বিদ্যায় সাফল্যও হতাশা দুই বর্তমান। নতুন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কর্মপ্রার্থীদের শুভ যোগ আছে। কর্মক্ষেত্রের ... বিশদ
গ্রামের মানুষের প্রতি বেশিরভাগ শহুরে মানুষের তাচ্ছিল্যের মনোভাব, শ্রদ্ধার অভাব রবীন্দ্রনাথকে ব্যথিত করেছিল। ‘‘অধিক দূরে নয়, তোমাদের দ্বারের নিকটে ক্ষুধিতেরা দাঁড়াইয়া আছে।’’—জানিয়ে উচ্চকোটির মানুষের বিবেক জাগাতেও সচেষ্ট ছিলেন তিনি। কবি ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেন, ‘‘হৃদয়হীন বিলাসের ক্রোড়ে যে নিদ্রিত আছে, মহেশ্বরের বজ্রশব্দে যদি একদিন সে জাগিয়া উঠে তবেই তাহার চেতনা হইবে, নতুবা দুঃখী-অনাথের ক্রন্দন ধ্বনিতে তাহার নিদ্রা ভঙ্গ হইবে না।’’
কলেরা, প্লেগ, পক্সের মতো অতীতের কিছু মহামারীর ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, বিপন্ন মানুষের মধ্যে গরিবই ছিল বেশি। যক্ষ্মা মহামারী না-হলেও, এই সংক্রামক রোগেও ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় শীর্ষে গরিবরাই। কারণ, বেশিরভাগ গরিব পরিবারের কাছে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অধরা। ব্যতিক্রম করোনা বা কোভিড-১৯। অন্তত ভারতের ক্ষেত্রে। এ দেশে করোনার পুরোটাই আমদানিকৃত। এখনও পর্যন্ত যতটুকু জানা যায়, এতে গরিব মানুষের দায় নেই। বরং বিদেশে যাতায়াত অথবা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে, এমন সম্পন্ন সম্ভ্রান্ত কিছু মানুষের অজ্ঞতা অথবা স্বার্থপরতার শিকার তাঁরা। সব মিলিয়ে করোনা মহামারী সমস্ত শ্রেণীকে এক বন্ধনীতে এনে ফেলেছে। সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গে যতগুলি বিধ্বংসী ঝড় আছড়ে পড়েছে, তার কোনওটিই কলকাতা মহানগরীকে সেভাবে স্পর্শ করেনি। ব্যতিক্রম উম-পুন।
২০ মে, বুধবার এই ভয়াল ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় এবং সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি শহরতলি-সহ মূল কলকাতাকে একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রবল বেগের এবং তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী এই তাণ্ডবে ভেঙে অথবা উপড়ে পড়েছে হাজার হাজার গাছপালা। গাছেরা অবশ্য একা নয়, সঙ্গে নিয়ে পড়েছে বিদ্যুতের অসংখ্য খুঁটিকেও। বেশকিছু পুরনো বাড়ি ভূপতিত হয়েছে। মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে নতুন কিছু বাড়িরও। অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে কলেজ স্ট্রিটে ঐতিহ্যবাহী বই-ব্যবসার। দশাসই চেহারার গাছ আড়াআড়ি শুয়ে থাকায় আটকে গিয়েছে রাস্তা, নর্দমা। সবার আগে বিপর্যস্ত হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। আমরা জানি, বিদ্যুৎই হল আজকের নগরসভ্যতার প্রাণ। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের স্বাভাবিক পরিণাম—পুরসভার পানীয় জল সরবরাহ এবং হঠাৎ জমে যাওয়া জল নিকাশি ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়া। বাড়িতে বাড়িতে প্রচণ্ড দুর্ভোগ—পাম্পে জল উঠেব না। ফ্রিজ, ফ্যান, এসি, টিভি চলবে না। মোবাইল ফোন রিচার্জ হবে না। বন্ধ হয়ে যাবে ব্রডব্যান্ড ওয়াইফাই। ফোনের টাওয়ারগুলি অকেজো হয়ে পড়বে। অথচ, লকডাউনের মধ্যে প্রতিটি শহুরে পরিবারের ফ্রিজ এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থার উপর নির্ভরতা অনেক বেশি। হাজার হাজার চাকরিজীবী ওয়ার্ক ফ্রম হোম সিস্টেমে চাকরি টিকিয়ে রেখেছেন। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি সব বন্ধ। বন্ধ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলির কোচিং। ফলে, এসবের বিশেষ পাঠদান ও পাঠগ্রহণ (অনলাইন ক্লাস) চলছে ঘরে বসেই। অনেক গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তি চিকিৎসাধীন আছেন বাড়িতেই। হাসপাতাল, নার্সিংহোমেও চিকিৎসা পরিষেবা সচল রাখাও দুষ্কর এই সময়। দূরপাল্লার ট্রেন, বাস এবং ডোমেস্টিক ফ্লাইটের টিকিট বুকিং শুরু হয়ে গিয়েছে। সবটাই অনলাইন। এই দুর্দিনে ই-কমার্স এবং অনলাইন ব্যাঙ্কিংয়ের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্তরিকতার কোনও অভাব নেই। তিনি বরং সর্বশক্তি দিয়েই চেষ্টা করেছেন। তাঁর প্রশাসন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তুলতে চেয়েছে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। তবু কাঙ্ক্ষিত সময়ের ভিতরে সবটা করা যায়নি। শহরবাসীও বুঝেছেন, একে কলকাতার ক্ষেত্রে এ এক অদৃষ্টপূর্ব বিপর্যয়, তার উপরে এটা ঘটেছে টানা লকডাউন পর্বের ভিতরে। এই পরিস্থিতিতে যে বাড়তি লোকবল দরকার, সরকার ও পুরসভার তাতে বেশ ঘাটতি ছিল। কারণ সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের বেশিরভাগই থাকেন অন্য জেলায়, অনেক দূরেও অনেকে। লকডাউনের কারণে তাঁরা যে যার বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন অনেক দিন আগেই।
তবে কারণ যা-ই হোক, লক্ষ লক্ষ মানুষের এই অভাবনীয় দুর্ভোগটা বাস্তব, যেটা বৃহত্তর কলকাতার মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেলেন, স্মরণকালের মধ্যে সম্ভবত এই প্রথম। শহরবাসীরা এই সুযোগে একবার উপলব্ধি করার চেষ্টা করব কি—সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ মাঝেমধ্যেই এমন বিপর্যয়ে কী নিদারুণ কষ্ট ভোগ করেন? ২০০৯-এর আইলা এবং ২০১৯-এর ফণী ও বুলবুলের ক্ষত কি সারিয়ে উঠতে পেরেছেন তাঁরা? ভেবে দেখুন, উম-পুনের আঘাতটা তাঁদের কাছে আক্ষরিক অর্থেই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-ই হয়ে উঠল। রবীন্দ্রনাথ এটাকেই ‘‘মহেশ্বরের বজ্রশব্দে যদি একদিন সে জাগিয়া উঠে তবেই তাহার চেতনা হইবে’’ বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেন কি না ভাবতে হবে।
কেন্দ্র এবং রাজ্য দুই সরকারের কাছেই আমাদের সমবেত দাবি থাক, কলকাতার পাশাপাশি দুই ২৪ পরগনায় বিস্তৃত সুন্দরবন লাগোয়া জনপদটাকেও যেন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বাসযোগ্য করে তোলা হয়। ওই এলাকার বাৎসরিক বন্যা এবং নদীবাঁধ সমস্যারও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে কেন্দ্র ও রাজ্য সমন্বয়ের দৃষ্টান্ত তুলে ধরুক, যথেষ্ট আন্তরিকতার পরিচয় দিক। তাঁদের বহু দশকের এই যন্ত্রণা আমাদের মতো শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে কোনও দিনই স্পর্শ করেনি। তাঁদের দুঃখে এতটুকুও কাতর হইনি আমরা। অথচ, তাঁদের দুঃখকষ্ট আমাদের থেকে অনেক অনেক বেশি। শহরে আজকের সাময়িক যন্ত্রণায় আমরা যতটা কাতর হয়েছি, এই যন্ত্রণা তাঁরা ভোগ করেন ৩৬৫ দিন! তাঁদের যন্ত্রণা অনুভব করতে না-পারার কারণ আর কিছুই নয়, গ্রামের সবদিক থেকে দুর্বল মানুষগুলিকে আমরা কোনও দিনই সমগোত্র ভাবতে শিখিনি, পারিনি। এই যে মিথ্যে অহংবোধ, এটাই এই ভারতের সমস্ত সর্বনাশের মূলে। এটাই ‘বিষবৃক্ষ’।
উম-পুন হাজার হাজার প্রিয় বৃক্ষ উপড়ে দিয়েছে। রেখে গিয়েছে বিষবৃক্ষটি—যার শিকড় চারিয়ে রয়েছে বহু গভীরে। পারব কি আমরা বাংলার মাটি থেকে, ভারতের মাটি থেকে বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলার পবিত্র দায়িত্বটি পালন করতে? আমরা অনুমান করতে পারি—করোনা এবং উম-পুনের অনুজরা নজর রাখবে। আমরা ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে তারা হাজির হবে সমুচিত জবাব নিয়ে ফের।
আমাদের উচিত হবে, বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলার পাশাপাশি প্রিয় বৃক্ষরোপণের উৎসবে মেতে ওঠা। আমরা জানি, একটি গাছ একটি প্রাণ। উম-পুন ঝড়ে যত গাছ ধ্বংস হয়েছে অন্তত তত গাছ বড় করার দায়িত্ব আমাদের সকলকেই নিতে হবে। জনে জনে। বর্ষা ঋতু সামনেই। রাজ্য সরকারের বন বিভাগ, সামাজিক বনসৃজন দপ্তর এবং সমস্ত পঞ্চায়েত ও পুরসভা সমবেত উদ্যোগ নিলে এ কাজ দুরূহ নয়। সুন্দরবনের বহু ক্ষতি ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। কাঠ মাফিয়া এবং চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্যে। কিছুটা হয়েছে গরিব মানুষের পেটের দায় থেকে। দুই বাংলা মিলিয়েই। সুন্দরবন নামের মহিমা ফিরিয়ে দেওয়ার মিলিত উদ্যোগ নিতে পারে নাকি দুই দেশ—বাংলার নিজস্ব সম্পদটিকে পৃথিবীর গর্ব করে তুলতে? ওই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যত ঘাটতি থাকবে তত কোপ পড়বে বনের উপর! আমরা যেন ভুলে না যাই, উত্তরে যেমন হিমালয় দক্ষিণে তেমন সুন্দরবন—আমাদের দু’টি বিরাট রক্ষাকবচ। কল্পনা করুন, সুন্দরবন নেই আর বয়ে গিয়েছে উম-পুন! কলকাতা মহানগরীর অস্তিত্বটাই হয়তো আজ কষ্টকল্পনা হয়ে উঠত।