উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যম ফল আশা করা যায়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে নতুনত্ব আছে। কর্মরতদের ... বিশদ
তপন সিংহ সম্পর্কে ছায়া দেবী বলতেন, ‘চলনে বলনে ডিরেক্টরদের কত না কেতা। কিন্তু তপনবাবু ইন্ডোর-আউটডোর যেখানেই যান না কেন, একেবারেই সিম্পল। অকারণে ওঁকে কোনওদিন জাহির করতে দেখিনি।’ ছায়া দেবী নিজেও ওরকম ছিলেন। অত বড় মাপের একজন অভিনেত্রী, কিন্তু কখনও কোনও কো-আর্টিস্ট তাঁর বিরুদ্ধে খারাপ আচরণের অভিযোগ করেননি। এই কথাই বলছিলেন লিলি চক্রবর্তী। বলছিলেন, ‘ওঁকে ভয় পেতাম খুব। মুডি বলে কখন কী বলে দেবেন তাই নিয়ে তটস্থ থাকত সকলে। কাছাকাছি যাওয়ার সাহস পেতাম না। সকলে সমীহ করে চলত। তাই আমিও দূরে দূরেই থাকতাম। কিন্তু দূরে থাকলেও আমাদের মতো জুনিয়রদের উনি খুবই স্নেহ করতেন। ফ্লোরে মেজাজ দেখাতেন না। কখনও কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে দেখিনি।’
তপন সিংহর ‘হাটেবাজারে’ ছবির সেটেই শ্যুটিংয়ের অবসরে একদিন অশোককুমারের সঙ্গে কী একটা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে জোর তর্ক বেঁধেছিল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ছায়া দেবী তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অশোককুমার একটু আড়ালে যেতেই ভানুকে ডেকে তিনি দাঁত কিড়মিড় করে বলেছিলেন, ‘কেন ওর সঙ্গে তর্ক করিস! জানিস না ওরা সব পাগলের ঝাড়বংশ।’ এই ‘হাটেবাজারে’ ছবিতেই শমিত ভঞ্জর সঙ্গে প্রথম আলাপ ছায়া দেবীর। নবীন শমিতকে কোনওদিন আপনি ভিন্ন সম্বোধন করেননি। ‘আপনজন’ করার সময় দু’জনের সম্পর্ক আরও সহজ হয়ে ওঠে। শিল্পীদের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকলে কাজের ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়ে বইকি। ‘আপনজন’ ছবির সেই দৃশ্য নিশ্চয়ই মনে আছে দর্শকদের। স্বরূপ দত্ত আর শমিত ভঞ্জের মধ্যে লড়াই বেঁধেছে। ছায়া দেবী ছুটে যাচ্ছেন আর শাড়ির আঁচল সরে সরে যাচ্ছে... পরিচালক কিন্তু কোনও নির্দেশ দেননি যে, এই সিক্যুয়েন্সে কী করতে হবে! খুব সচেতনভাবেই করা। এ সব অভিব্যক্তি অভিনেতাকে ঠিক নির্দেশ দিয়ে করানো যায় না। যার আসে, তার এমনিতেই আসে।
‘আপনজন’ ছবিতে ছায়া দেবীর অসামান্য অভিনয়ের কথা উঠে এল তাঁর সহশিল্পী নায়ক বিশ্বজিতের কথাতেও। বিশ্বজিতের সঙ্গে ‘কুহেলি’, ‘মণিহার’, ‘করুণাময়ী’সহ বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ছায়া দেবী। বিশ্বজিৎ বলছিলেন, ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ মায়ের চরিত্র, শাশুড়ির চরিত্রেই উনি বেশি অভিনয় করতেন। আর চরিত্রগুলো যেন ওঁকে ভেবেই তৈরি হতো। আর ব্যক্তিজীবনেও ভীষণ রাশভারী ছিলেন বলে চরিত্রগুলোতে অসম্ভব মানাত ছায়া দেবীকে। দর্শক এভাবেই ওঁকে দেখে অভ্যস্ত। এমনকী আমরা যাঁরা ওঁর সহশিল্পী ছিলাম তারাও পর্দায় দেখলে ভাবতাম ছায়াদি তো এমনই।’
অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ‘করুণাময়ী’ ছবিতে বিশ্বজিতের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ছায়া দেবী। ‘খুব ডমিনেটিং মাদার। ওঁর অনুমতি ছাড়া ওখানে আমি কিছু করতে পারতাম না,’ বিশ্বজিতের স্মৃতিতে সেই ছবির ঘটনা এখনও উজ্জ্বল। তবে অভিনয়ের সময় ছাড়া বিশ্বজিতের সঙ্গে তাঁর খুব একটা কথাবার্তা হতো না। ‘বম্বে এলে উনি হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে আসতেন। আমিও যেতাম। সেখানে ছায়া দেবীর সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। তখন কলকাতার ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে নানা কথাবার্তা হতো। এমনিতে তিনি কমই কথা বলতেন। উনি নিজে একটা দূরত্ব বজায় রাখতেন। কাজ ছাড়া খুব একটা মেলামেশা করতেন না। হয়তো অভিনয় নিয়ে ভাবতেন বা যে চরিত্রটা করতেন তাই নিয়েই মনোনিবেশ করতেন। কিন্তু কারও সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করতে দেখিনি। একটা গাম্ভীর্য বজায় রেখে চলতেন। চট করে গিয়ে কথা বলতে কেউ সাহস পেত না। কিন্তু মানুষ হিসেবে খুব ভালো ছিলেন। কেউ কথা বললে খুব সুন্দর করে কথা বলতেন। অসম্ভব পাওয়ারফুল অ্যাকট্রেস। বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে গিয়েছেন। ওঁর অভিনয় নিয়ে আমি আর কী বলব! আমার ফেভারিট আপনজন ছবিতে ওঁর অভিনয়’, বললেন বিশ্বজিৎ।
ছায়া দেবী মানেই ছিল কপাল জুড়ে থাকা খয়েরি বা লাল রঙের বড় টিপ। মেহেন্দি করা লাল চুলের খোঁপা। নাক থেকে ঠিকরে পরা নাকছাবির ঝলক আর হাতে বাহারি বটুয়া। তাঁর এই সাজগোজ নিয়েই একটা মজার স্মৃতি এখনও টাটকা লিলি চক্রবর্তীর মনে। গল্পটা এরকম। লিলি চক্রবর্তীকে একবার একটা ফাংশনে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। মিষ্টু ঘোষের ছেলে বিশ্বনাথ ঘোষ ছায়া দেবীর কাছাকাছি থাকতেন। ওদের একটা অনুষ্ঠান ছিল অনেক দূরে। লিলি বলছিলেন,‘ছায়াদি আমাকে বলেছিলেন, তোকে নিয়ে যাব। আমিও রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। বাড়িতে এসে গাড়ি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। উনি তো সাজতে খুব ভালোবাসতেন। কপালে বড় টিপ, ঝকঝকে শাড়ি। আমার আবার কোনওদিনই ঝকমকে সাজ পছন্দ ছিল না। সাধারণভাবেই থাকতাম। সেরকম সাধারণ একটা শাড়ি পরেই রেডি হয়ে বসেছিলাম। আমাকে দেখেই, ছায়াদি বিরক্ত— টিপ পরিসনি কেন? তারপর নিজেই ব্যাগ থেকে বের করে একটা বড় টিপ পরিয়ে দিয়েছিলেন। আমার তো অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু ওঁকে কিছু বলতে পারিনি। একে ওই মেজাজ। তারপর আবার ভালোবেসে আমাকে সাজিয়ে দিয়েছেন।’ সোজা কথা স্পষ্ট করে সকলের সামনে বলে দিতে পারতেন ছায়া দেবী। কোনও রাখঢাক ছিল না। ওই ফাংশনের শেষেই তিনি ফাংশন অর্গানাইজারদের সটান প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ওঁকে কিছু দিলে না।’ লিলি চক্রবর্তীর ফাংশনে যাওয়ার অভ্যাস ছিল না। উনি লজ্জা পেয়ে ছায়া দেবীকে বলেন, ‘চুপ করো, কী আবার দেবে?’ ছায়া দেবী তখন পাল্টা বলেন, ‘সে কী! ফাংশনে এসেছিস। তোকে তো কিছু দেওয়া উচিত।’
(ক্রমশ)
অলঙ্করণ: চন্দন পাল
‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবির একটি দৃশ্যে রবি ঘোষের সঙ্গে ছায়া দেবী।