প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
চায়ের কাপ হাতে দীপেশকাকু ঢুকতেই মিলি ধপ করে জানলার পাশে ইজিচেয়ারে বসে পড়ল। ক্লাস এইটে উঠেছে এবার। দিল্লি বোর্ডের একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। কিন্তু ছোট থেকেই বাংলা বই পড়ায় যাকে বলে ওস্তাদ। ওদের আর কাকুর বাড়ির দূরত্ব কয়েক হাতের। তাই দুমদাম করে চলে আসে মিলি।
দীপেশ সেনের এটা শুধু পড়ার ঘরই নয়, লেখারও। লেখক হিসাবে তিনি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন চল্লিশে পৌঁছেই। মিলি ওঁর অনেক গল্পই পড়েছে, বিশেষ করে ছোটদের জন্য যেগুলো লেখা।
ইজিচেয়ারে এলিয়ে মিলি বলল, ‘আজকের খবরের কাগজে তোমার যে গল্পটা বেরিয়েছে, সেটা নিয়ে আমার বাড়িতে খুব আলোচনা হচ্ছে। বাবা এক বন্ধুকে ফোনে বলছিল, তুমি নাকি দারুণ লিখেছ।’
চায়ে চুমুক দিয়ে দীপেশকাকু হাসল, ‘তাহলে তো আমারই বিপদ। ভালো লেখা মানেই তো তোকে আইসক্রিম খাওয়াতে হবে।’
হেসে ফেলল মিলিও, ‘সে তো হবেই। কিন্তু ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছ মানে নিশ্চয়ই কোথাও যাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ। শ্রীরামপুর।’
অবাক হল মিলি। বলল, ‘সে তো আমাদের চন্দননগর শহর থেকে পাঁচটা স্টেশন। ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছ কেন! থাকতে হবে বুঝি?’
‘ওরে বাবা, এটা হুগলির শ্রীরামপুর নয়। পূর্ব-বর্ধমান জেলার। সমুদ্রগড় পর্যন্ত ট্রেনে। তারপর গাড়িতে যাব।’
‘ওহ, তা ওখানে হঠাৎ?’
‘একটা সাহিত্যসভা আছে। গল্পপাঠ আর আলোচনার। আমার অবশ্য অন্য একটা উদ্দেশ্য আছে।’
ভ্রু কুঁচকেছে মিলির। জিজ্ঞাসা করল, ‘কী উদ্দেশ্য?’
‘শ্রীরামপুর একটা আধা গ্রাম, আধা শহর। জায়গাটার একদম প্রান্তে একটা ভাঙা বাড়ি আছে। কেউ যায় না। ভূতুড়ে বাড়ি বলে বদনাম আছে সেটার। সাহিত্যসভা সেরে ওটা একবার রাতের দিকে দেখতে যাবার ইচ্ছে।’
চোখ গোল-গোল হয়ে গেল মিলির। বলল, ‘তার মানে ভূত!’
‘হ্যাঁ, এবার নিশ্চই দেখতে পাব। পুরনো জমিদার বাড়ি ছিল ওটা। যে-গেছে তার সঙ্গে নাকি কিছু না কিছু হয়েছে। এই ভূতুড়ে অভিজ্ঞতাটা আমার খুব দরকার।’
গোল চোখ এবার ছোট মিলির, ‘সে তো তুমি গতবার হাওড়ার উলুবেড়িয়ায় ওই ভাঙা বাড়ি আর বাগানটায় যাবার আগেও বলেছিলে, ওখানে নাকি ভূত দেখতে পাওয়া যাবেই। দেখতে কিন্তু পাওনি।’
দীপেশকাকুর মুখটা একটু দুঃখী দুঃখী হয়ে উঠল। চায়ে পরপর দু-তিনবার চুমুক দিয়ে বলে উঠল, ‘সত্যি, খুব মনে আশা ছিল, দেখতে পাব। কিন্তু মিস হয়ে গেছিল। আর এদিকে দু-তিনটে পত্রিকার জন্য ভূতের গল্পই লিখতে হবে। সত্যিকারের অভিজ্ঞতা থাকলে লেখাগুলো জমে যায়। লিখতে খুব সুবিধা হয়।’
ঠোঁট উল্টে মিলি একটু চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘আচ্ছা কাকু, তুমি তো ভূতের এত গল্প না লিখে চোর-ডাকাতের গল্পও লিখতে পার?’
ভ্রু কুঁচকে গেল দীপেশকাকুর, ‘ভূতের গল্প তো লিখতেই হয়। তোরা এত পড়তে ভালোবাসিস। কিন্তু চোর-ডাকাতের মানে?’
‘তোমার ভূতের গল্প আমি অনেকগুলোই পড়েছি। ভালো লেগেছে। আর ‘চোর- ডাকাত’ মানে আমি বলছি ডিটেকটিভ গল্প। গোয়েন্দা গল্প।’
‘সে তো এখন অনেকই লেখা হচ্ছে। আসলে আমি বরাবর কেমন জানিস তো?’
আগ্রহ তৈরি হচ্ছে মিলির। দীপেশকাকু সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। বাড়িতেও শুনেছে। কাকু নাকি ছাত্র হিসাবে দারুণ ছিল। উঁচু পজিশনে চাকরিও করত। স্রেফ বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালেখি করবে বলে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। বাবা-মা থাকে কাকুর দাদার সঙ্গে কলকাতায়। দেখেছে বেশ কয়েকবার। এই বাড়িটায় অনেক বই। মিলির মতো আরও কয়েকজন সময় পেলেই কাকুর কাছে দৌড়ে চলে আসে ওঁর কথা শুনতে। খুব স্পষ্ট কথা বলেন, নানা বিষয়ে প্রচুর জ্ঞান। সোজা হল মিলি, ‘কেমন?’
‘খুব ডাকাবুকো টাইপের। সেটা অবশ্য আমি ছাত্র যখন ছিলাম, তখন থেকেই। চোর-ডাকাত-গোয়েন্দা গল্প লিখতে গেলে আমার গল্পের চরিত্ররাও সব ওরকম মারকুটে হয়ে যাবে। বাংলা গল্পের ঘরানাটা ওরকম নয় রে।’
দীপেশকাকুর কথায় যেন গল্পের গন্ধ। মিলি দু-হাতের তালুর উপর নিজের চিবুক রাখল। বলল, ‘ডাকাবুকো আর মারকুটে মানে তো খুব সাহসী। তুমি কি নিজে কখনও চোর -ডাকাত ধরেছ?’
দু’দিকে ঘাড় নাড়ল হালকা করে দীপেশকাকু, ‘না, ওইভাবে ধরিনি বড় কোনও চোর-ডাকাত। কিন্তু স্কুল থেকেই আমার ছিল খুব সাহস। গায়ে জোরও ছিল খুব। অন্যায় দেখলেই একদম ঝাঁপিয়ে পড়তাম।’
চায়ের কাপ শেষ করে নামিয়ে রেখে কাকু এবার খবরের কাগজ দেখতে শুরু করেছে। মিলিকেও নাচের স্কুলে যেতে হবে। উঠে পড়ল ও। জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার কবে যাওয়া কাকু?’
‘এই তো, কালকেই।’
কোথাও গেলে কাকু অবশ্য নিয়ম করেই ফোন করে। আর বাবার সঙ্গে নয়, আগে কথা বলতে হবে মিলির সঙ্গেই।
‘তুমি কিন্তু বাড়িটায় কী দেখলে, আগে জানাবে। আর গল্পটা লিখলে আগে শোনাতে হবে।’
‘সে তো শোনাতেই হবে। কিন্তু এখন তুই বাড়ি যা। জলখাবার খেয়ে নে।’
....
আজ সারাদিন স্কুল করলেও মিলির মন পড়েছিল বর্ধমানের শ্রীরামপুরে। বিকেলে বাড়ি ফিরে মায়ের থেকে ফোনটা নিয়ে একটা ফোন করে ফেলল। তিন-চারবার রিং হবার পর ধরল কাকু। বাবা-মায়ের নম্বর কাকুর ফোনে সেভ করা আছে। ধরে বলল, ‘যা দেখছি, নিজের কৌতূহলকে চেপে রাখতে পারছিস না।’
ফোনের এপ্রান্তে খিলখিল করে হেসে উঠল মিলি, ‘সে তো পারছিই না। তুমি নিশ্চই পৌঁছে গেছ ওখানে।’
কাকু বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, ‘হ্যাঁ, দুপুরের মধ্যেই। খুব আদরযত্ন করছেন এঁরা। সুন্দর একটা হোটেলে রেখেছেন। এখন তৈরি হচ্ছি। অনুষ্ঠান-হলটা হোটেলের পাশেই। তৈরি হয়ে চলে যাব।’
‘তাহলে ওই ভূতুড়ে বাড়িটায় কখন যাবে?’
‘আমি তো ভাবছিলাম একটু রাত করেই যাব। কিন্তু তাড়াতাড়িই ঘুরে চলে আসতে হবে। একটু প্রবলেম আছে।’
‘প্রবলেম! বাড়িটায় যেতে পারবে তো?’
‘সে পারব। কিন্তু অনুষ্ঠানের পর এঁদের সব গোছগাছ করতে হবে বলে এঁরা সঙ্গে যেতে পারবেন না। আমাকে একাই যেতে হবে আর নিজে ব্যবস্থা করে।’
মিলির কাছে ব্যাপারটা আরও থ্রিলিং লাগছে। পুরো জমে যাবে। বলল,‘আসলে এরা নিজেরাই চাইছে না, তুমি যাও। আর না হলে, নিজেরাই খুব ভয় পায় জায়গাটা।’
‘দ্বিতীয়টার সম্ভাবনাই বেশি মনে হচ্ছে। কারণ বাড়িটাকে ঘিরে অনেকেরই নাকি ভৌতিক বা আনন্যাচারাল অভিজ্ঞতা আছে। আসলে সমস্যা সেটাও না।’
চুপ করে থাকল মিলি। কাকু নিজেই বলবে নিশ্চই।
‘আসলে, জায়গাটা যেখানে আছি, সেখান থেকে অনেকটা দূরে। যানবাহন একদমই যেতে চায় না। আর ওদিকটা নাকি মানুষের বাস নেই। ফলে একদম ফাঁকা। নিজে ব্যবস্থা মানে অচেনা জায়গায়, সমস্যা হবে। ও তুই ভাবিস না, কিছু একটা করে ফেলব ঠিকই।’
দীপেশকাকু ফোন ছেড়ে দিল। মিলি সত্যিই এটা নিয়ে ভাবছে না। বাড়িটায় গিয়ে কী অভিজ্ঞতা কাকুর হয়, সেটাই শুধু মনে আসছে। তাড়াতাড়ি আজ পড়তে বসে গেল। কাকুর কথা শুনতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। পড়াশোনা আগেভাগে শেষ করে নেওয়াই ঠিক।
রাতের খাওয়া সেরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মিলি দেখল দশটা বেজে গিয়েছে। আর ধৈর্য থাকল না। বাবার থেকে মোবাইলটা চেয়ে নিয়ে কাকুকে ফোনটা করতে যাবে, সেই সময় মোবাইলটা বেজে উঠল। কাকুই ফোন করল। ‘জাস্ট তোমাকে করব ভাবছি, আর তুমিই করলে।’ আসল কথায় যেতে চাইল মিলি, ‘গেসলে ওখানে?’
‘হ্যাঁ। ফিরে গেছি। হোটেলের সামনে।’
‘কিছু দেখতে পেলে?’
দীপেশকাকুর দীর্ঘশ্বাস শুনল মিলি।
‘না রে। এবারও হতাশ হলাম।’
‘জায়গাটা কেমন?’
