বিদ্যায় সাফল্যও হতাশা দুই বর্তমান। নতুন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কর্মপ্রার্থীদের শুভ যোগ আছে। কর্মক্ষেত্রের ... বিশদ
আসল পাপ
আলোচনাটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে, কোভিড-১৯-এর আঘাত ভারতের অর্থনীতিতে যখন এসে পড়ল, তখনকার পরিস্থিতিটা আমি দেখাতে চাই। টানা সাতটি ত্রৈমাসিকে (কোয়ার্টার) আমরা দেখলাম জিডিপি-র হার নিম্নমুখী। ভারতের অর্থনীতিতে এই জিনিস এর আগে কখনও হয়নি। ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) কোভিড-১৯-কে বিশ্বব্যাপী মহামারী (প্যানডেমিক) ঘোষণা করল। অর্থনীতির শোচনীয় অবস্থার দিক থেকে আমাদের নজর সেদিকে ঘুরে গেল। সরকার এখন করোনা মহামারীকেই দুষবে, কিন্তু সত্যিটা হল, সরকারের বিভ্রান্তিকর নীতিগুলিই এই তীব্র আর্থিক সঙ্কটের মূল কারণ।
লকডাউনের প্রথম সিদ্ধান্তটি অনিবার্যই ছিল। কারণ, মার্চে করোনা ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণ আটকাতে একটিমাত্র ‘প্রতিষেধক’ আমাদের জানা ছিল—‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা’—যার মানে লকডাউন। বিকল্প কৌশল সামনে না-থাকায় সরকার একের পর এক লকডাউনে গিয়েছে। এই যে উপর্যুপরি লকডাউন হল, তাতে কী দেখলাম আমরা? একটি লকডাউন থেকে পরের লকডাউনে সুরাহা প্রাপ্তির পরিমাণ ক্রমশ কমে গিয়েছে—ইংরেজিতে যাকে বলে ডিমিনিশিং রিটার্নস। পাশাপাশি, এই ঘটনা থেকে মানুষের জন্য প্রকাণ্ড এক সঙ্কটও তৈরি হল।
প্রথম দফার লকডাউনের পর লাভালাভের বিচারে সরকার প্রমাণ করল যে তার প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। প্রথম সুযোগে, তৃতীয় দফার লকডাউনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী ন্যাশনাল টিভিতে উপস্থিত হওয়া থেকে নিজেকে বিরত করলেন, এবং চতুরভাবে দায়টা চালান করে দিলেন রাজ্য সরকারগুলির ঘাড়ে।
কিন্তু অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ যে রাজ্য সরকারগুলির হাতে নেই। কেন্দ্রীয় সরকার এখন যেন সার্বভৌম সম্রাটের মতো ক্ষমতা ভোগ করে। সরকারের যাবতীয় কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের (পিএমও) করতলগত। রাজ্যগুলির এমন অবস্থা করে দেওয়া হয়েছে যে, অর্থের প্রয়োজনে তারা কেন্দ্রের কাছে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে হাজির হয়—আইনগত ও সাংবিধানিক অধিকারে প্রাপ্য অর্থের জন্যেও। লোক দেখানো ‘সহায়তা’র হাত প্রসারিত করেছে—ডিসকমদেরকে লিকুইডিটির (বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানিগুলিকে নগদের) সুবিধা দিয়ে, ঋণগ্রহণের ঊর্ধ্বসীমা বৃদ্ধি করে—কিন্তু এসবেও এমন সব কঠিন পূর্বশর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে কোনও রাজ্য সরকারের পক্ষেই সেসব পূরণ করা সম্ভব হবে না, ফলে চলতি অর্থবর্ষে এই টাকার সুবিধাও নিতে পারবে না তারা।
ভয়াবহ মন্দা
মন্দার মতো ভয়ঙ্কর শব্দটির দিকে যা আমাদের ঠেলে দিল। গত ৪০ বছরে ভারতকে কখনওই নেগেটিভ জিডিপি গ্রোথ বা নেতিবাচক অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয়নি। মোদি সরকারই এই পার্থক্যটি তৈরি করে দিল, যদিও সরকার এর দায়টা মহামারীর ঘাড়ে চাপিয়ে পার পেতে চাইবে, কিন্তু মোদি সরকারই হল আসল পাপী। ডিমানিটাইজেশনের মতো চরম দিন, ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর থেকে এই সরকার এত যে ভুলের পর ভুলের পাপ করেছে, তার সবকিছু মনে করার দরকার নেই।
মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চীন, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও ব্রিটেন যে কৌশল বেছে নিয়েছিল, আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেটাই অনুসরণ করলেন। প্রথমেই একটি লকডাউন। তারপর পরীক্ষা, অসুস্থ মানুষজনকে খুঁজে বের করা, চিহ্নিতদের আলাদাভাবে রাখা এবং সংক্রামিতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর কলেবর বৃদ্ধি করা হল। এই সমস্ত পদক্ষেপে মিশ্র ফললাভ হল। সিকিম রাজ্যে একজনেরও সংক্রমণ ধরা পড়ল না, অন্যদিকে, মোট সংক্রমণের ৩৫ শতাংশ দেখা গেল মহারাষ্ট্রে। এর থেকে পরিষ্কার যে, এই ভাইরাস কোনও সীমানির্দিষ্ট পথ ধরে এগোয় না এবং এটা যেসব কারণে ছড়িয়ে পড়ে তার অনেকগুলিই এখনও অজানা।
তবুও মহামারীর অর্থনৈতিক পরিণাম ঠেকাতে বেশিরভাগ দেশ যে-পথ বেছে নিয়েছে, নরেন্দ্র মোদি তা অনুসরণ করার সুযোগ নেননি। প্রায় সমস্ত অর্থনীতিবিদ এই ব্যাপারে যে মডেলের পক্ষে সওয়াল করেছেন, তা হল ‘ফিসকাল স্টিমুলাস’। যার একটাই মানে: আরও ব্যয় করো। ২০২০-২১ সালের জন্য ব্যয়ের বাজেট বরাদ্দ ছিল ৩০ লক্ষ ৪২ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। যে অর্থনীতির ক্রমশ অবনতি ঘটছে, সেটার জন্য এই অঙ্কটি যথেষ্ট ছিল কি না, তা এক তর্কসাপেক্ষ প্রশ্ন, কিন্তু যে অর্থনীতি ভীমরবে শূন্যের নীচে নেমে আসছে, কোনও সংশয় নেই যে অঙ্কটি তার জন্য মোটেই যথেষ্ট হবে না।
আমাদের দরকার নতুন বাজেট। গত ১ ফেব্রুয়ারি যে অনুমান করা হয়েছিল সেটা আজ আর প্রাসঙ্গিক নেই। আগামী ১ জুন সরকারকে অবশ্যই নতুন বাজেট পেশ করতে হবে। সেখানে ব্যয়ের অঙ্কটি অবশ্য করে ৪০ লক্ষ কোটি টাকা রাখতে হবে। বর্তমান সূত্রে রাজস্ব (কর, কর-বহির্ভূত এবং মূলধনী সংগ্রহ) সংগ্রহের পরিমাণটি ১৮ লক্ষ কোটি টাকা হতে পারে। বাকিটার জন্য আমরা অবশ্যই ঋণ নেব। ঋণগ্রহণের বাজেট এস্টিমেটটা ৭ লক্ষ ৯৬ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়ে যাবে ২২ লক্ষ কোটি টাকা।
শেষ সুযোগ
বছরটা যেভাবে গড়াচ্ছে, যদি তাতে ঋণগ্রহণ বা রাজকোষ ঘাটতির স্তর একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় পৌঁছয়, তবে তার পরিণাম অন্যরকম হতে পারে—তখন রাজকোষ ঘাটতির একটি অংশকে মুদ্রাকরণে (মানিটাইজ) রূপান্তরিত করতে আমরা কোনওমতে দ্বিধা করব না—সোজা কথায় টাকা ছাপাব। ২০০৮/২০০৯ সালে অনেক দেশই এই পথে হেঁটেছিল এবং তার ফলে তাদের অর্থনীতি গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি মন্দার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল।
বিকল্পটি চিন্তা করতেও ভীষণ ভয় হয়। মন্দার অর্থ—ব্যাপক আকারে বেকারত্ব (বেকারত্বের হার ইতিমধ্যেই ২৪ শতাংশ), চাকরিপ্রার্থী যুবক-যুবতীদের কাজ পাওয়ার জন্যে দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে, শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি বা বেতন এবং আয় কমে যাবে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বা উপভোগ কমে যাবে, বেড়ে যাবে রোগভোগ বা রুগ্নতা এবং দারিদ্র্য।
২০২০-তে ভারতের যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠবে তা হল—পরিযায়ী শ্রমিক—একজন কঠোর পরিশ্রমী মানুষ যিনি নিজের এবং একটি পরিবারের ভার বহন করেন। দারিদ্র্যসীমার ঠিক উপরেই তাঁর অবস্থান। এই মানুষটিকে হঠাৎ এমন নীচে নামিয়ে দেওয়া হল, যেখানে তাঁর চাকরিটা চলে গিয়েছে, হাতে-গাঁটে কোনও টাকাকড়ি নেই, মাথাগোঁজার মতো ঠাঁই নেই, নেই খিদে পেটের খাবারটুকুও। এই মানুষটিকেই বাধ্য করা হল কয়েকশো কিলোমিটার পথ হাঁটতে। কখনও আবার তিনি একা নন—সঙ্গে রয়েছে বাচ্চারা। তখন ‘ঘরে’ ফিরে যাওয়ার জন্যই মরিয়া তিনি—এমন মরিয়া যে হয়তো ঘরে ফেরার অর্থ শুধু মৃত্যুকেই বরণ করে নেওয়া।
মোদি সরকারের সামনে শেষ সুযোগটাই অবশিষ্ট। এই সরকার তার ‘উটপাখি’ নাম্নী ঘোড়ার পিঠ থেকে অবশ্যই এবার নামবে এবং ব্যয়, ঋণগ্রহণ ও মুদ্রাকরণে মন দেবে। অন্যথায়, ভারতের অর্থনীতিকে এক দশক পিছিয়ে দেওয়ার কারণে মানুষ এই মোদি সরকারকে কোনও দিন ভুলবে না বা ক্ষমা করবে না।
লেখক: প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী