্বেল হয়ে রাস্তায় আনন্দ করছিলেন। সত্যিই, ফুটবলই পারে এমন চমৎকার করতে।
টাইমমেশিনে একটু পিছনে ফেরা যাক। ২০০২ সালেই ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ শুরু হয় আইভরি কোস্টে। বিদ্রোহী বাহিনী বলপ্রয়োগ করে দেশের সিংহভাগ অংশ দখল করে নেয়। আর রাজধানী আবিজান সহ তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সরকার ধরে রেখেছিল। এরমধ্যেই ২০০৬ সালে জার্মানি বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব চলছিল। দেশের কঠিন পরিস্থিতিতেও দ্রোগবার আইভরি কোস্ট ভালো পারফরম্যান্স করে আসছিল। তবে শেষ ম্যাচে তাদের ভাগ্য নির্ভর ছিল। অঙ্কটা ছিল, সুদানের বিরুদ্ধে আইভরি কোস্টকে জিততেই হবে। আর অপর ম্যাচে মিশরের বিরুদ্ধে ক্যামেরুনকে ড্র করতে হবে অথবা হারতে হবে। ২০০৫ সালের ৮ অক্টোবরের এই দুই ম্যাচকে ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের আগ্রহ তুঙ্গে ছিল। দ্রোগবারা নির্ধারিত সময়ে সুদানকে ৩-১ ব্যবধানে হারায়। তবে অপর ম্যাচ নাটকীয় মোড় নেয়। শুরুতেই এগিয়ে যায় ক্যামেরুন। তবে ৭৯ মিনিটে সমতায় ফেরে মিশর। তবে উত্তেজনা সেখানেই শেষ হয়নি। সংযোজিত সময়ে ক্যামেরুন পেনাল্টি পেলে পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয়। তবে ফুটবল দেবতা সেদিন দ্রোগবাদের উপর সহায় ছিল। স্পটকিক থেকে নেওয়া পেরি ওমের শট পোস্টে লাগতেই উত্সবে মেতে ওঠেন আইভরি কোস্টের ফুটবলাররা। তবে যে দেশে প্রতি মিনিটে রক্তপাত হচ্ছে, সেখানে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের জয়ের আর কী সেলিব্রেশন হবে! তাই ম্যাচ জেতার পরই ড্রেসিংরুমে এসে মাইক্রোফোন হাতে তুলে নেন দ্রোগবা। সতীর্থদের হাডলের মাঝে দাঁড়িয়ে তিনি বলতে শুরু করেন, ‘মেন অ্যান্ড উইমেন ও কোট ডি ভয়রা। আজ আমরা বিশ্বকাপের টিকিট অর্জন করে প্রমাণ করেছি, আইভরি কোস্ট একসঙ্গে লড়তে পারে, থাকতে পারে। আমরা কথা রেখেছি। যুদ্ধ ভুলে গোটা দেশ এই জয়ের উল্লাসে একত্রিত হোক। আমরা হাঁটু গেড়ে আপনাদের কাছে ভিক্ষা চাইছি (সতীর্থদের নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন দ্রোগবা), শত্রুতা ভুলে বন্দুক তুলে রাখুন। দেশে ভোট হোক। শান্তি ফিরে আসুক।’ এরপরই আনন্দে ফুটবলাররা একসঙ্গে গাইতে শুরু করেন, ‘উই ওয়ান্ট টু হ্যাভ ফান, টু স্টপ ফায়ারিং ইওর গান!’ — এক মিনিট কয়েক সেকেন্ডের এই ভিডিও দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে আইভরি কোস্টে। দেশের ফুটবলারদের ডাকে সাড়া দিয়ে গৃহযুদ্ধ ভুলে বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জনের আনন্দে শামিল হয় দেশবাসী। আসলে দ্রোগবা জানতেন, একমাত্র ফুটবলই পারে শান্তি ফিরিয়ে আনতে। সত্যিই দ্রোগবাদের কাছে সেদিন হার মেনেছিল হিংসা ও রক্তপাত। কিছু সময়ের জন্য হলেও যাবতীয় দুঃখ কষ্ট ভুলে মানুষ আনন্দে মেতে উঠেছিল। দিদিয়ের দ্রোগবা কত বড় ফুটবলার সেটা পুরো বিশ্ব জানে। দেশকে সাফল্য এনে দেওয়ার পাশাপাশি ক্লাব ফুটবলে চেলসির হয়ে আলো ছড়িয়েছেন তিনি। এই স্ট্রাইকারকে কিংবদন্তি বললেও ভুল হবে না। তবে ফুটবলের বাইরেও মানুষের মনে আলাদা করে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তিনি। গৃহযুদ্ধ থামানোর পয়গম্বর দ্রোগবা!