বিদ্যায় সাফল্যও হতাশা দুই বর্তমান। নতুন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কর্মপ্রার্থীদের শুভ যোগ আছে। কর্মক্ষেত্রের ... বিশদ
গোঁড়ামি বিদ্যাসাগরের ধাতে ছিল না। একবার এক গোঁড়া ব্রাহ্মণ এসেছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। সেই সময় কয়েকজন অব্রাহ্মণ ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা আগন্তুককে প্রণাম না করায় সেই গোঁড়া ব্যক্তি প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করেন। তিনি সরাসরি বলে বসেন, ‘এই অর্বাচীনদের উদ্দেশে বলছি, ব্রাহ্মণরা বর্ণশ্রেষ্ঠ, তাঁরা বেদ-উপনিষদ জানেন। তাই অব্রাহ্মণদের সর্বদা ব্রাহ্মণদের প্রণাম করা উচিত।’ কথাটা শুনে বিদ্যাসাগরের বেশ মজা লাগল। তিনি তাঁকে কটাক্ষের সুরে বললেন, ‘পণ্ডিতমশাই, আপনি তো বিষ্ণুর দশাবতারের কথা জানেন। বিষ্ণু একবার বরাহ অবতারে ধরা ধামে এসেছিলেন। তাহলে ডোমপাড়ায় যত শুয়োর আছে, সবকটাকেই ভক্তি ভরে প্রণাম করা উচিত, কি বলেন?’
বিধবাবিবাহ প্রচলনের মাধ্যমেও সামাজিক গোঁড়ামির শৃঙ্খল ভেঙেছিলেন এই বিদ্যাসাগর। বিধবাবিবাহ প্রচলনের জন্য বিদ্যাসাগরের মেহনত ও খ্যাতি দেশ ও দশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু হিন্দু বিবাহের আরও দুটি বিষয়েও তাঁর উদযোগের কথা আড়ালে চলে গিয়েছে। অথচ বিধবাবিবাহের সঙ্গে এই দুটি বিবাহ-প্রথা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। বিধবাবিবাহের জন্য শারীরিক লড়াই ও অর্থ বিনিয়োগের চূড়ান্ত অবস্থায় যাওয়ার আগে থেকে তিনি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন যে, কৌলীন্য প্রথার সুযোগ নিয়ে যাঁরা বহু সংখ্যক বিবাহ করবেন— তাঁদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের বিবাহিত স্ত্রীদের অনিবার্য বৈধব্য বিধবাবিবাহ প্রথাকে জটিলতর করে তুলেছে। আবার মেয়েদের অতি অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার জন্য বয়স্ক স্বামীর মৃত্যুতে বাল্য বিধাবাদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যেত। অবশ্য বিধবা বিবাহের যে আইন পাশ করা হয়েছিল-তাতে যে সব বিধাবাদের বিয়ে হতো তাঁরা সকলে বৈধব্যের বেশ কিছুকাল পরে বিবাহিত হয়েছিলেন। বিধবাদের ক্লেশের অন্যতম দুটি কারণ বহুবিবাহ এবং বাল্য বৈধব্য— তা উপলব্ধি করেছিলেন বলে বিদ্যাসাগর মশায় এই দুটি প্রথা যাতে নিরুদ্ধ হয়, তার জন্যও অনেকরকম চেষ্টা করেছিলেন।
এবারেও এই বিষয়ে বিদ্যাসাগর মশায়কে পথিকৃৎ ভাবা চলে না। সে সময়ে ‘বহুবিবাহ নিবারণ হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’ নামে লিখিত দুটি পুস্তিকার (১৮৭১, ১৮৭৩) মধ্যে প্রথম পুস্তিকার ‘বিজ্ঞাপনে’ তিনি নিজেই লিখে গিয়েছেন, ‘প্রথমতঃ ১৬ বৎসর পূর্বে, শ্রীযুক্ত বাবু কিশোরীচাঁদ মহাশয়ের উদ্যোগে, বন্ধুবর্গ সমবায় নামক সভা হইতে ভারতবর্ষীয় ব্যবস্থাপক সমাজে এক আবেদন পত্র প্রদত্ত হয়।’ সভাটির নাম সম্ভবত হওয়া উচিত ছিল ‘সমাজোন্নতিবিধায়িনী সুহৃদ্ সমিতি’- এটি কিশোরীচাঁদ কাশীপুরের বাগানে ১৮৫৫খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর স্থাপন করেন। এর সভাপতি ছিলেন দেবেন্দ্রেনাথ ঠাকুর এবং সম্পাদক ছিলেন কিশোরীচাঁদ ও অক্ষয়কুমার দত্ত। অক্ষয়কুমার বহুবিবাহের প্রতিবাদ করে ‘তত্ত্ববোধিনী’ ও ‘বিদ্যাদর্শন’ পত্রিকায় একাধিক প্রবন্ধ লিখে এর সূত্রপাত ঘটান। কৌলীন্য প্রথার বিষয়ে আমরা জানি যে ,বঙ্গদেশাধিপতি বল্লাল সেন শুদ্ধা ব্রাহ্মণের বংশ প্রবর্তনের জন্য আদিশূর-ভট্টনারায়ণ প্রভৃতি কনৌজবাসী ব্রাহ্মণদের নিয়ে এসে এদেশে বসবাস করিয়ে ‘কুলীন’ সম্মান দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা দেন। তাঁদের দেখাদেখি বসু, ঘোষ, মিত্র বংশীয় কায়স্থরা কুলীন হন। বংশ মর্যাদার কারণে অন্য ব্রাহ্মণেরা তাঁদের কন্যাদের একের পর এক বিশেষ কুলীনের সঙ্গে বিয়ে দিতে লাগলেন। একজন ৫ থেকে ৮০ টি কন্যাকে বিয়ে করেছেন- এমন তালিকা নাম-ঠিকানা সহ বিদ্যাসাগর নির্মাণ করেন। এই সংখ্যা পরে আরও বেড়ে গিয়েছিল। এই সব কন্যাদের স্বামী বেশিরভাগে ক্ষেত্রে স্ত্রীদের উদ্দেশ রাখতেন না। পরে অনাচার ব্যাভিচারে দেশ পূর্ণ হয় এবং কুলীন পুরুষের মৃত্যুতে বিধবার সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিশোরীচাঁদের প্রয়াসের ষোলো বছর পর বিদ্যাসাগর ভারতবর্ষীয় ব্যবস্থাপক সভার কাছে বহুবিবাহ প্রথা যাতে লোপ পায়, এমনতর আইন প্রণয়নের জন্য শাস্ত্র বচন উল্লেখ করে আবেদন জানান। নৈতিক অধঃপতনের তিনি প্রমাণ দেন। অনেকেরই বঙ্কিমচন্দ্রের ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাস এবং শরৎচন্দ্রের ‘বামুনের মেয়ে’ পড়া আছে। শেষের উপন্যাসের কুলীন ডাক্তার প্রিয়নাথ মুখুজ্জের স্ত্রীর গর্ভজাত একমাত্র কন্যার পিতৃত্বের দাবি নিয়ে হাজির হয়েছিল হিরু নাপিত- যার জন্য সন্ধ্যার অন্ধকারে প্রিয়নাথকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল! রংপুরের জমিদার কালীনারায়ণ রায়চৌধুরী ঘোষিত কৌলীন্যবিরোধী রচনা ‘কুলীনকুল সর্বস্ব’ নাটক লিখে বিদ্যাসাগর মশায়ের উদ্যোগের আগে রামনারায়ণ তর্করত্ন পারিতোষিক পেয়েছিলেন। আর পরে রবীন্দ্রনাথের কবিতার বিখ্যাত পঙ্ক্তিগুলি মনে পড়িয়ে দেয় বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহবিরোধী আন্দোলনের কথা—‘মা কেঁদে কয়, মঞ্জুলি মোর ওই তো কচি মেয়ে, ওরই সঙ্গে বিয়ে দেবে-বয়সে ওর চেয়ে পাঁচ গুণে সে বড়/ তাকে দেখে বাছা আমার ভয়েই জড়োসড়ো।’ এই বন্ধনীই বিদ্যাসাগরকে আইন প্রবর্তন করানোর জন্য ব্যবস্থাপক সভার কাছে আবেদন পত্র পাঠাতে বাধ্য করেছিল। তখনও বিধবাবিবাহ আইন পাশ হয়নি (১৬ জুলাই, ১৮৫৬)। কিন্তু ১৮৫৭-এর পর পুরো ন’বছর কেটে গেলেও সরকার কোনও একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছে না দেখে বিদ্যাসাগর আবার দ্বিতীয়বার ভারতবর্ষীয় ব্যবস্থাপক সভার কাছে স্মারক আবেদনটি পাঠিয়ে দিলেন ১ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৬ তারিখে।
এর মধ্যে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে, পরেও প্রবাহ থেমে যায়নি। বিদ্যাসাগর মশায় তাঁর পুস্তিকাকে লিখেছিলেন, ‘বহু বিবাহ প্রচলিত থাকাতে, বাঙ্গালাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যত দোষ ও যত অনিষ্ট ঘটিতেছে; বোধ হয় ভারতবর্ষের অন্য অংশে তত নহে এবং বাঙ্গালাদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও সেরূপ দোষ বা অনিষ্ট শুনিতে পাওয়া যায় না।’ দ্বিতীয় বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রচলিত থাকায় এই বিরোধী আইন পাশ করানোর ব্যাপারে ইংরেজ সরকারের খুবই দ্বিধা ছিল।
বিদ্যাসাগর মশায় তাই তাঁর পুস্তিকার (‘প্রচার’) দ্বিতীয় সংস্করণে দুটি ক্রোড়পত্র যোগ করে লড়াইটাকে জোর করে দিলেন। তাঁর বিপক্ষে লড়তে নেমেছিলেন মুর্শিদাবাদের গঙ্গাধর কবিরত্ন, বরিশালের রাজকুমার ন্যায়রত্ন, ক্ষেত্রপাল স্মৃতিরত্ন, সত্যব্রত এবং সর্বোপরি বিদ্যাসাগরের বন্ধু ও ‘পরমাত্মীয়’ খ্যাতিমান অধ্যাপক তারানাথ তর্কবাচস্পতি। লড়াইটা জমে উঠল দুই বন্ধুর মধ্যেই বেশি করে। মজার ব্যাপার ব্যবস্থাপক সভায় বিদ্যাসাগর মশায় প্রথম যে আবেদন পত্রটি পাঠিয়েছিলেন- অধ্যাপক বাচস্পতি সেটি পড়ে তাতে সই পর্যন্ত করেছিলেন। কিন্তু তারপরই উল্টো পথে। বিদ্যাসাগর মশায় বন্ধুর প্রতিটি প্রতিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর মত খণ্ডন করতে লাগলেন যদিও উভয় পক্ষই যথেষ্ট শাস্ত্র বচন উদ্ধার করে চলেছিলেন। বিদ্যাসাগর লিখেছেন, ‘তর্কবাচস্পতি মহাশয় যে সকল কপোলকল্পিত ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তদ্বারা যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহ— শাস্ত্রীয়তা প্রতিপন্ন হওয়া কোনও মতে সম্ভাবিত নহে।’ (ক্রমশ)
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল