উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যম ফল আশা করা যায়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে নতুনত্ব আছে। কর্মরতদের ... বিশদ
‘থানা থেকে আসছি’ ছবির সিঁড়ি থেকে নামার ওই দৃশ্যটার কথা স্মরণ করলেই ছায়া দেবীর অভিনয়ের ব্যক্তিত্বের ছাপ মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন ছায়া দেবী। সামনে সাব-ইন্সপেক্টর তিনকড়ি হালদারের বেশে উত্তমকুমার। অসময়ে বাড়িতে পুলিস দেখে বিরক্ত গৃহকর্ত্রী। কোনওরকমে সৌজন্যমূলক নমস্কার জানিয়ে ছায়া দেবী বলেন, ‘এ বিষয়ে কিছু করার আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।’ এবার মাকে নিরস্ত করতে এগিয়ে আসেন তাঁর মেয়ে অঞ্জনা ভৌমিক। তিনকড়ির আসা ইস্তক বাড়ির কী কী পরিস্থিতি হয়েছে, তা মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ছায়া দেবী অনড়। উত্তমকুমারকে একবার আপাদমস্তক দেখে সেই বিরক্তিমাখা মুখেই বলে উঠলেন, ‘এরমধ্যেই আপনি দেখছি আমার মেয়ের মনে বেশ ছাপ রেখে গিয়েছেন।’ মহানায়কও দমবার পাত্র নন। তাঁর সটান জবাব, ‘ওটা বয়সের ধর্ম মিসেস সেন।’ প্যাঁচে পড়েও সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে ছায়া দেবী বললেন, ‘বুঝেছি, অনেক রাত হয়েছে। এবার আপনি আসুন।’ এবার তাঁর গলা অনেক শান্ত, শীতল। একটা কথাতেই তিনি যেমন এই জেরা পর্ব মিটিয়ে নেওয়ার উপক্রম করলেন আবার তেমনই ভদ্রভাবে অনাহূত অতিথির যে এখানে আর থাকা সমীচীন নয়, সেটাও বুঝিয়ে দিলেন।
পর্দায় রাগী এবং স্নেহপরায়ণ মায়ের চরিত্রে যেমন দেখা গিয়েছে ছায়া দেবীকে, তেমনই আবার অত্যাচারিণী ছায়া দেবীকে দর্শক দেখেছেন সলিল সেনের ‘হার মানা হার’ ছবিতে। এখানে নিজের আখের গোছানো কুচক্রী জেঠিমা তিনি। সুচিত্রাকে ভিন্ন করে দিয়ে ভাসুরঝির সব সম্পত্তি আত্মসাৎ করে নেন। ভাসুরঝির ভালোবাসার মানুষটিকেও ভুল বুঝিয়ে নিজের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে কার্যসিদ্ধি করেন। শেষে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হন ছায়া দেবী। সে আবার এক অন্য মাপের অভিনয়। সিনেমায় এরকম নানা চরিত্রে অভিনয় করলেও বাস্তব জীবনে দুষ্টুমিষ্টি স্বভাব আর খামখেয়ালিতে ভরা ছিলেন তিনি। এরকমই একটি মজার ঘটনা। এক পরিচালক শ্যুটিংয়ে প্রায়ই ছায়া দেবীকে ডিসটার্ব করতেন। তিনি ওই পরিচালক মশাইকে নানাভাবে বুঝিয়েও নিরস্ত করতে পারছিলেন না। এদিকে ছবির শ্যুটিংও তখন অনেকটা গড়িয়ে গিয়েছে। ছবি যে ছেড়ে দেবেন সেই উপায়ও নেই। তবে ছায়া দেবীর উপস্থিত বুদ্ধি ছিল মারাত্মক। একদিন শ্যুটিং প্যাক আপের পরে ফ্লোরে বসে তিনি কিছু একটা করছিলেন। এইসময় সেখানে সেই পরিচালক ভদ্রলোক হঠাৎ এসে উদয় হলেন। শুনশান ফ্লোরে হঠাৎ পরিচালকের গলার আওয়াজ পেয়ে প্রথমে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলেন তিনি। শ্যুটিংয়ের প্রয়োজনে অনেক আসবাবপত্র ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। ক্ষণিকের মধ্যেই তাঁর মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। একটা বড়সড় টেবিলের তলায় গিয়ে লুকিয়ে পড়লেন তিনি। বেচারা পরিচালক এদিক ওদিক অনেক খোঁজাখুঁজি করে ছায়া দেবীকে দেখতে না পেয়ে একটা সময় হাল ছেড়ে দিলেন। এরপর ওই পরিচালকের হাত থেকে বাঁচার জন্য মাঝেমাঝেই টেবিলের তলায় লুকিয়ে থেকে বই পড়তেন ছায়া দেবী। এসব ঘটনার কথা পরবর্তীকালে ঘনিষ্ঠমহলে নিজেই বলতেন আর হেসে কুটিপাটি হতেন।
মহানায়ক উত্তমকুমারের মতো সুচিত্রা সেনের সঙ্গেও ছায়া দেবীর দারুণ সম্পর্ক ছিল। এক অর্থে সুচিত্রা ছিলেন তাঁর বেস্ট ফ্রেন্ড। এতটাই বন্ধুত্ব ছিল যে মিসেস সেনকে নিজের দেওয়া নামে ডাকতেন তিনি। আর সে নাম সুচিত্রা সেন ছাড়া হাতে গোনা গুটিকয়েক পরিচিত জানতেন। ইন্ডাস্ট্রিতে সুচিত্রার মেক আপ ভ্যান শেয়ার করার অনুমতি একমাত্র ছিল ছায়া দেবীর। মিসেস সেন মাপা ডায়েটে থাকতেন। সেই অনুসারে খাবার আসত। ছায়া দেবীকে সেই খাবার সুচিত্রা অফার করলে সে খাবার মুখেও তুলতেন না। মুখ বেঁকিয়ে সটান বলে দিতেন, ‘ও সব ছাইপাশ আমার পেটে সইবে না।’ আসলে গ্ল্যামারসর্বস্ব দুনিয়ায় জীবিকা নির্বাহ করলেও তা ধরে রাখা নিয়ে কখনও মাথাব্যথা ছিল না তাঁর। তার একটা কারণ হয়তো পরবর্তীকালে চরিত্রাভিনয়ে সরে গিয়েছিলেন বলে। তবুও অনেক শিল্পী এ সম্বন্ধে সচেতন থাকেন। ছায়া দেবী তার ধার ধারতেন না। উল্টে বলতেন, ‘অত যদি গ্ল্যামার নিয়েই ভাবব, তাহলে অভিনয় করা কেন বাপু? সাবানের বিজ্ঞাপন করলেই তো হয়।’
নীহাররঞ্জন গুপ্তর কলমে ‘উত্তর ফাল্গুনী।’ উত্তমকুমারের প্রযোজনায় এই ছবির পরিচালনা করেছিলেন অসিত সেন। সেই ছবিতে দেবযানী জীবনের দুর্বিপাকে পড়ে হয়ে উঠেছিল পান্নাবাঈ। কিন্তু কন্যা সুপর্ণার গায়ে কলঙ্কের আঁচ সে লাগতে দেয়নি। মেয়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক সে ছিন্ন করেছিল, যাতে প্রেমিক মণীশের স্নেহের পরশে সুপর্ণা সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে। জীবনের আকাশে উত্তর ফাল্গুনী নক্ষত্রের মতোই জ্বলজ্বল করতে পারে। এহেন দেবযানীকে আত্মহত্যার কবল থেকে উদ্ধার করে জীবনের আলো দেখিয়েছিল যে বাঈজি, সেই চরিত্রে ছায়া দেবীর দাপুটে অভিনয় আজও বাংলা ছবির গুণগ্রাহী দর্শকদের চোখে লেগে রয়েছে। নাচ-গানের তালিম দিয়ে ‘দেবযানী’ সুচিত্রাকে ছায়া দেবীই করে তোলেন পান্নাবাঈ। আত্মহত্যার পথে পা বাড়ানো মনোবল হারানো এক মহিলাকে জীবনের স্রোতে ফিরিয়ে আনেন। ‘উত্তর ফাল্গুনী’র হিন্দি ভার্সন ‘মমতা’তেও নিখুঁত হিন্দি-উর্দু উচ্চারণে ছায়া দেবী সাবলীল।
‘উত্তর ফাল্গুনী’ ছবির একটি দৃশ্যে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ছায়া দেবী।