বিদ্যায় সাফল্যও হতাশা দুই বর্তমান। নতুন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কর্মপ্রার্থীদের শুভ যোগ আছে। কর্মক্ষেত্রের ... বিশদ
....
রোজের মতো সকালবেলা দুজনে মুখোমুখি বসে আছেন। সরলা স্নান
সেরে আসবে তারপর ভারতী চা বানাবেন। সরলা চা খেয়ে বাজার যাবে। সুমন ভাবছিলেন, নিজে আজ বাজার যাবেন। মাঝে মাঝেই যে বাজার বা দোকান যাওয়ার বায়না করেন না, তাও নয়। তবে ভারতী যেতে দেন না। সরলা আসার আগেই সুমন একবার বলেছিলেন, ‘আজ আমি বাজার যাই?’
—না।
—সরলা তো সঙ্গে থাকবে।
—অসুবিধা হলে সরলা সামলাতে পারবে না।
—অসুবিধা কিছু হবে না।
—বাজার যাওয়ার বায়না না করে লিস্ট বানাও, সরলা আসলেই পাঠিয়ে দেব।
সুমন কোনও কথা বলে না।
....
বিধাননগরের এই বাড়িটায় তখন ওরা সবে এসেছে। দোতালা বাড়িতে উপরে তিনটে নীচে তিনটে ঘর। বাড়ি করার সময়ে একটা শর্ত হয়েছিল, মিতালি আর অপু উপরে থাকবে, নীচে সুমন আর ভারতী। উপরে কোনও রান্নাঘর হবে না। সেই জায়গায় একটা স্টাডিরুম হবে। স্টাডি এমন জায়গায় করতে হবে যাতে আলো হাওয়া খেলে। সেই মতোই বাড়ি তৈরি করেছিল সুমন। ওদের হিসেব ছিল না, ওই বছর ওদের বিয়ের তিরিশ বছর। হঠাৎ দুপুরে খেতে বসে বউমা আবিষ্কার করে, কাল বিবাহবার্ষিকী। পরের দিন রবিবার পড়েছিল। ফলে শনিবার থেকেই অপু আর মিতালি হই হই শুরু করছিল। কী কী হবে, কাকে কাকে ডাকতে হবে।
সন্ধেবেলা চা-জলখাবার খেয়ে ওরা দু’জনে গিয়েছিল, কেক অর্ডার দেবে আর কী কী সব আনবে। ওরা না ফিরলে দুজন কিছু করতেও পারছেন না। দুজনে বেরল বাজার করতে। কত কী বাজার করল কে জানে। তিরিশ বছরের বিবাহবার্ষিকীতে কী কী লাগে তাও তো সুমন-ভারতী জানেন না। ডোডোকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন। রাতে থানা থেকে ফোনটা এসেছিল। মনে হয়েছিল এত জোরে বোধহয় ফোনটা কোনও দিন বাজেনি। তখনও মোবাইল যুগ শুরু হয়নি। সুমনই দৌড়ে গিয়ে ফোনটা ধরেছিল। ওপার থেকে শুধু জিজ্ঞাসা করেছিল, স্কুটারটা কি ভেস্পা এলএমএল? নম্বরটা মিলিয়ে হ্যাঁ বা না বলবেন। সুমন হ্যাঁ বলার সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনটা উল্টোদিকের লোকটা রেখে দেয়। আবার অপেক্ষা...
থানা থেকে কেন ফোন করল? আর তো কিছু বলল না। থানা থেকে ফোন আসায় দুজনেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। প্রতিবেশী এবং নিকট আত্মীয়দের খবরও দেওয়া হয়েছিল। রাত পোহাতেই অনেকে এসে গিয়েছিল। সারারাত সুমন-ভারতী অনিশ্চিত সন্দেহ যেন ভুল হয়, এই প্রার্থনা করে গেলেন।
সকালে অনেকেই নানা কথা জিজ্ঞাসা করছিল। ভারতীর কিছু ভালো লাগছিল না। ভেস্পা এলএমএল স্কুটারটা ছাড়া ওরা এল— নিথর, নিঃস্পন্দ। সবাই বলাবলি করছিল, সিএ আইল্যান্ডের কাছে ঘটনাটা ঘটেছে। এত কাছে বাবু আর বউমা রাস্তায় পড়েছিল, যদি একবার কেউ জানাত। সুমন ভাবছিলেন বিবাহবার্ষিকীর কোনও অনুষ্ঠান সে তো করে না, কোনওদিনই করেনি। তাহলে কেন বাধা দিল না? বউমা হঠাৎ মেতে উঠল। তারপর বাবুকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
ডোডো তখন সবে দুই পূর্ণ করেছে।
....
লোকের কথায় উত্তর না দিয়ে সুমন আর ভারতী মনে মনে বলে, আমাদের বয়স বাড়বে কী করে? আমরা সাতান্ন বছর আর চুয়ান্ন বছরে নতুন সন্তান পেয়েছি। আমাদের তো বয়স ধরে রাখতেই হবে। মনই বোধ হয় ওদের বয়সটাকে ধরে রেখেছে।
সবকিছু একপাশে সরিয়ে রেখে ওরা ডোডোকে বড় করে তুলেছে। ডোডো সুমনকে ডাকে বুবু আর ভারতীকে ভা। ও এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় বউ নিয়ে আছে। ওদের একটা ছেলে হয়েছে। তার নাম অর্জুন। আজ চার বছর ডোডো বিদেশে।
....
আগে রোজ সন্ধ্যায় স্কাইপে কথা হতো। গত ডিসেম্বরে এসে দুটো স্মার্ট ফোন দিয়ে গিয়েছে। এখন ভিডিও কল হয়। রোজ কথা বলতে হয়। কী রান্না হয়েছে দেখাতে হয়। বাড়িঘর ঘুরে ঘুরে দেখাতে হয়। এমনকী সরলার সঙ্গেও কথা বলে অনেক কিছু জানতে চায়। বুবু আর ভা কেমন আছে? ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করছে কিনা। জামা-কাপড় পরিষ্কার পরছে কিনা। কিছু অপছন্দ হলে সরলা বকাও খায়। সরলা ফোন ধরলেই বলে, ‘ব্যালকনিতে যাও।’ ওদের সামনে কিছু সরলাকে বলে না। প্রতি বছর নববর্ষ, পুজো আর জন্মদিনে উপহার আসে।
ডোডোর বউ অপা কথায় কথায় জানতে চেয়েছিল, তোমাদের কবে বিয়ে হয়েছিল? ভারতী তারিখটা বলতে চাননি। আবার বিয়ের দিন? অপা বার বার জিজ্ঞাসা করেছে, ‘এরকম করছ কেন? তারিখটা বলতে অসুবিধা কী?’
—একটা শর্ত আছে।
—বলো।
—ওই তারিখে কোনও অনুষ্ঠান করা যাবে না।
অপা কথা দেওয়ায় তারিখটা বলে ফেলেছিল। সেই থেকে বিবাহবার্ষিকীতে শুধু উপহার নয় স্পেশাল মেনু করতে হয় শুধু বুড়োবুড়ির জন্য।
....
সুমন-ভারতী জেনে গিয়েছেন আমাদের বিকেল হলে ওদের সকাল হয়। তখন ওরা কথা বলবে। যেদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরে ডোডো বলল, আমাকে ক্যালিফোর্নিয়া বদলি করতে চাইছে। অফিস থেকে এই চিঠিটা ধরিয়ে দিয়েছে। বসকে বলেছি, আমি চলে গেলে দাদু-ঠাকুমা একা হয়ে যাবে। আমি বোধ হয় পারব না।
উনি বললেন, তোমার তো উন্নতি হচ্ছে। দু-চার বছর পর ফিরে আসবে।
‘এরপর আমি আর কিছু বলিনি। বসের সামনে আর কিছু বলাও যায় না।’
....
সুমন চিঠিটা দু’বার পড়ল। ডোডোর জীবনে উন্নতির এটা একটা বড় সুযোগ। সব সময়ে আসে না। ডোডো বিদেশ যাবে। ঠাকুমার মুখে শোনা একটা গল্প মনে পড়ল সুমনের। এই গল্পটা সুরবালা দেবী প্রায়ই করতেন। বলতেন, ‘তোর বাবা যেবার জগন্নাথ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হল, সে বছরেই কলকাতা পুরসভার চাকরিটা পায়। তোর বাবাকে বার বার বলেছিলাম, কলকাতায় যাস না। সেখানে পরী ঘোরে, জিন ঘোরে, তোকে পাল্টে দেবে। তোর বাপ- ঠাকুরদা লেখাপড়া শিখে দেশে জীবন কাটাল, তুই কেন কলকাতা যাবি?’ বাবা নাকি বলেছিলেন, ‘কলকাতা না গেলে উন্নতি হবে না।’ প্রায় জোর করেই এসেছিলেন। আসার সময়ে সুরবালা বলেছিলেন, ‘কলকাতায় মেয়েদের চোখের দিকে তাকাবি না। এক নিমেষেই ভেড়া বানিয়ে দেবে।’ বাবা কথাটা শুনে হেসেছিলেন। সুরবালা তো কলকাতা দেখেননি। তিনিও দেশভাগের পর ভারতে এসেছিলেন। এদেশ তাঁর ভালো লাগেনি। এ শহরে প্রাণ নেই, প্রকৃতি নেই। মানুষ শুধু খায় আর ঘুমায়। প্রায়ই বলতেন ,‘আমি দেশে ফিরে যাব।’
....
সুমনের হাতে চিঠি, চোখ দুটো জলে ভিজে গিয়েছে। চিঠি দিয়ে মুখটা ঢেকে রেখেছেন, যাতে অন্য দুজন দেখতে না পায়। ডোডো চলে যাবে। ক্যালিফোর্নিয়ায় জিন বা পরী আছে কিনা সুমন জানেন না। তবে ডোডো চলে গেলে বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যাবে। ডোডোকে ছাড়া ভারতী বাঁচতে পারবে? ডোডোও কি থাকতে পারবে ভা'কে ছাড়া? কিংবা সুমন নিজেও?
চিঠিটা পড়ে ভারতী হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন। একবারের জন্যেও সম্মতি দেননি। বার বার বলেছেন, তোকে চাকরি করতে বিদেশ যেতে হবে না। আমাদের যা আছে, তোর দিব্য চলে যাবে। তুই কোথাও যাবি না। আমার কাছে থাকবি। আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারব না।
....
পরদিন অফিস থেকে অপরাজিতাকে নিয়ে ফিরল। অপরাজিতা এ বাড়িতে অনেক এসেছে। ওরা এক ক্লাসে পড়ত। ওকে অপা বলেই সবাই ডাকে। অপা ঢুকেই বুঝতে পেরেছে দাদু-ঠাকুমা দুজনে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। অপেক্ষা করছেন, ডোডো কী সিদ্ধান্ত নেয়। সরলা টেবিলে চা-জলখাবার দিয়েছে। সুমন ডোডোর মুখোমুখি বসেছেন, সাধারণত পাশাপাশি বসেন। চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, তুমি কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছ? বা অফিস তোমার কথা শুনে কিছু বলেছে?
ডোডো বলল, ‘আমি ভাবলাম, আমি চলে গেলে তোমরা একা হয়ে যাচ্ছ। তোমাদের বয়সে সেটা খুবই কষ্টকর। আচ্ছা, যদি এই চারবছর অপা তোমাদের কাছে থাকে?’
কোন অধিকারে ও আমাদের কাছে থাকবে?
সুমন আরও কিছু বলতে চাইছিলেন, ভারতী হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিলেন। দুজনের দিকে ভালো করে তাকালেন, ‘তাহলে বিয়েটা করেই বিদেশ যাও।’
হয়তো ওরা দুজনেও এই বাক্যটাই শুনতে চাইছিল, তাই মাথা নিচু করে খেতে থাকল।
....
অর্থাৎ ডোডো বিদেশ যাচ্ছে।
সুমন অমলেটের একটা কোণা মুখে দিয়ে বললেন, এত ঝাল দিস কেন। জানিস তো আমি ঝাল খেতে পারি না। নিয়ে যা এসব। আমাকে বরং ঘরে এক কাপ চা দে। ওদের বললেন, তোমরা খাও, আমি একটু ঘরে যাই।
....
সরলা বাজার থেকে তিনরকম মাছ এনেছে। সুন্দর গার্নিশ করে বিকেলের প্লেটগুলো সাজিয়ে রেখেছে। ছবি দেখাতে হবে তো! আজ এগারোই আগস্ট, আজও রবিবার। সরলা সুন্দর করে সব কিছু সাজিয়েছে। ফুলদানিতে ফুল। একবার প্লাস্টিকের ফুল দেখে ডোডো রেগে গিয়েছিল। এসব সরলা খুব মনে রাখে। এমনকী সুমন আর ভারতীকেও সাজিয়ে বসিয়ে রেখেছে।
....
বিয়ের পনেরো দিনের দিন ডোডো বিদেশ যায়। ও বার বার বলেছিল, অপা চারবছর তোমাদের কাছেই থাকুক। দেখবে দেখতে দেখতে সময়টা কেটে যাবে। ভারতী রাজি হননি। বলেছিলেন, ‘তুমি ওকে সঙ্গে নিয়েই যাও।’
—কেন?
—নতুন বউ কেন এখানে থাকবে?
—তোমাদের দেখবে!
—না। ও তোমার সঙ্গে যাবে।
—তুমি আমার উপর রাগ করেছ!
ভারতী হেসে ফেলেন, ‘রাগ দুঃখের কিছু নেই ভাই। নতুন বউ বরের কাছে থাকবে না তো আমার কাছে থাকবে? এটা হয়? সমাজ ভালো চোখে নেবে না।’
—ঠিক আছে আমি ছ’মাস পরে নিযে যাব। তার আগে তো নিয়ে যেতে পারব না।
ভারতী অপার পিঠে হাত রেখেছিলেন। বাক্যটা শুনে অপার শুধু মুখ উজ্জ্বল হয়নি, শরীরের ভিতরেও তরঙ্গের উদ্ভব হয়েছে, এটা বুঝতে পেরেছেন।
ভারতীয় সময় ঠিক ছ’টায় দুটো ফোনই বেজে উঠল, হ্যাপি এনিভার্সারি, প্রণাম নিও।
এরপরের কাজটা সরলার। ফোন হাতে নিয়ে আগুপিছু হয়ে আপাদমস্তক পোশাক-আশাক দেখানো হল। তারপর যার যার ফোন তাঁর হাতে দেওয়া হল। প্রথমে অপা ভা-এর সঙ্গে আর ডোডো সুমনের সঙ্গে কথা বলল। তারপর ওরা ফোন পাল্টে নিল। ডোডো আর ভা, অন্য ফোনে সুমন আর অপা কথা বলল। তার মধ্যে ওদের আটমাসের ছেলেকেও দেখা হল। ফোন আবার সরলার হাতে গেল। রান্নাগুলো দেখাতে হবে যে। অপা অনেক রেসিপিও জেনে নিল।
....
দ্বিতীয়বার ফোন আসবে রাত আটটায়, ডোডোর কথা অনুযায়ী ওই সময়ে দু’জনকে পাশাপাশি খেতে বসতে হবে। সরলা দু’হাতে দুটো ফোন ধরে রাখবে। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার থেকে ওরা দেখবে সুমন আর ভারতী খাচ্ছেন। বিষয়টা ভেবে দু’জনেই খুব আনন্দ পান।
খেতে খেতে সুমনের মনে পড়ল, ডোডোর তো চার বছর হয়ে যাওয়ার কথা সামনের মাসে। তাহলে তো ডোডো ফিরে আসবে। কথাটা একদম মনে ছিল না।
....
খাওয়া শেষ হলে ডোডো বলল, ‘বুবু, একটা সারপ্রাইজ আছে।’
—কী?
—হোয়াটস্অ্যাপ করেছি।
—বিষয়টা কী?
আজ অফিস একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়েছে। তোমাকে ছবি পাঠিয়েছি। আমাকে আরও ছ’বছর থাকতে হবে। ওরা আমাকে এই ছ’বছরের ভিসাও দিয়েছে। আর তিন মাস অন্তর রিনিউ করতে হবে না।
সুমন কথা বলতে পারছিলেন না। ঠাকুমা সুরবালার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলতেন, ‘দেশ ভাগ হয় নাই, সুখ আরও সুখের জন্য আমরা দেশ ছেড়েছি। দেশ ফাঁকা হয়ে গেছিল। পুরুষহীন দেশ, সেই সুযোগেই ওরা আমাদের তাড়িয়েছে। সুখের কাজল খুব দামি, সহজে মোছা যায় না।’
ডোডো বার বার বলছে, ‘কী ব্যাপার কথা বলছ না কেন?’
সুমন খুব আস্তে আস্তে বললেন, ‘আরও ছ’বছর? আমি কি অতদিন বাঁচব?’