‘বেশ ভূতুড়ে। রীতিমতো গা ছমছমে। আমি অন্তত দশ মিনিট দাঁড়িয়েছিলাম। অন্য জায়গার থেকে ফিলটা বেশি হচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্য কিছু চোখে পড়েনি।’
‘যাঃ’, হতাশ হচ্ছিল মিলি, ‘তাহলে তো প্লট পেলে না। ভূতের গল্প লিখবে কী করে! তোমাকে তো গল্প জমা দিতে হবে।’
‘সে বোধহয় আর হল না। ওই... তোর কথাই মেনে নিতে হচ্ছে, আর কী।’
‘কী?’
‘কী আবার, পারলে এবার চোর-ডাকাতের গল্প লিখব। ডিটেকটিভ চরিত্র হবে গল্পের। খারাপ হবে?’
‘একেবারেই না।’
কী আর করে মিলি। কাল স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের কাছে কতরকম ভূতের গল্প করবে ভেবেছিল! সব মাটি হয়ে গেল।
ঘুমোতে চলে গেল ও।
....
সকালে ঘুম থেকে মিলি নিজেই ওঠে। আজ মা যেভাবে ওকে ঝাঁকিয়ে ‘উঠে পড়ো। একটা খারাপ খবর আছে।’ বলে তুলে দিয়ে গেল বেশ অবাক হয়ে গেল। বাড়ির পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়, বুঝতে পারল।
ব্রাশ করে টয়লেট সেরে কিচেনে মায়ের কাছে বসে খারাপ ঘটনাটার প্রায় সবটাই জেনে ফেলেছে মিলি। প্রচণ্ড মনখারাপ ছাপিয়ে মনের অবাক হওয়া ভাবটা কিছুতেই যাচ্ছে না।
আজ ভোর পাঁচটা নাগাদ বর্ধমানের শ্রীরামপুর থানা থেকে মায়ের কাছেই প্রথম ফোনটা আসে। ভূতুড়ে বাড়িতে বা তার কাছে নয়, দীপেশকাকু খুন হয়েছেন অন্তত সে জায়গার চার কিলোমিটার আগে। শ্রীরামপুর শহরে আজকাল চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি খুব বেড়ে গেছিল। সন্ধের পরে সাহিত্যের অনুষ্ঠান শেষ করে যানবাহন না পেয়ে কাকু সম্ভবত কোনও অচেনা বাইকচালককে ওই জায়গায় পৌঁছে দেবার জন্য রাজি করিয়ে নিয়েছিলেন। রওনাও হয়েছিলেন। সে সম্ভবত ওই বাড়িতে নিয়েও যায় কাকুকে। ফেরার পথে খুব নির্জন জায়গায় দাঁড় করিয়ে পিস্তল দেখিয়ে ওঁর হাতের আংটি, গলার চেন, মোবাইল ডাকাতি করার চেষ্টা করলে কাকু বাধা দেন। আর সে ওঁর মাথা লক্ষ্য করে গুলি করে। ঘটনাস্থলেই কাকু মারা যান। আশপাশের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ দেখে পুলিসের সিদ্ধান্ত, ঘটনাটা রাত সওয়া আটটা নাগাদ ঘটে থাকতে পারে। মিলির বাবা কাকুর দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। পাড়ার কয়েকজনও চলে এসেছেন। সবাই মিলে দীপেশকাকুকে হয়তো ওখান থেকে আনতে যাবে।
খুব কষ্ট হচ্ছে মিলির। কিন্তু ভয়ঙ্করভাবে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে। দীপেশকাকু কি আসলে নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন যে, আসলে ভূত আছে? না হলে রাত দশটায় কে ফোন করল ওকে! অত কথা.... অত সুন্দরভাবে বলল!
কী মনে হতে বাবার ফোনটা চেয়ে ভালো করে কললিস্ট পরীক্ষা করল মিলি।
বুক কেঁপে উঠল। কারণ সেখানে অন্য সব নম্বরের রেকর্ড থাকলেও দীপেশকাকুর কাল রাতে আসা ফোন নম্বরের কোনও অস্তিত্ব নেই!