কর্মলাভের যোগ আছে। ব্যবসায় যুক্ত হওয়া যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রশংসা জুটবে। ... বিশদ
বিদ্যাসাগর উপাধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃত কলেজের বিধিবদ্ধ পাঠের সমাপ্তি ঘটে গেল। এই কালের মধ্যে বিদ্যাসাগর মশায় অসুস্থ হয়ে বীরসিংহায় অবস্থান করছিলেন। আর ঠিক এই সময়েই সংস্কৃত কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ছিলেন যে মধুসূদন তর্কালঙ্কার, তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সেরেস্তাদার বা প্রধান পণ্ডিতের পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেটা ছিল আশ্বিন মাস। কার্তিক মাসে মধুসূদন তর্কালঙ্কার মারা গেলেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সেক্রেটারি তখন ছিলেন মার্শেল সাহেব। শূন্যপদে নিযুক্তির জন্যে অনেক প্রার্থী সাহেবের কাছে উমেদারি করতে লাগলেন। বহুবাজারের মলঙ্গা-অঞ্চল নিবাসী কালিদাস দত্ত জনৈক পণ্ডিতের জন্যে সাহেবকে ধরে বসেন। তাতে সাহেব বলে— ‘ঈশ্বরচন্দ্র নামে সংস্কৃত কলেজের এক ছাত্র আছে, আমি মনে মনে তাকেই চাকরিটা দেব বলে ঠিক করে রেখেছি। আমি যখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ছিলাম, তখন থেকেই জেনেছিলাম ঈশ্বরচন্দ্র খুব বুদ্ধিমান আর সংস্কৃতে খুব দখল তার।’ শুনেই কালিদাসবাবু বলেন— ‘এটা খুব ভালো করবেন সাহেব, সে আমার আত্মীয় এবং খুব ভালো প্রার্থী, তাকে চাকরি দিলে আমি খুব খুশি হব।’
এবার সাহেব সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চাননকে ডেকে তাঁর মনের ইচ্ছা জানালেন। কিন্তু ছেলেমানুষ বলে মনে একটা খটকাও লেগে থাকল। তর্কপঞ্চাননকে সে কথা বলেও ফেললেন। শুনে অধ্যাপক মশায় বললেন, ‘ঈশ্বর বাইশ বছর বয়সে সংস্কৃত কলেজের ল-কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। এরপর এক বছর বেদান্ত শ্রেণীতে পড়েছে। তারপরে চার বছর পড়েছে দর্শন শ্রেণীতে— এখন তার বয়স সাতাশ পার হয়েছে।’ তখন সাহেবের খটকা গেল, ভরসা পেয়ে তিনি বিদ্যাসাগরকে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। রাজেন্দ্রনাথ দত্তকে তিনি এ ব্যাপারে বললে, তিনি ঠাকুরদাসকে খবর দেন, ঠাকুরদাস কলকাতা থেকে সোজা বীরসিংহায় এলেন এবং ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় ফিরলেন। বিদ্যাসাগর এসেই মার্শেল সাহেবের কাছে চাকরির দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলেন। মার্শেল সাহেব সেইমতো সরকারকে রিপোর্ট পাঠালেন, বিদ্যাসাগরের চাকরি হয়ে গেল। সবই খুব দ্রুত। ১০ ডিসেম্বর উপাধি পেলেন। অসুস্থ হয়ে বাড়ি গেলেন। মার্শেল খবর পাঠালেন, ঠাকুরদাস বাড়ি গেলেন। ঈশ্বর কলকাতায় এলেন, দরখাস্ত করলেন, সাহেব রিপোর্ট পাঠালেন, নিয়োগপত্র এল এবং ওই ডিসেম্বরেই বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সেরেস্তাদার বা হেড পণ্ডিতের পদে যোগ দিলেন পঞ্চাশ টাকা বেতনে।
যে সমস্ত ইংরেজ এদেশে এসে বিচার বিভাগ বা অন্যান্য প্রশাসনিক কাজে যোগ দিতেন, তাঁদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হয়েছিল। এঁদের বলা হতো সিভিলিয়ান। এঁরা বাংলা, সংস্কৃত এবং হিন্দি তিনটে ভাষাই শিখতেন।
ফোর্ট উইলিয়ামে হিন্দি বিভাগও ছিল। বস্তুত শ্রীরামপুর থেকে এসে উইলিয়াম কেরি যখন এর অধ্যক্ষ হলেন— তখন বাংলা, হিন্দি, সংস্কৃত তিনটি বিভাগেরই তিনি অধ্যক্ষ হন। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে মাস ছয়েক ইংরেজি শিখেছিলেন— তাতে এই ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠতে পারেননি। হিন্দি ভাষাটাও নমো নমো করে জানতেন। তাই সাহেব ডেকে বললেন, ‘ঈশ্বর তোমাকে এ-দুটো ভাষায় একেবারে চোস্ত হতে হবে। যারা পড়বে সেই সিভিলিয়ানদের মাসে মাসে পরীক্ষা নিয়ে সেই কাগজ দেখে ছাত্রদের শেখাটাকে বিচার করতে হবে।’
সেইমতো বিদ্যাসাগর মশায় মাস কয়েক ভোর থেকে সকাল ন’টা পর্যন্ত একজন হিন্দুস্তানি ভদ্রলোককে হিন্দি শেখানোর জন্য নিযুক্ত করলেন। বুদ্ধিমান বিদ্যাসাগর শেখা এবং শেখানো দুটি কাজেই তৎপরতা দেখালেন। ক’বছর পরে তো হিন্দি বই থেকে সরাসরি বাংলায় অনুবাদে কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন তিনি।
হিন্দি শেখার পাশাপাশি ইংরেজি শেখাতেও সময় দিতে লাগলেন। হেয়ার স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষক ইংরেজিবিদ দুর্গাচরণ বাঁড়ুজ্যে মশায় বিদ্যাসাগরের বন্ধু ছিলেন। তাঁর দৌলতে ইংরেজি ভাষাতেও চোস্ত হয়ে উঠলেন ঈশ্বরচন্দ্র। এছাড়াও নীলমাধব মুখোপাধ্যায় অর্থাৎ যিনি বিদ্যাসাগরের ছাত্র ছিলেন, তাঁর দানও এ ক্ষেত্রে কম ছিল না। ছাত্রই তখন গুরুর ভূমিকায়। সুতরাং হিন্দি-ইংরেজি দুটো ভাষাতেই পরীক্ষার খাতা দেখা ঈশ্বরচন্দ্রের জলভাত হয়ে উঠল।
এবার ঈশ্বরচন্দ্র বাবাকে শেষ জীবনটিতে পরিশ্রম থেকে মুক্তি দিলেন। নানা তীর্থভ্রমণে যাওয়ার অবকাশ দিতে বাবাকে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করতে লাগলেন। ঠাকুরদাস প্রথমে রাজি হননি— এঁড়ে বাছুরের বাবা তো! শেষে হাতে-পায়ে ধরায় পুত্রের কথায় সম্মতি দিলেন। তাই শুনে ঠাকুরদাসের মালিক বললেন, ‘এটা কি ঠিক হবে বাঁড়ুজ্যে মশায়। ছেলের হাতের তেলোয় ঢুকে পড়তে চাইছেন। পরে যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় ছেলে?’ ঠাকুরদাস এর উত্তরে বললেন, ‘কী যে বলেন মল্লিক মশায়— আমার ছেলে যুধিষ্ঠিরের মতো ধর্মশীল, আমাকে দেবতার মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করে থাকে। তার কথা আমি ফেলতে পারব না। যদি জানতাম সে অধার্মিক আর দুশ্চরিত্র, তাহলে আপনার কাজ আমি ছেড়ে যেতাম না।’ সত্যিই তাই। ধর্মশীল বিদ্যাসাগরের শ্রেষ্ঠ মূল্যায়ণ করে গিয়েছেন তাঁর পিতৃদেবই। বিদ্যাসাগর প্রত্যেক মাসের শুরুতেই বাবাকে কুড়ি টাকা পাঠিয়ে দিতেন। বাকি তিরিশ টাকায় কষ্টেসৃষ্টে কলকাতার বাসা পরিচালনা করতেন। ক’জনের অন্নসংস্থান করতে হতো জানেন? নিজেরা তিন ভাই, দুই খুড়তুতো ভাই, দুই পিসতুতো ভাই, দুই মাসতুতো ভাই আরও একজন দেশ থেকে নিয়ে আসা পরিচারক রাম। এতজন লোক, আরও একটা বাসাবাড়ি ভাড়া করতে হয়েছিল। তিরিশ টাকায় দশজন— এক-একজনের জন্য বরাদ্দ তিন টাকা। মাসে তিন টাকা, কম নয়। ঠাকুরদাস তো একা দু-টাকা মাইনেতে সংসার চালাতেন। বাপকা বেটা শিপাহিকা ঘোড়া, থোড়া থোড়া তো ছেলেকে হতেই হবে।
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল