উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যম ফল আশা করা যায়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে নতুনত্ব আছে। কর্মরতদের ... বিশদ
অসিত সেন যে সময় ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ছবিটি তৈরি করেছিলেন সেই সময় বাংলা ছবিতে আলাদা করে কোনও কোরিওগ্রাফার থাকত না। বাইজির চরিত্র, কিন্তু সেই নাচের মুদ্রা শেখাবেন কে! সুচিত্রা যখন এসব ভাবছেন তখন সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলেন স্বয়ং পরিচালক মশাই। অসিতবাবুই সুচিত্রাকে পরামর্শ দেন,‘আপনাকে বাইজি নাচ একমাত্র ছায়াদিই শেখাতে পারেন। ওঁকেই ধরুন।’ বাকিটা ইতিহাস। ছবিতে পান্নাবাইয়ের নাচগুলো সুচিত্রাকে তুলিয়েছিলেন খোদ ছায়া দেবী।
উত্তরের হেদুয়া থেকে বন্ধু সুচিত্রার টানে দক্ষিণে মাঝে মাঝেই ছুটে যেতেন ছায়া দেবী। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প ছায়া দেবী ঘনিষ্ঠ অনেকেরই জানা। মহানায়িকার বাড়িতে এসেছেন পরিচালক অজয় কর। তাঁর পরিচালনায় ‘সপ্তপদী’, ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিতে কাজ করেছেন ছায়া দেবী। নতুন ছবির জন্য শাড়ি বাছা হচ্ছে। খুব সম্ভবত ‘দত্তা’ ছবির জন্য সুচিত্রার কাছে এসেছিলেন অজয়বাবু। ছায়া দেবী সেদিন সেখানে উপস্থিত। আলোচনা, কাজ সব শেষ করে অজয় কর যখন চলে যাচ্ছেন, তখন হঠাৎ ছায়া দেবী ওঁর হাত থেকে একটা শাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে বললেন,‘আপনার ছবি করার সময় আমার একটা শাড়ি খোয়া গিয়েছিল। পরে দেবেন বলেছিলেন, তা আর পাইনি। আজ তাই নিয়ে নিলাম।’ বলেই সোজা হাঁটা দিলেন। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন পরিচালক।
আসলে ছায়া দেবী যা মনে করতেন তা করেই ছাড়তেন। সে বাড়িতেই হোক বা ফ্লোরে। আর তাতে পরিচালকরাও বেকায়দায় পড়তেন। অজয় করেরই একটি ছবি। ছায়া দেবীকে শট বোঝানোর সময় পরিচালক বললেন, ‘ছায়াদি, আপনি কাশী থেকে ফিরছেন, বিধবার চরিত্র। আপনার কিন্তু কোনও মেকআপ থাকবে না। ছায়া দেবী চুপ। কথাটা একদমই তাঁর পছন্দ হল না। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। মনে মনে ঠিক করে নিলেন, যা করার তাঁকেই করতে হবে। শট রেডি হতেই যথাসময় সেটে এসে উপস্থিত হলেন। কিন্তু তাঁকে দেখে অজয় কর তো অবাক। জিজ্ঞসা করলেন—‘এ কী ! আপনি কাজল পরেছেন! কেন?’ উত্তর যেন তৈরিই ছিল ছায়া দেবীর। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘কাজল? সে তো পরেছি সাতদিন আগে।’ বলেই পরিচালককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মেকআপ শিল্পীর উদ্দেশে হাঁক পাড়লেন—‘অ্যাই মেকআপ, এদিকে এসো। ক্রিম দিয়ে কাজল তুলে দাও।’
কাজল তুলতে গিয়ে তো মেকআপ ম্যানের অবস্থা কাহিল। তিনি ক্রমাগত ক্রিম দিয়ে ঘষেই চলেছেন, কিন্তু কাজল আর ওঠে না। উঠবে কী করে? ছায়া দেবী তো আর কাজল লাগাননি, লাগিয়েছেন সুরমা। সে আর কী অত সহজে ওঠে!
ছায়া দেবী মাঝে মাঝে একটু অন্যমনস্ক থাকতেন। তবে অভিনয়ের সময় কখনওই তেমন হতো না। তখন তিনি অন্য মানুষ। ‘দেয়া নেয়া’, ‘কাঁচ কাটা হিরে’, ‘মুখুজ্যে পরিবার’ সহ বেশ কয়েকটি ছবিতে ছায়া দেবীর সঙ্গে অভিনয় করেছেন লিলি চক্রবর্তী। ‘মুখুজ্যে পরিবার’ ছবিতে লিলির জেঠিমার চরিত্রে ছিলেন তিনি। ‘কাঁচ কাটা হিরে’ ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মায়ের চরিত্রে ছিলেন ছায়া দেবী। লিলি চক্রবর্তীর কথায়, ‘কাঁচ কাটা হিরে-তে আমার সঙ্গে বেশ কিছু দৃশ্য একসঙ্গে ছিল। ওঁর সঙ্গে অভিনয় করে বেশ মজা পেতাম। দেয়া নেয়া ছবিতে উত্তমদার মা হয়েছিলেন। নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন উত্তমকুমারকে।’ তবে ছবিতে সাধারণত যেমন বদমেজাজি চরিত্রে দেখা যেত ছায়া দেবীকে, বাস্তবে একেবারেই সেরকম ছিলেন না। ‘ফ্লোরে মেজাজ দেখাতেন না ঠিকই তবে একটু উল্টোপাল্টা হলে রেগে যেতেন। ফলে সকলেই তাঁকে সমীহ করত,’ বলছিলেন লিলি। সহশিল্পীদের সঙ্গে গল্প-টল্প বিশেষ করতেন না। মেকআপ রুমে বেশিরভাগ সময় চুপচাপই থাকতেন। মুডি বলে সকলে একটু ভয়ও করত। তবে একবার গল্প শুরু করলে অনেক কথাই বলতেন। টুকটাক মজাও চলত।
একটা মজার ঘটনার কথা শোনা যাক এই বর্ষীয়ান অভিনেত্রীর জবানিতে। লিলি বলে চললেন— ‘আমরা দু’জনেই উত্তর কলকাতার মেয়ে। আমি তখন বাগবাজারে থাকতাম, আর ছায়াদি থাকতেন সিমলা স্ট্রিটে। একদিন ছায়াদি আর আমি দুটো আলাদা ট্যাক্সিতে চেপে যাচ্ছি টালিগঞ্জ স্টুডিওপাড়ায়। কী ছবির শ্যুটিংয়ে সেটা আর মনে নেই। উনি আগে আগে, আর আমি পিছনে। একটা সময় দু’জনের ট্যাক্সি পাশাপাশি চলে আসতে দেখি পাশের ট্যাক্সিতে ছায়াদি। আমি ওঁকে দেখতে পেয়েই হাত নাড়লাম। ওমা, ছায়াদি আমাকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। ভাবলাম কী হল? ভুল দেখলাম। তাহলে কি উনি ছায়া দেবী নন? এসব ভাবতে ভাবতেই দেখি ট্যাক্সিটা এগিয়ে চলে গিয়েছে। আবার একটা সিগন্যালে গিয়ে ট্যাক্সি দুটো পাশাপাশি এল। সেই এক কেস। এবারও দেখলাম ছায়াদি জানলা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। নাহ, ভুল তো নয়। এ ছায়াদিই। হাত নাড়লাম। যথারীতি এক কাণ্ড! হাত নাড়তেই ছায়াদি আবার অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। উনি কি তবে কোনও কারণে আমার ওপর রাগ করলেন। এসব ভাবতে ভাবতে টালিগঞ্জ পৌঁছলাম। যখন গাড়ি থেকে নামছি, ততক্ষণে ছায়াদি পৌঁছে গিয়েছেন। আমাকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কী রে কেমন আছিস? আমি তখন অভিমান করে বললাম, যাও তোমার সঙ্গে কথা বলব না। উনি পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন, কেন? বললাম, তোমাকে হাত নাড়লাম, তুমি চিনতেই পারলে না। ছায়াদি নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, ‘ওহ! আমি বুঝতে পারিনি রে। ’ এরপর আমার আর কিছু বলার থাকতে পারে?
(ক্রমশ)
অনুপকুমারের সঙ্গে ছায়া দেবী। ছবি: সৌজন্যে গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়