কর্মলাভের যোগ আছে। ব্যবসায় যুক্ত হওয়া যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রশংসা জুটবে। ... বিশদ
ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এখন লোক-সমাজে ‘বিদ্যাসাগর’ নামেই পরিচিত। যাঁরা পছন্দ করতেন না— বলতেন ‘বিদ্যেসাগর’। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে পড়াচ্ছেন আবার বাড়িতে তাঁর কাছে পড়তে আসছেন শ্যামাচরণ সরকার, রামরতন মুখুজ্যে মশায়ের মতো ব্যক্তিরা সংস্কৃত শিক্ষার জন্য। ঘরে-বাইরে তাঁর ছাত্র। আবার নিজেও ছাত্র হয়ে পড়ছেন ইংরেজি। ঠিক এই সময়েই, ১৮৪৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকাশ করেছেন ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’— তার সম্পাদক হয়েছেন অক্ষয়কুমার দত্ত— এঁরই পৌত্র হলেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। এই সম্পাদক মশায়ও যেন বিদ্যাসাগরের ছাত্র। নিজে ওই পত্রিকার জন্যে যা কিছু লেখেন— বিদ্যাসাগর তাঁর সমবয়স্ক হলে কী হবে, তাঁকে দিয়ে লেখাটি ঘষে-মাজিয়ে না নিলে স্বস্তি পান না। আদ্যোপান্ত দেখে দিতেন— বোঝা মুশকিল হয়ে পড়তে পারে— কতটা তিনি বদলে দিয়ে নিজের লেখা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। অক্ষয়কুমার মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন বিদ্যাসাগর মশায়ের এই ভূমিকার কথা। তত্ত্ববোধিনীর জন্যে লেখাতেই শুধু নয়, অক্ষয়কুমারের বইপত্রেও বিদ্যাসাগরের কলমের ছাপ যথেষ্ট আছে। এ-সব ভালোবাসার পরশ— মাস্টারিগিরি নয়। আগে ‘তত্ত্ববোধিনী’র সঙ্গে বিদ্যাসাগরের যথেষ্ট মিলমিশ ছিল। তারপরে কী যে কী হল জানি না— পত্রিকাটির সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখলেন না।
আমরা পরে দেখব কোনও একটা চাকরির ব্যাপারে বিদ্যাসাগর মশায় তাঁর ভাই দীনবন্ধুকে একটি শূন্যপদে সুপারিশ করেন— আজকের মুখরারা একে বলেন আত্মীয়তোষণ। তাই কি সত্যি? দেখছি এ সময়ে তাঁর পরমবন্ধু (পরে যে কী সব হয়ে যাবে!) পনেরো টাকা মাইনের মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সিভিল পড়ানোর জন্যে একটি শূন্যপদে ঢুকিয়ে দিলেন। তাঁর সঙ্গে এক ক্লাসে পড়তেন মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ, মাদ্রাসা কলেজের একটি পদ খালি হলে মার্শেল সাহেবকে বলেকয়ে চল্লিশ টাকা মাইনের চাকরিটি পাইয়ে দেন। এই যে মানুষজনকে চাকরি করে দিলেন— হিসেব মিলিয়ে দেখতে গেলে তাঁরা সবাই যোগ্যতম প্রার্থীই ছিলেন— তাই এই সুপারিশ। শিক্ষাক্ষেত্রে ভুসি মিশাল দিতে বিদ্যাসাগর একেবারেই নারাজ।
ঠিক এই সময়ে বাংলার বড়লাট (গভর্নর) হয়ে ভারতে এলেন লর্ড হার্ডিঞ্জ। তিনি এসে একবার সংস্কৃত কলেজের হালহকিকত জানবার জন্যে সেখানে গিয়ে দেখেন সেখানের ছাত্ররা একেবারেই ইংরেজি পড়ে না। এ জন্য তারা চাকরিবাকরিও সহসা পায় না। আগে এই কলেজের ছেলেরা জজ পণ্ডিতির চাকরি পেতেন। তাঁদের কাজ ছিল সাহেব জজেরা যখন বিচার করতেন, তখন এদেশের আইনকানুন বুঝিয়ে বলে বিচারের কাজে তাঁদের সাহায্য করা। সেই পদও উঠে গেছে ততদিনে। আর যাঁরা বাংলা পড়তেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বা বাইরে, তাঁদের জন্যে ভালো বই বলে কিছু ছিল না। যা ছিল, তা সাহেব সিভিলিয়ান ছাত্ররা বোধহয় ছুঁয়েও দেখত না— দাঁত ফোটাতে পারত না বলে।
সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি শেখাবার একটা ক্লাস ছিল বটে, তবে তাতে যে কিছু শেখানো হতো না, তার বড় প্রমাণ বিদ্যাসাগর নিজেই ইংরেজি পড়ার জন্যে অন্যদের সাহায্য নিতেন। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে এই ইংরেজি বিভাগ খোলা হলেও এটা মাঝে উঠে যায়। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে আবার চালু হয়েছিল— কিন্তু তা নমো নমো করেই। এবার বিদ্যাসাগর মশায় সংস্কৃত কলেজে আসার আগে থেকেই এর সুরাহা করার কথা ভেবে রেখেছিলেন। কিছুদিন পরে সংস্কৃত কলেজের দায়িত্ব পেয়ে ১৫ ডিসেম্বর, ১৮৫৮ তারিখে ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা স্বাক্ষরে তিনি একটি বড় সুপারিশপত্র দিয়ে কলেজে ইংরেজি শেখানো, এক শ্রেণী থেকে পরের শ্রেণীতে ওঠাউঠিতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সে-বিষয়েও বললেন। যে সংস্কৃত কলেজে সংস্কৃত শিক্ষার জন্য ঠাকুরদাসবাবু তাঁর বড় ছেলেটিকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন, সেই পুত্রই এবার ইংরেজি শেখার প্রয়োজনীয়তা বুঝে নিজেই সেখানে রীতিমতো ইংরেজি পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এসব গল্প আবার পরে বলা যাবে।
বিদ্যাসাগর মশায় কি শুধু পড়া-পড়ানো-অধ্যাপক নিযুক্তি এসব কাজ নিয়েই থাকছেন? তার মাথায় তখন সাহেবরা বোঝার পর বোঝা চাপিয়েই চলেছেন। তার ওপর তিনি করুণাসাগর। কলেজের অধ্যাপকই হোন আর ছাত্রই হোক— কেউ অসুস্থ হলে তাঁর সেবা এবং শুশ্রূষার সঙ্গে চিকিৎসার ব্যয়ভার করার দায়িত্বও বিদ্যাসাগর মশায়ের। অধ্যাপক জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চাননের ভাগনের ওলাওঠা হল— তলব হল তাঁর। গিয়ে দেখেন বারবার জামাকাপড় বদলাতে হবে। অতএব রোগীটাকে দে দরমার চাটাই-এর ওপর শুইয়ে। চোখে জল এল বিদ্যাসাগরের। ভাই দীনবন্ধুকে পাঠালেন তোশক, চাদর, বালিশ কিনে আনতে। কোনও মুটে না পেয়ে মাইল তিনেক রাস্তা সেগুলো ঘাড়ে চড়িয়ে দীনবন্ধু ফিরে এলেন। এবার গায়ের সব ময়লা ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দুই ভাই মিলে রোগীকে বিছানা পেতে শুইয়ে দিলেন। কপাল করেছিলেন বটে এঁড়ে বাছুরটা। রোগীকে ভালো করে তবে তাঁর নিষ্কৃতি। পুরনো ছাত্র প্রিয়নাথ ভট্টাচার্যের দুটি ভাই কলেরায় আক্রান্ত। খবর গেল তাঁর কাছে। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। তাও তো এক ভাইকে বাঁচানো গেল না। বিদ্যাসাগরের চোখে জল গড়াচ্ছে অবিরল ধারায়। পরদুঃখে যে তিনি অশ্রুসাগর। বহুবাজারে তাঁর পড়শি বৈদ্যনাথ মুখুজ্যে মশায়ের কাজের ছেলেটির ওলাওঠা হল। গিয়ে দেখেন বৈদ্যনাথবাবু ভৃত্যটিকে ওপর থেকে নামিয়ে এনে পথে শুইয়ে দিয়েছেন। বিদ্যাসাগর কোনও কথাটি না বলে তাকে সরাসরি নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তার সেবা শুরু করলেন। দিন পাঁচ-সাতেকের চিকিৎসায় সে ভালো হয়ে উঠল। যার ঈশ্বর (চন্দ্র) সহায়— সে তো বাঁচবেই।
১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা সংস্কৃত কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির পদে বহাল হয়েছিলেন পঞ্চাশ টাকা বেতনে। কাজে যোগ দিয়েই সংস্কৃত কলেজটির সংস্কারের কাজে লেগে গেলেন। প্রথমেই ব্যাকরণ শ্রেণীর পরপর তিন বছরের সিলেবাস থেকে পড়ানোর রকমের বদল ঘটালেন। তিনি ছাত্রাবস্থা থেকেই দেখতেন কোনও কোনও শিক্ষক মশায় চেয়ারে হেলান দিয়ে নাসাগর্জন সহ নিদ্রাসুখে মগ্ন। আর প্রিয়তম ছাত্রের ভবিষ্যৎ ঝরঝরে করার জন্য বশংবদ ছাত্রটিকে দিয়ে পাখার হাওয়া করাচ্ছেন। বিদ্যাসাগরের ধমকের হাওয়ায় পাখা উড়ে গেল এবং নাক-ডাকা বন্ধ হল। যখন-তখন না বলে চলে যাওয়া, দেরি করে আসা এবং তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া— এসব রদ হল। কাঠের টিকিট-পাশ না নিয়ে বাইরে যাওয়া চলবে না (এর থেকেই কি শরৎচন্দ্র ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে থুথু ফেলা, জল খাওয়ার জন্য সময় নির্দিষ্ট করে ‘পাশে’র বন্দোবস্ত করেছিলেন)। আগে থেকে না জানিয়ে কী ছাত্র, কী অধ্যাপক ক্লাস-কামাই করতে পারবেন না। সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগর ‘স্ট্যান্ড-অ্যাট-ইজ’-এর পরিবর্তে সর্বক্ষণের ‘অ্যাটেনসন’-এর বন্দোবস্ত করলেন। বিদ্যাসাগর কি চাকরি পেয়ে সাহেব হয়ে গেলেন নাকি?
(ক্রমশ)
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল