কর্মলাভের যোগ আছে। ব্যবসায় যুক্ত হওয়া যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রশংসা জুটবে। ... বিশদ
এছাড়াও বেশ কিছু ছবি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতাছাড়া হয়েছে। তারমধ্যে কয়েকটি মন্দ ভাগ্যের দরুন। যেমন— নীহাররঞ্জন গুপ্তর একটি গল্প নিয়ে ছবি করা তাঁর বহুদিনের ইচ্ছে ছিল। কিরীটী রায়ের ভূমিকায় প্রদীপ কুমার, নায়িকা সুচিত্রা সেন। ভানুর এই ছবি করা হয়নি। তাঁকে বাদ দিয়েই অনন্ত সিংহ (ঢাকায় ভানুর পরিচিত বিপ্লবী অনন্ত সিংহ পরবর্তীকালে ছবি তৈরির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন) ছবিটি করেছিলেন। আরও দুটো ছবি নিয়েও তিনি খুব উৎসাহিত হয়েছিলেন। প্রযোজক হেমেন গঙ্গোপাধ্যায় ‘অন্য নগর’ নামে একটি ছবি তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। ছবিটির শ্যুটিং হওয়ার কথা ছিল লন্ডনে এবং অভিনয় করার কথা ছিল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও দিলীপ কুমারের। প্রায় একই সময়ে পরিচালক হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় ‘আনন্দ সংবাদ’ নামে একটি ছবি করার কথা ভেবেছিলেন। এই ছবিতে অভিনয় করার কথা ছিল রাজকাপুর, উত্তমকুমার ও ভানুর। কিন্তু উত্তমকুমার রাজি না হওয়াতে ছবিটা শেষপর্যন্ত হয়নি। পরে এই ছবিটাই হিন্দিতে তৈরি হয়— ‘আনন্দ’। জনি ওয়াকার যে চরিত্রটি করেন, সেই চরিত্রটি ‘আনন্দ সংবাদ’-এ করার কথা ছিল ভানুর।
অন্যের যাতে একটু উপকার হয় তার জন্য নিজের ক্ষতিকেও হাসিমুখে মেনে নিতেন ভানু। পরবর্তীকালে নিজের কেরিয়ার সমস্যায় পড়তে পারে জেনেও পরোয়া করতেন না। কমেডিয়ান সুশীল চক্রবর্তীর ঘটনাটাই তেমন। তখন সুশীল তরুণ কমেডিয়ান। নবদ্বীপ হালদারের কমিক স্কেচের অনুকরণে কলকাতায় বিভিন্ন ফাংশনে বেশ নাম করেছেন। জনপ্রিয় হওয়াতে তাঁর ইচ্ছে হল গ্রামাফোন কোম্পানি থেকে নিজের কমিক স্কেচ রেকর্ড করবেন। সেইমতো কোম্পানিতে গিয়ে তৎকালীন রেকর্ডিং কর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। আশ্বাসবাণীও পেলেন। কিন্তু ওই আশ্বাসই সার। অনুরোধ করতে করতে জুতো খয়ে গেল, কিন্তু রেকর্ডিং আর হয় না। অবশেষে রহস্য উন্মোচন হল। আসলে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমিক স্কেচ এত বিক্রি হচ্ছে যে কোম্পানি আর নতুন শিল্পীর রেকর্ডিংয়ে আগ্রহী নয়। তবে যোগাযোগ রাখলে ভবিষ্যতে কখনও না কখনও রেকর্ডিং হতে পারে এই আশ্বাসও পেলেন। কিন্তু তাতে কী আর স্বপ্নপূরণ হয়! সুশীল বেশ মুষড়েই পড়লেন। কী করবেন ভেবে উঠতে না পেরে একদিন সকাল সকাল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে উপস্থিত হলেন।
অত সকালে সুশীলকে দেখে ভানু অবাকই হলেন। বললেন, ‘কী খবর সুশীল। তোমার মুখখান অমন শুকনা দ্যাখায় ক্যান?’
সুশীলবাবু বললেন,‘আর বলবেন না ভানুদা। আমার কপালটাই খারাপ। গ্রামাফোন কোম্পানি থেকে বোধহয় আমার আর রেকর্ড করা হল না।’
ভানু বললেন, ‘ক্যান? তুমি তো কইছিলা খুব শিগগির তোমার রেকর্ড হইব।’ সুশীলবাবু বললেন,‘ওঁরা তো তাই বলেছিলেন। এখন বলছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো এত জনপ্রিয় শিল্পী থাকতে নতুন শিল্পীর রেকর্ড করতে যাব কোন দুঃখে। যোগাযোগ রাখবেন, পরে দেখা যাবে।’
ভানু বললেন,‘হেই কথা কইছে? একবার টেলিফোনের ডায়ালটা ঘুরা তো?’
ফোন ধরেই গ্রামাফোন কর্তাকে ভানু বলেন,‘শোনেন, আমি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কইতাছি। এবার পুজোয় আপনাগো ওখান থিকা আমি রেকর্ড করুম না। আপনারা জুনিয়র আর্টিস্টদের লগে দুর্ব্যবহার করেন।’ সেই কর্তা এরপর ভানুকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ভানু অনড়। বলেন, ‘রাগের কথা নয়। কিন্তু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের রেকর্ড অ্যাকসেপ্টেড হইতাছে বইল্যা নতুন আর্টিস্টের প্রয়োজন নাই, হেইডা কেমন কথা? ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর দেশ থিক্যা কমেডি উইঠ্যা যাইব নাকি? আমার শর্ত যদি আপনারা মানেন, তবেই পূজায় রেকর্ড করুম। না হলে গুডবাই।’
সুশীলবাবু জিজ্ঞাসা করেন, ‘ব্যাপারটা কী ভালো হল ভানুদা? এর ফলে গ্রামাফোন কোম্পানির সঙ্গে আপনার সম্পর্ক খারাপ হলে তো ক্ষতি আপনারই।’ ভানু হেসে বলেন,‘আমার ক্ষতি করনের ক্ষ্যামতা মাইনষের নাই। আছে একমাত্র ঈশ্বরের।’
শেষপর্যন্ত ভানুর হুমকিতেই কাজ হয়েছিল। সেই প্রথম সুশীল চক্রবর্তীর রেকর্ড প্রকাশিত হয়।
ঠোঁট ফাঁক হলেই ভানুর যেন যুক্তি মজুত থাকত। একবার দূরদর্শন দপ্তরে আড্ডা চলছে। একজন এসে বলল, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ আর একবার করলে কেমন হয়। তখন অন্য একজন বলল, ‘ভানুদা, এরকম বস্তাপচা কাজ এখন আর চলে?’ ভানু সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন,‘বস্তাটা পইচ্যা গ্যাসে। ভিতরের সোনাটা তো আর নষ্ট হয় নাই।’
এরকমই আর একটি ঘটনা। জাতীয় নাট্যশালা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। শম্ভু মিত্র হঠাৎ ভানুকে বললেন,‘আপনি এ ব্যাপারে আবার নাক গলাচ্ছেন কেন?’ সটান উত্তর এল, ‘আমি নাক গলাইতে যামু ক্যান? আপনার নাকের যা অবস্থা, আপনে চেষ্টা করনের আগেই তা গইল্যা যাইবে গিয়া।’
বাড়িতে কিছু না করলে কী হবে, বাইরে ম্যানেজ করতে ওস্তাদ ছিলেন। এলাহাবাদে ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’র আউটডোর শ্যুটিং। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আসছেন শুনে লোকেশনে হামলে পড়েছেন প্রবাসী বাঙালিরা। তিনি তখন স্পটে নেই। যাত্রিক হোটেলে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এদিকে লোকের চাপ এত বাড়ছে যে কিছুতেই কাজ করতে পারছেন না পরিচালক দিলীপ রায়। কাজের দফারফা। শ্যুটিং প্রায় ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম। বিপদ বুঝে ভানুকে আনার জন্য গাড়ি পাঠানো হল হোটেলে। ভানু এসেই নিজস্ব ভঙ্গিতে পরিস্থিতির রাশ হাতে নিয়ে নিলেন। দূরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমারে দ্যাখনের কী আছে কন তো! ইচ্ছা হইলে দ্যাখেন তবে জোড় হাত কইরা কইতাছি, গোলমাল কইরেন না।’ দিব্যি কাজ হয়ে গেল। ওঁর ইমেজটাই ছিল এরকম।
আর এই ইমেজের জন্যই বাড়ির লোকজনকে অনেকসময় অপ্রস্তুতে পড়তে হয়েছে। ওঁর মেয়েকে স্কুলে বন্ধুরা খালি জিজ্ঞাসা করত, ‘হ্যাঁ রে, তোর বাবা সব সময় খুব হাসায়, তাই না?’ মেয়ে এসে বাবাকে সেই কথা বলেন। শুনে ভানু বাসবীকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আজ তরে যে কইসে তার বাবা কী করে?’ মেয়ে বলেন, ‘সার্জেন। মানে ডাক্তার।’ শুনে ভানুর জবাব, ‘অ, তাইলে ওরে কইবি, শোন তর বাপ কি তরে দ্যাখলেই ছুরি-কাঁচি লইয়া প্যাট কাটতে আসে?’
‘মিস প্রিয়ংবদা’ ছবির একটি দৃশ্যে নার্সরূপী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
অনুচিত্রণ: ভাস্কর মুখোপাধ্যায়