কর্মলাভের যোগ আছে। ব্যবসায় যুক্ত হওয়া যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রশংসা জুটবে। ... বিশদ
পর্ব ১০
পড়াশোনা পুরোদমে চলছে। এর মধ্যে বিয়েও হয়ে গিয়েছে দীনময়ী দেবীর সঙ্গে। তাঁর শ্বশুরমশায় শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্য সেকালের এক প্রবাদপুরুষ হয়ে উঠেছিলেন তাঁর শারীরিক শক্তির জন্য। তা নিয়ে কত গল্প গড়ে উঠেছিল। হাতির সঙ্গে লড়াই করতে তিনি ভয় পেতেন না। একবার হাঁটুগেড়ে হামা দেওয়ার ভঙ্গিতে রাস্তায় বসে পড়েন। পাড়ার লোকেরা পিঠে প্রায় দেড়শো কেজি ওজনের ডালের ছালা বসিয়ে দিলে হামা দিয়ে আধ ঘণ্টা ধরে ওই ভারী ছালা বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। দীনময়ী দেবীর কথা আমাদের নানা সুযোগে বলে নিতে হবে। বিয়ে হলেও তাতে ঈশ্বরচন্দ্রের লেখাপড়ায় কোনও ব্যাঘাত হতো না। উনি কলকাতার আর তিনি বীরসিংহায়। বড়বাজারের বাড়ির স্যাঁতসেঁতে ঘরের মেঝেতে শুয়ে ঠান্ডা লেগে অসুস্থ হলে মাঝে মধ্যে দেশের বাড়ি চলে যেতে হতো। তখন হয়তো বালিকাবধূর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হতো। অনেক পরে কলকাতার বাদুড়বাগানে নিজের বাড়ি করলে দীনময়ী দেবী সেখানে বাসা পেয়েছিলেন।
ঈশ্বর পড়ছেন একমনে। বিয়ে হলেও পড়ায় কদাচিৎ অমনোযোগী পুত্রকে ঠাকুরদাস প্রহার করতে ছাড়তেন না। কিন্তু তাঁর মাস্টারমশায়রা তাঁকে ছেলের মতোই ভালোবাসতেন। ঈশ্বরের জন্মের পর নাকি ঠাকুরদা তাঁর জিভে কাঠি দিয়ে কী সব লিখে দিয়েছিলেন। শিক্ষকেরা তাঁর পিতামহের সেই কাণ্ডকারখানার কথা জানতেন। তাই বলতেন— ওই মন্ত্র লেখা থেকেই ঈশ্বরের জিভে মা সরস্বতী বসবাস করেন।
সে যাকগে, ঈশ্বর বছর চারেক দর্শনশাস্ত্র পড়েছিলেন। তাঁর শিক্ষক জয়গোপাল তর্কালঙ্কার বলতেন, ওকে পড়াবার জন্য আমাকে খুব পড়াশোনা করতে হতো। যা জানতাম না, ওকে পড়াতে গিয়ে সেসবও আমার শেখা হয়ে গিয়েছিল। এমন ছাত্র পেয়েছিলাম বলে আমার খুব উপকার হয়েছিল। এ সময় সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি মার্শেল সাহেব কোনও কারণে পদত্যাগ করেন। ছোট আদালতের জজসাহেব রসময় দত্ত সেই পদে যোগ দিলেন। সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি— অথচ রসময়বাবু তেমন সংস্কৃত জানতেনই না। বড় বাড়ির ছেলে তিনি। তারই জোরে বড়কর্তাদের ধরে এই পদ পান। পরে পরে দেখব ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে দত্তমশায়ের সম্পর্ক মোটেই ভালো ছিল না। কে জানে বড়লোক-গরিবের দ্বন্দ্ব কি না, অথবা ইংরেজি-সংস্কৃতের ‘ঝগড়া’ কি না! দত্তজা ছেলেদের সংস্কৃত শ্লোক লিখতে বলতেন। ঈশ্বরচন্দ্র অনেক উৎকৃষ্ট শ্লোক লিখতেন, পরে তার অনেকগুলোই নিজের ‘সংস্কৃত-রচনা’ বইতে ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। কেমন লিখতেন তার একটা প্রমাণ অবশ্য পাঠকদের দিতেই হবে।
কিন্তু ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র কতখানি ভালো ছাত্র ছিলেন, তা আগে জানানোর দরকার। দর্শন শ্রেণীতে যখন তৃতীয় বছরে পড়তেন তখন দর্শনশাস্ত্রের পরীক্ষায় একশো টাকা জলপানি পেলেন। কবিতা লেখার জন্য আরও একশো, হাতের লেখার জন্য পুরস্কার আট টাকা, আইনের পরীক্ষায় একেবারে প্রথম হয়ে পেলেন পঁচিশ টাকা— মোট দুশো তেত্রিশ টাকা— ভাবতে পারা যায়! বাবা জোড়াসাঁকোর রামসুন্দর মল্লিকের অফিসে চাকরি করে আট কি দশ টাকা পেতেন। তীর্থ বেড়িয়ে ফেরার পথে কলকাতা হয়ে বাড়ি ফিরতেন— ঈশ্বর সব টাকা বাবার হাতে তুলে দিতেন সামান্য নিজের জন্য রেখে। ওই রেখে দেওয়া টাকা থেকে তাঁর চেয়েও গরিব ছাত্রদের হাতে তুলে দিতেন, ভবিষ্যতের করুণাসাগরের তো সেইই সূত্রপাত। ছেলেমানুষের এইটুকু বুকের খাঁচা— তাতেই যে গরিব-দুঃখীদের জন্য এতখানা জায়গা কী করে তৈরি হয়েছিল— তা তিনিই জানেন, কে জানে সে জন্যই লোকে বলেন কিনা তা ঈশ্বরই (চন্দ্র) জানেন!
