উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যম ফল আশা করা যায়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে নতুনত্ব আছে। কর্মরতদের ... বিশদ
পর্ব- ৪৩
‘আহা, ছল করে জল আনতে আমি যমুনাতে যাই
যমুনাতে যাই গো আমি, যাই গো যমুনায়।’
ছবির নাম ‘হারমোনিয়াম’, গায়িকা ছায়া দেবী। পরিচালনায় তপন সিংহ। এই গানের কথাও তপনবাবুরই লেখা। অভিনয় জগৎ থেকে সরে গেলেও কেবলমাত্র একজন পরিচালকের ডাকেই কখনও সাড়া না দিয়ে পারেননি ছায়া দেবী— তিনি তপন সিংহ। ইন্ডাস্ট্রির লোকজন বা নিজের ছবি এসব নিয়ে খোশগল্প করার বান্দা ছিলেন না ছায়া দেবী। বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতেও আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু তপন সিংহ সম্পর্কে অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ঘনিষ্ঠ মহলে গল্প করতে করতে বলতেন, ‘তপনবাবু আমার দেখা একমাত্র পরিচালক, যাঁর গা দিয়ে জ্যোতি কোনওদিন বেরতে দেখিনি। অথচ অভিনেতাদের গড়েপিটে নিতে ওঁর মতো আর কেউ পারতেন না।’ শুধু ছায়া দেবী নন, সেই সময়ের অনেক শিল্পীই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতেন ‘তাঁদের অভিনয় জীবনে তপন সিংহই শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।’ তাই তপনবাবুর ‘হারমোনিয়ামে’ গান গাওয়ার জন্য নতুন করে তালিম নিয়েছিলেন ছায়া দেবী। আসলে গান গাইতে ভালোবাসলেও কেউ বললেই যে তিনি গান গাইতেন, তা নয়। ছবিতে শমিত ভঞ্জ এসেছেন বারবনিতাদের মক্ষীরানি সুধার খাসমহলে। ৫৪ বছরের ছায়া দেবীর গলায় অক্লেশে খেলে যাওয়া খেমটা গানের দুরূহ কলি হাঁ করে শুনছেন শমিত। যেমন ঠমক, তেমনই মানানসই শরীরী বিভঙ্গ। শ্যুটিং শেষ হতেই অভিনন্দন আর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিল ইউনিট। তখনই সকলে একমত হয়েছিলেন যে, সিনেমার একটা ইতিহাস রচনা হল আজ। স্মৃতিচারণায় এই গল্প বলে গিয়েছেন শমিত ভঞ্জ।
‘হারমোনিয়াম’-এ ছায়া দেবীর স্বকণ্ঠে গান ও মুজরো নাচ, ‘গল্প হলেও সত্যি’র মুখরা বড় বউ, ‘আপনজন’ ছবির আনন্দময়ী ঠাকুমা বা ‘নির্জন সৈকতে’ ছবির পুরী ভ্রমণের বিধবা। ছায়া দেবীকে অসাধারণ সব চরিত্র দিয়েছিলেন তপন সিংহ। আবার তাঁর স্ত্রী অরুন্ধতী দেবীর ‘পদীপিসির বর্মীবাক্স’ ছবিতেও নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ছায়া দেবী। রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুবসমাজের অবক্ষয় ও চরম বেকারত্বকে সামনে রেখে ১৯৬৮ সালে তপন সিংহ ‘আপনজন’ ছবিটি তৈরি করেন। একাকিত্বের যন্ত্রণা নিয়ে ইন্দ্র মিত্রের একটা লেখা থেকে এই ছবির গল্পের আইডিয়া পেয়েছিলেন তিনি। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর শহরে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। হলে শুধু ভিড় বেড়েছিল তেমন নয়, পাড়ার চায়ের দোকানেও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল ‘আপনজন’।
এই ছবির শুরু এক গ্রাম্য বৃদ্ধা আনন্দময়ীর দিনলিপি দিয়ে। তাঁকে কেন্দ্র করেই ছবি। স্বামী, সন্তান, পরিজনহীন অবস্থায় দূর পল্লিগ্রামে অসহায়ভাবেই দিন কাটছিল তাঁর। একার জীবন থেকে বাঁচতে হঠাৎই আপনজন বলে আসা অচেনা মন্টুর সাদর আমন্ত্রণে কলকাতা রওনা হন তিনি। অনন্দময়ীকে মন্টু নিজের পরিচয় দিয়েছিল ভাগ্নে বলে। কলকাতায় থাকলে তিনি খুব ভালো থাকবেন, খাতির যত্নে থাকবেন এই বলেই ছল করে আনন্দময়ীকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিল মন্টু। বাস্তবে মন্টু আর তার বউ দুজনেই চাকরি করত। বাড়িতে ছেলে সামলানোর বিশ্বাসী লোক দরকার। তাই আনন্দময়ীকে নিয়ে আসা। আপনজন বললে পয়সাকড়ি দেওয়ারও প্রশ্ন নেই।
পরের ঘটনা বাংলা ছবির দর্শকের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে। কে বা কারা আনন্দময়ীর আপনজন হয়ে উঠলেন, সেই গল্প। আসলে যেই সময়টায় ‘আপনজন’ ছবির জন্ম, সেই সময় রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চরম অস্থিরতা। খাদ্যসংকটের আগুন তখনও পুরোপুরি নেভেনি। আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তফ্রন্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে সংঘাতও নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। বিশৃঙ্খলা আর বেকারত্ব হাত ধরাধরি করে চলছে। এর মধ্যে আপনজনের মতো ছবি করা মোটেই সহজ ছিল না। যদিও বাহবা শুধু তপন সিংহর একার প্রাপ্য নয়। ছবিতে সকলেই দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন। ‘আনন্দময়ী’ চরিত্রে আগাগোড়া ছায়া দেবী যে কী অসামান্য অভিনয় করেছিলেন, ভাবাই যায় না। কখনও বর্তমান পরিস্থিতির অস্বাভাবিকতায় বিমর্ষ। কখনও আবার তিনি অতীত চিন্তায় মগ্ন। এই স্নেহ-কোমলতায় পরিপূর্ণ এক রূপ তো আবার কখনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠছেন! এক মানুষের একাধিক রূপ ছায়া দেবী এই ছবিতে পর্দায় যেভাবে এঁকেছেন তার তুলনা বাংলা ছবিতে খুব বেশি নেই। এই জন্যই তপন সিংহর বড় ভরসা ছিলেন ছায়া দেবী। আবার এই ছায়া দেবীই ‘আপনজন’-এ স্বরূপ দত্ত, শমিত ভঞ্জ চরিত্রদুটিকে প্রায়শই গুলিয়ে ফেলতেন। ছবির সেটে কে যে রবি, আর কে যে ছেনো— বারবার ভুলে যেতেন। কিছুতেই মনে রাখতে পারতেন না। তাঁর এই ভীষণ নাম গুলিয়ে ফেলার মজার স্বভাবের সাক্ষী অনেকেই। ছায়া দেবীর খুব বড় ভক্ত ছিলেন স্বরূপ দত্ত। বলতেন, ‘অভিনয়ের সময় ছায়াদি এমন সব পোজ দিতেন, যা সচরাচর দেখা যেত না।’
ক্যামেরাটা খুব ভালো বুঝতেন। তাই তপন সিংহের অধিকাংশ ছবিতে ছায়া দেবীই ছিলেন তুরুপের তাস। অভিনেত্রী হিসেবে তাঁকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন এই পরিচালকও। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেওছেন, ‘ছায়াদি বাংলা ছবির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। অনেকটা জায়গা জুড়ে তিনি অভিনয় করতে পারতেন। যেমন বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, তেমনই কণ্ঠে মড্যুলেশন। ঠিক মঞ্চাভিনেত্রীর মতো। অথচ তিনি জীবনে কখনও মঞ্চে অভিনয় করেননি। ভারতে তাঁর মানের সম্পূর্ণ শিল্পী কস্মিনকালেও আসেনি। আন্তর্জাতিক স্তরে বড় জোর দু-একজন তাঁর সামনে দাঁড়াতে পারবেন হয়তো।’
(ক্রমশ)
অলঙ্করণ: চন্দন পাল
‘হারমোনিয়াম’ ছবির একটি গানের দৃশ্যে ছায়া দেবী।