বিদ্যায় সাফল্যও হতাশা দুই বর্তমান। নতুন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কর্মপ্রার্থীদের শুভ যোগ আছে। কর্মক্ষেত্রের ... বিশদ
ভাঁড় হিসাবে তাঁর আবার অনেক বৈশিষ্ট্য আছে। তার মধ্যে একটি হল তাঁর প্রখর আত্মসম্মান জ্ঞান। দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনি ৪৮ বার অপমানিত বোধ করেন। সেসব কথা আবার তিনি মিডিয়ার সামনে ঠোঁট ফুলিয়ে প্রচারও করেন। অবশ্য ডাক্তাররা বলেছেন, এই অপমানবোধ তাঁর পক্ষে স্বাস্থ্যকর। যেদিন তিনি কম অপমানিত বোধ করেন, সেদিন তাঁর হজমের সমস্যা দেখা দেয়। ডাক্তাররা তাই তাঁর অপমান ব্যাধি সারাতে নারাজ। বলেছেন, এটা ওনার একটা শারীরিক পজিটিভ সাইড এফেক্ট। ওনাকে দেখে গবেষকরা আত্মসম্মানের সাইড এফেক্ট নিয়ে গবেষণাও শুরু করে দিয়েছেন।
মন্ত্রী গবুচন্দ্র রাজাকে মাঝে মাঝেই জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি ভাঁড় পুষেছেন অথচ সেগুলিকে নিজের কাছে রাখেন না কেন? তাতে কিছুটা বিনোদনের ব্যবস্থা হতো।’ হবু রাজা হাসতে হাসতে বলেন, ‘গবু, তুমিই হলে আমার সেরা ভাঁড়। তাই ওদের কাউকে আমার কাছে রাখিনি। তাছাড়া আমি কি শুধু নিজের কথা ভাবি? আমি দেশের কথাও ভাবি। দেশের বিনোদনের জন্যই ওদের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে প্রপালক নিয়োগ করেছি। ওদের মজার মজার কথা শুনে লোকে সমস্যা, কষ্ট, দুঃখের কথা ভুলে যাবে।’
একদিন হবু রাজা মন খারাপ করে বসেছিলেন, গবু গিয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করাতে রাজা বলেছিলেন, ‘সব প্রাণীরই বিবর্তন উন্নততর হয়েছে। কেবল ভাঁড়েদেরই গুণগত মান নিম্নগামী হয়েছে। তুমি দেখো, সব ভাঁড়ের গল্পেই জীবনবোধ এবং জ্ঞানবুদ্ধির লক্ষণ ধরা পড়ে। আমার পোষ্য ভাঁড়েরা কেন যে এমন নির্বোধ বুঝি না!’
গবু বললেন, ‘ভাঁড়ের ভাঁড়ার উন্নততর করতে ওদের নিয়ে একটা ওয়ার্কশপ করুন মহারাজ, কীভাবে কথা বলতে হয়, সেটা ওদের শেখানো দরকার।’
দিন কয়েক আগে হবু তড়িঘড়ি গবুকে ভিডিও কলে বললেন, ‘তুমি রাজ অমাত্যদের বল, ভিডিও কলে জগু ভাঁড়কে ধরতে।’
কয়েক মিনিটের মধ্যে ভিডিও কলে হবু, গবু এবং জগু ভাঁড়ের কনফারেন্স শুরু হল।
হবু রাজা প্রথম থেকেই অ্যাটাকিং মুডে। একাটু ঝাঁঝের সঙ্গেই বললেন, ‘ভাঁড়েরা কিন্তু গর্দভ নয় জগু। তাদেরও একটা বুদ্ধি থাকে। সেই বুদ্ধিকে তারা কাজে লাগায়।’
গবু বললেন, ‘যাদের বুদ্ধি নেই, তারা কী করবে মহারাজ?’
হবু খেপে গিয়ে বললেন, ‘তোমার মতো দেশের মন্ত্রী হবে।’
জগু ভাঁড় বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন মহারাজ, আমার বুদ্ধি নেই।’
হবু বললেন, ‘নেই তো জানি, সেটা আবার গলাবাজি করে বলা হচ্ছে।’
হবু বিনত ভঙ্গিতে বললেন, ‘গলাবাজি নয় মহারাজ ,আপনার সিদ্ধান্তটাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করছি।’
হবু খেঁকিয়ে বললেন, ‘বেশ করেছো। ওইসব কথা তোমাকে কে বলতে বলেছে?’
জগু কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, ‘কোন কথা মহারাজ?’
হবু বললেন, ‘ওই কম্পন ঝড়ে তেমন কিছু কাঁপেনি, যেটুকু ক্ষতি হয়েছে, তা সামান্যই।’
জগু বললেন, ‘মহারাজ আমি আমার লাটবাড়িতে বসে সেটাই বুঝেছি, আমার চেয়ার, টেবিল, খাট কিছুই কাঁপেনি, তাই ভাবলাম।’
হবু বললেন, ‘তোমার ঘরের খাট কাঁপবে কেন, এ কি ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি?’ গবু, এটা কেমন ভাঁড়, কিছুই বোঝে না। কম্পন ঝড় আর ভূমিকম্প, এর ফারাক বোঝ? এই জন্যই তোমাকে রোজ অপমানিত হতে হয়।’
জগু আরও বিনত। বললেন, ‘ঠিক বলেছেন মহারাজ, আমি অপমানের যোগ্য।’
হবু বললেন, ‘আবার বড় গলা করে কথা বলছ?’
জগু আবার বললেন, ‘আপনি যে সত্যি কথাটা বললেন, সেটাই প্রতিষ্ঠা করলাম।’
হবু বললেন, ‘তুমি কি আমার প্রতিধ্বনি নাকি?’
জগু বললেন, ‘আজ্ঞে, আমি আপনার প্রতিধ্বনি, প্রতিবিম্ব, প্রতিফলন, প্রচ্ছায়া ইত্যাদি ইত্যাদি।’
হবু বললেন, ‘তাহলে মনে রেখো, বেশি প্রতিভা দেখালে প্রতিফলও পেতে হবে। সাবধানে প্রতিবাক্য ব্যবহার করবে।’
গবু বললেন, ‘ভালো করে কানে ঢুকিয়ে নাও জগু।’
হবু বললেন, ‘এবার থেকে মন দিয়ে ভাঁড়েদের জীবনকথা ও ইতিহাস পড়ে দেখো। আগেকার দিনের ভাঁড়েরা রাজাদের ভুলত্রুটির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত।’
জগু বললেন, ‘আপনি কোনও ভুল করতেই পারেন না।’
হবু একটু খুশি হয়ে বললেন, ‘হুম। আচ্ছা, তুমি টেগোরের নাম শুনেছো?’
জগু বললেন, ‘শুনেছি মহারাজ।’
হবু বললেন, ‘তাঁর একটি কবিতা আছে। সামান্য ক্ষতি। সেটা পড়েছো?’
জগু বললেন, ‘না মহারাজ। আমার আপ্ত সহায়ককে বলব, খুঁজে দিতে। তারপর পড়ে নেব।’
হবু বললেন, ‘হ্যাঁ, পড়ে নিও। ওটা তোমার পড়া দরকার। কাশীর মহিষী করুণা মাঘমাসের শীতে নদীতে স্নানে গিয়েছিলেন। স্নান করে উঠে রানির খুব শীত করছিল। সখীদের বললেন, একটু আগুন জ্বালা, আমি ‘শীত নিবারিব অনলে’। আগুন জ্বালানোর মতো কিছু খুঁজে পেল না সখিরা। অবশেষে রাজমহিষী করুণা বললেন, ওই তো দেখা যাচ্ছে কয়েকটি পর্ণকুটির। ওগুলো জ্বালিয়ে দে। আমি হাত-পা সেঁকব। রানির নির্দেশে পথের পাশে গরিবদের ঘরে আগুন লাগানো হল। সব পর্ণকুটির ছাই হয়ে গেল। গরিব প্রজারা রাজাকে এসে অভিযোগ জানিয়ে সব কথা বললেন। রানি রাজপ্রাসাদে এলে রাজা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা তুমি কী করলে? রানি সেদিন সদম্ভে তোমারই মতো উত্তর দিয়েছিল, ওতো সামান্য ক্ষতি। বুঝলে জগু, লাটবাড়িতে বসে যাকে সামান্য ক্ষতি বলা হয়, তা সামান্য ক্ষতি নয়।’
জগু ভাঁড় বললেন, ‘তারপর কী হল মহারাজ, গল্পটা কি শেষ হয়ে গেল? আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে।’
হবু বললেন, ‘না গল্প শেষ হয়নি। মহারাজা রানির রাজবসন, রাজপ্রসাধন, অলঙ্কার সব খুলে একটা জীর্ণ বসন পরিয়ে দিয়ে বললেন, যাও রাজ্যের প্রতিটি ঘরে গিয়ে ভিক্ষা করে ওই পর্ণকুটির আবার গড়ে দেবে। এক বছর সময় দিলাম। এই এক বছরেই বুঝে যাবে, তুমি যে ক্ষতি করেছ, তা কতটা সামান্য।’
জগু মাথা নেড়ে হাত জোড় করে বললেন, ‘খুব জ্ঞানী রাজা। আপনারই মতো মহারাজ। বুদ্ধিমান, প্রজারঞ্জক....।’
হবু তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি একবার ঘুরে ঘুরে দেখবে নাকি জগু, কম্পন ঝড়ে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কতটা সামান্য?’
জগু বললেন, ‘না মহারাজ এক গল্পেই আপনি আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। আমি ওই সামান্য ক্ষতির আগে কয়েকটা ‘অ’ বসিয়ে দিয়ে আবার বলব, অসামান্য ক্ষতি, অভূতপূর্ব ক্ষতি, অতুলনীয় ক্ষতি।’
হবু বললেন, ‘রাজা রাজনীতি বোঝে। কিন্তু ভাঁড়েরা সবসময় রাজনীতি বোঝে না। এই অঙ্গরাজ্য নিয়ে আমার অনেক পরিকল্পনা জগু। এমন কিছু ফস করে বলে ফেলো না, যাতে আমার সব পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যায়। নির্বাচনী কৌশল অবলম্বন করে আমাকে পদক্ষেপ নিতে হয়। তুমি যখন আমার প্রতিধ্বনি, প্রচ্ছায়া ও প্রতিবিম্ব, তাহলে সেটা হয়েই থেকো। আমার ধ্বনি বুঝে তুমি প্রতিধ্বনি করবে। আমার ছায়া নড়লে তবেই তোমার প্রচ্ছায়া নড়বে। এটা যেন মনে থাকে। যখন ঝগড়া করতে বলব, তখন ঝগড়া করবে। যখন মধু মাখাতে বলব, তখন মধু মাখাবে।’
জগু বললেন, ‘তাই হবে মহারাজ।’
হবু বললেন, ‘তাই যেন হয়। নাহলে এতদিন যেমন মিথ্যা অপমানের কথা বলে নানা সময়ে নাকে কান্না কেঁদেছো, এবার সত্যি করেই অপমানের মুখোমুখি হতে হবে। ওই লাটবাড়ি থেকে তোমাকে এমন জায়গায় ছুঁড়ে ফেলে দেব যে, কোনওদিন আর মিডিয়ার সামনে ভ্যানভ্যান করতে পারবে না। ঠিক আছে, আবার পরে প্রয়োজনে ডেকে পাঠাব।’
ভিডিও কনফারেন্স শেষ হল। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল জগু ভাঁড়ের। হতাশ মুখে বসে থেকে তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘হায়রে, এটাই হল ভাঁড়েদের জীবন, যার জন্য চুরি করি, সেই বলে চোর।’