ঈশ্বরচন্দ্রকে খুব ভালোবাসতেন কাব্য-শাস্ত্রের অধ্যাপক জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। একবার তাঁকে দ্বিতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, অষ্টম এবং দশম চরণের মধ্যে ‘গোপালায় নমোহস্তু মে’ পদ দুটি রেখে একটি দশ পঙ্ক্তির কবিতা লিখতে বললে রসিক ছাত্রটি শিক্ষককে জিজ্ঞেস করে বসেন— কোন গোপাল নিয়ে লিখব আমি— সামনে যে (জয়) গোপাল আছেন, না, বৃন্দাবনে যে গোপাল থাকেন— কাকে নিয়ে? প্রসন্ন হাসি হেসে অধ্যাপক বললেন, বৃন্দাবনবিহারীকে নিয়েই লেখ। তিনি লিখলেন—
যশোদানন্দকন্দায় নীলোৎপলদলপ্রিয়ে।
নন্দগোপালবালায় গোপালায় নমোহস্তু মে।। ১
বেণুরক্ষণদক্ষায় কালিন্দীকূলচারিণে।
বেণুবাদনশীলায় গোপালায় নমোহস্তু মে।। ২
ধৃতশীতদুকুলায় বনমালাবিলাসিনে।
গোপস্ত্রীপ্রেমলোলায় গোপালায় নমোহস্তু মে।। ৩
বৃষ্ণিবংশাবতংসায় কংসধ্বংসাবিধায়িনে।
দৈতেয়কুলকালায় গোপালায় নমোহস্তু মে।। ৪
নবনীবৈকচৌরায় চতুর্বগৈকদায়িনে।
জগদ্ভাণ্ডকূলালায় গোপালায় নমোহস্তু মে।। ৫
এই সময়ে বড়বাজারে জগদ্দুর্লভ সিংহের বাড়িটি তাঁদের ছাড়তে হয় বাড়ির মালিকের দোষেই। ঈশ্বরচন্দ্রকে পিতা-ভ্রাতাসহ বহুবাজারের পঞ্চাননতলায় আনন্দচন্দ্র সেনের বাড়িতে উঠে আসতে হয়। সেই বাড়িতেই অন্য ঘরে দেশের দু’জন মানুষও পড়া নিয়ে থাকতেন। ফলে ঈশ্বরচন্দ্রের একা মনে হতো না।
ধীরে ধীরে পড়াশোনার নির্দিষ্ট কাল সমাপ্ত হল। গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজের শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন ঈশ্বরচন্দ্র। কলেজ থেকেই তিনি সম্মানিত দেশপূজ্য ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি পেলেন। অধ্যাপকরা নিরতিশয় আনন্দিত। কেউ বললেন, ‘আমি ধন্য’, কেউবা বললেন, ‘আমার অধ্যাপনা সার্থক।’ অন্যজনের মন্তব্য ‘ঈশ্বর নিশ্চয়ই অসাধারণ শক্তির অধিকারী।’ প্রত্যেক অধ্যাপক আপন আপন পঠনীয় বিষয় সম্পর্কে আলাদা আলাদা প্রশংসাপত্র দিলেন। তারই সমাহার প্রদত্ত-উপাধির শংসাপত্রটি। এই শংসাপত্রে সম্পাদক হিসেবে সই করেছিলেন সম্পাদক রসময় দত্ত। স্বাক্ষরের তারিখ ১০ ডিসেম্বর ১৮৪১ অন্যান্য অধ্যাপকদের স্বাক্ষরের পর। যে শংসাপত্রে ১৮৪১ সালের শেষে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি প্রদত্ত হয়েছিল— তা হুবহু উদ্ধার করছি:
অস্মাভিঃ শ্রীঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরায় প্রশংসাপত্রং দীয়তে। অসৌ কলিকাতায়ং শ্রীযুতকোম্পানীসংস্থাপিতবিদ্যামন্দিরে দ্বাদশ বৎসরান্ পঞ্চমাসাংশ্চোপস্থায়াধোলিখিতশাস্ত্রাণ্যধীতবান্ ।
ব্যাকরণম্.... শ্রীগঙ্গাধর শর্ম্মভিঃ
কাব্যশাস্ত্রম্.... শ্রীজয়গোপাল শর্ম্মভিঃ
অলঙ্কারশাস্ত্রম্.... শ্রীপ্রেমচন্দ্র শর্ম্মভিঃ
বেদান্তশাস্ত্রম্.... শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভিঃ
ন্যায়শাস্ত্রম্.... শ্রীজয়নারায়ণ শর্ম্মভিঃ
জ্যোতিশাস্ত্রম্.... শ্রীযোগধ্যান শর্ম্মভিঃ
ধর্ম্মশাস্ত্রক.... শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভিঃ
সুশীলতয়োপস্থিতস্যৈতস্যৈতেষু শাস্ত্রেষু সমীচীনা ব্যুৎপত্তিরজনিষ্ট। ১৭৬৩ এতচ্ছকাব্দীয় সৌরমার্গশীর্ষম্ বিংশতিদিবসীয়ম্।
(Sd) Rasamoy Dutta, Secretary.
10 Decr. 1841
ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অতঃপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামেই সুপরিচিত হতে থাকলেন— সংক্ষেপে বিদ্যাসাগর। আরও অনেকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিধারী হলেও ‘বিদ্যাসাগর’ বলতে সাধারণত ঈশ্বরচন্দ্রকেই বোঝা শুরু হল।
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল