ধর্মকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণে মানসিক তৃপ্তি ও সামাজিক সুনাম। পেশাদার শিল্পীদের শুভ সময়। ... বিশদ
ওঁদের অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে বীরেনবাবুর উদাত্ত কণ্ঠে বাংলা ও সংস্কৃত মেশানো চণ্ডীপাঠ নিয়ে বাঙালির যতই নস্টালজিয়া থাক, ইতালি বা স্পেনের ছেলেও যে তা বুঝে আপ্লুত হয়ে যাবে—এমনটা ভাবা একটু বাড়াবাড়ি তো বটেই।
সেবার প্রথম ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করতে গিয়েছি। সেপ্টেম্বর মাস থেকে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে, ফলে পুজোয় বাড়ি আসার সুযোগ নেই। সেই প্রথমবার পুজো থেকে দূরে থাকা। বাড়ি থেকে তো বটেই, এমনকী দেশেরও বাইরে। এসব বহু বছর আগের কথা। ইন্টারনেটের তখন প্রায় বাল্যদশা। ইউটিউব, গুগল, ফেসবুক, অনলাইন স্ট্রিমিং থেকে আমরা তখনও বহু যোজন দূরে। ফলে স্মার্টফোনে অ্যালার্ম দিয়ে ভোরে ঘুম থেকে উঠে পাশ ফিরে ইউটিউবে যে আয়েশ করে বীরেনবাবুকে শুনব—তেমন দিন তখনও আসেনি। তখনও প্রস্তুতি নিতে হতো। মানে ইন্টারনেট খুঁজে কোনও সাইট থেকে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র অডিও ফাইল ডাউনলোড আর কী! তাও আবার ভাইরাসের ভয় এড়িয়ে। উল্টোপাল্টা সাইট থেকে ডাউনলোডের চেষ্টা করলেই বিপদ। দঙ্গল দঙ্গল ভাইরাস এসে হানা দেবে কম্পিউটারে। আপনি ভগবান সাধনার মতো পুণ্য কাজ করছেন বলে ভাইরাস আপনাকে ছেড়ে দেবে না! আর মা দুর্গা ট্যাকটিক্যালি মহিষাসুর নামক দানবকে দমন করলেও, উল্টোপাল্টা সাইটের ভয়ানক ভাইরাস আটকানোর ক্ষমতা তেনারও ছিল না তখনও পর্যন্ত। জানি না, এখন উনি নিজেকে ভাইরাসের ব্যাপারে আপডেট করেছেন কি না! যাই হোক, ভাইরাস এড়িয়ে সেই ফাইল ঠিকমতো সাজিয়ে রাখতে হতো কম্পিউটারে, যাতে ঘুম চোখে চট করে চালিয়ে দেওয়া যায়।
সেদিন হয়েছে কী, ভোরে উঠে আমি চালিয়ে দিয়েছি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বীরেনবাবুর ‘জাগো দেবী’ আকুতি ভরা ডাকে হস্টেলে জেগে উঠেছে দুই বিদেশি। দুই বন্ধুকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম মহালয়ার মাহাত্ম্য। কতটা বুঝল, জানি না। কিন্তু জানাল, বীরেনবাবুর কণ্ঠে কিছু একটা আছে।
মহালয়া চলে গেল। কয়েকদিন পরেই শুরু হবে পুজো। যত দিন এগিয়ে আসতে লাগল, মনকেমন ততই বাড়তে লাগল। ইংল্যান্ডের সর্বদা ঝরে পড়া বৃষ্টি এবং সূর্যদেবের দুষ্প্রাপ্যতা আমাকে তত কাবু করতে পারেনি, যতটা কাবু করে তুলল সেই প্রথমবার পুজোর সময় বাড়ি থেকে দূরে থাকা। আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। প্রায় আশি বছর হতে চলল। আমাদের গ্রামে বহুদিন পর্যন্ত কেবল মাত্র দু’টো পুজো হতো। একটা ঘোষবাড়ির, মানে আমাদের আর একটা বারোয়ারির। এখন ভাবলে হয়তো অবাক হতে হয় যে, আমি কোনওদিন... এই এখনও পর্যন্ত বাড়ি ছাড়া তেমন কোনও পুজো দেখিনি। ওই যে কয়েকবার বাড়ি ফেরা হয়নি, তখন বিদেশে হাতেগোনা কিছু দেখেছি বটে। তাছাড়া নিয়ম করে পুজোয় গ্রামে ফিরতামই। আসলে বাড়ির পুজো মানে শুধু তো পুজো নয়, পরিবারের এক পুনর্মিলন উৎসব। আমাদের ঘোষ পরিবার অনেক বড়। কাকাতো, জ্যাঠতুতো, পিসতুতো, মামাতো ইত্যাদি ইত্যাদি মিলে সে এক জটিল ব্যাপার। সারা বাড়ি গমগম করে পুজোর কয়েকদিন। ওই সময় বাড়ি থেকে বের হওয়ার ফুরসত বা ইচ্ছে কোনওটাই থাকে না।
তখনও ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ করার তেমন কিছু আসেনি। স্কাইপির তখনও বাল্য অবস্থা। বিদেশে আমার কাছে স্কাইপি থাকলেও, আমাদের গ্রামের বাড়িতে তো আর ইন্টারনেট নেই! আর তখন ফোনের কলিং কার্ড ছিল বেশ খরচের ব্যাপার। অন্তত ছাত্রদের কাছে। সপ্তমী গেল, অষ্টমী গেল—রোজ বাড়িতে ল্যান্ডফোনে কথা হয়। ফাঁকে ফাঁকে অনেকে এসে ফোনের কাছে বলে যায়, ‘এ্যাই, তুই এলি না এবারে পুজোয়? তোকে আমরা সবাই খুব মিস করছি!’ সেই শুনে মনটা আরও হু হু করে ওঠে। ঢাকের শব্দ শুনতে ইচ্ছে করে খুব। নবমীর দিন ফোনে কথা হবার সময় বোনকে বলি, ‘একটুখানি ঢাকের শব্দ শোনা না!’ তখন ঠাকুর দালানে সন্ধ্যা-আরতি হচ্ছিল। বোন ফোনে শোনাল ঢাক আর কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ। সন্ধেবেলা বিদেশি বন্ধুরা জিজ্ঞেস করল, ‘কি রে আজ তোকে তেমন হাসিখুশি দেখাচ্ছে না তো! কিছু হয়েছে নাকি?’ আমি ম্লান হাসলাম। নস্টালজিয়া শব্দে প্রকাশ করা বেশ কঠিন ব্যাপার, সে যতই নিজেকে লেখক বলে মনে করি না কেন!
আমার এক খুব কাছের বাঙালি বন্ধু ছিল—আহসান। বাংলাদেশের ছেলে। তাঁর নেটওয়ার্ক প্রচুর। সে আমাকে ‘দাদা’ এবং ‘তুমি’ বলে ডাকত। পরে দেখেছিলাম, বাংলাদেশের ছেলেরা তাঁদের থেকে এক বছরের সিনিয়রদেরও ‘আপনি’ বলে এবং বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে ‘তুমি’। আমি যেমনভাবে অভ্যস্ত ছিলাম, তার তুলনায় ‘তুই’-এর চল কম ছিল। যাই হোক, আমার নস্টালজিয়ায় কাতর হয়ে পড়ার কথা শুনে আহসান বলল, ‘তাহলে দাদা চলো, আশপাশের কোনও একটা দুর্গাপুজো দেখে আসি।’ বললাম, জানিই তো না, কোথায় কাছাকাছি পুজো হয়। আহসানই তখন খুঁজে বের করল যে, বার্মিংহাম সিটি সেন্টার থেকে কিছু দূরে একটা পুজো হয়। তবে ছোট করে। একদিন আমি আর আহসান গেলাম সেখানে। একটি কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করে পুজো হচ্ছে। উদ্যোগ যাঁরা নিয়েছেন, তাঁরা মূলত বাংলাদেশের লোকজন। বেশিরভাগই আবার বিজনেস করেন। আমরা সেই এশিয়ান এবং বাংলাদেশের সুপারমার্কেটে মাছটাছ কিনতে যেতাম। সেখান থেকেই আহসান এই পুজোর খোঁজ পেয়েছিল। এক বউদি দোকান চালাতেন। আমাদের চেনাজানাও হয়ে গিয়েছিল। সেদিন পুজোয় গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি খুব যত্ন করে আমাদের নিয়ে গিয়ে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আরও বললেন, আমি আর আহসান নাকি পড়াশোনায় খুব ব্রিলিয়ান্ট! এতই ব্রিলিয়ান্ট যে খোদ ইংরেজ সরকার আমাদের স্কলারশিপ দিয়ে এখানে পড়াতে এনেছে!
বললে বিশ্বাস করবেন না, কী বিশাল খাতির পেলাম! স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে আসা যে বিশাল কোনও ব্যাপার, তেমনটা কোনওদিন ভাবিনি। কিন্তু দেখলাম, অনেকেই বলছেন—‘তোমরা বাঙালি হয়ে স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে এসেছ, এটা আমাদের গর্ব।’ জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। অনেক বড় বড় জায়গা থেকে, অনেক বিখ্যাত লোকের কাছ থেকে। কিন্তু পুজো দেখতে গিয়ে এহেন স্বীকৃতিতে চোখের কোণটা সেদিন যেমনভাবে চিকচিক করে উঠেছিল, তেমনটা আর কোনওদিন হয়নি। পরে জেনেছিলাম, এঁরা অনেকেই নানা কারণে খুব বেশি উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাননি। ইংল্যান্ডে চলে এসেছিলেন ভাগ্যসন্ধানে। বেশিরভাগই ব্যবসা করেন এখানে। তাই নিজেদের অপ্রাপ্তি, সেই উচ্চশিক্ষার প্রতি এক সম্ভ্রম এখনও কাজ করে মনে। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা। সবার ডোনেশনই সেই পুজো হয়। আমি আর আহসান জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমরাও কিছু কন্ট্রিবিউট করতে চাই, কীভাবে করব?’ হইহই করে উঠলেন তাঁরা। বললেন, ‘কী যে বল! তোমরা এখানে এলে আমরা কত খুশি হলাম। তোমরা তো ছাত্র। তোমাদের কাছ থেকে কি টাকা নেব!’ মেয়েরা আমাদের ডেকে যত্ন করে একদম হেঁসেলের পাশে বসিয়ে খাওয়ালেন। এতদিন বিদেশে বসবাস করেছি। এর থেকে বেশি আন্তরিক পুজো আমি আর কোনওদিন দেখিনি।
পুজো মানেই কি তাহলে স্মৃতিজুড়ে আনন্দের অনুভূতি? অন্য কোনও অনুভব নেই? বিলকুল আছে। আসলে দুর্গাপুজোর সঙ্গে যে ভয় নামক অনুভূতিও লেপ্টে যেতে পারে, তা র্যাঙ্ক পাল্টানোর আগে বুঝতে পারিনি! র্যাঙ্ক পাল্টানো মানে ‘বিবাহ’ নামক বন্ধনে জড়িয়ে যাওয়ার আগে ও পরের কথা বলছি আর কী। বিয়ের আগে কলকাতার বড়বাজারের দিকে পুজোর সময় যেতাম পারিবারিক দশকর্মার দোকানের ব্যবসার জন্য সন্ধিপুজোর জিনিসপত্র—যেমন, সাত সমুদ্রের জল, ধুনো ইত্যাদি কেনার জন্য। কিন্তু বিয়ের পর যাওয়া-আসা শুরু হল সোনার গয়না কেনার জন্য! অন্তত যতদিন পর্যন্ত না বউয়ের প্রিয় গয়নার দোকানটি গড়িয়াহাটের দিকে ব্রাঞ্চ খুলল। ভাগ্যিস তখন আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো গভীর রাতের দিকে ল্যান্ড করত কলকাতায়। তা না হলে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সোজা সোনার দোকান যেতে হতো বলেই আমার বিশ্বাস!
বিয়ের পর পুজো এগিয়ে এলেই টেনশন চলে আসত। গয়না কেনার প্রস্তাব ওঠে সাধারণত রাতের দিকে। আগে আমার উচ্চরক্তপাত জনিত কোনও সমস্যা ছিল না। গয়না কেনার বিষয়ে চাপা টেনশন থেকেই প্রেশার বাড়তে শুরু করে হাল্কা করে। গয়না কেনার প্রস্তাবের উত্তরে যদি বলতাম, ‘গয়না কেনার কী দরকার আছে এবার!’ প্রতিবারই এক উত্তর আসত—‘কী যে বল! খালি হাতে যাব নাকি বাড়ির পুজোয়? তাছাড়া গ্রামে তোমার মানসম্মানের একটা ব্যাপার আছে না! আমি খালি হাতে গেলে লোকে কি বলবে!’ এক্ষেত্রে, ‘খালি হাতের’ সংজ্ঞায় গতবার পর্যন্ত কেনা গয়নাগুলি ধরা হতো না। যতই বলি, ‘গ্রামে আমার এমনিতেই কোন মানসম্মান নেই! যে জিনিস শূন্য, সেই জিনিস আর কি করে কমবে!’ অঙ্কের ছাত্রী স্ত্রী আমার ভুল ধরিয়ে ঋণাত্মক সংখ্যার কনসেপ্ট মনে করিয়ে দিত!
এরপরে ধরুন একটা দার্শনিক টাইপের প্রশ্ন করে ফেললাম, ‘আচ্ছা, কী হয় এই প্রতিবার সোনার গয়না কিনে? আর তাছাড়া আমাকে জিজ্ঞেস করেই কী হবে! নিজের উপার্জনের টাকায় কিনছো তো।’ উত্তরও রেডি থাকত... সেটাও প্রতিবার একই, ‘আরে আমি নিজের জন্য গয়না কিনছি নাকি? এটা তো আমাদের ইনভেস্টমেন্ট!’ সোনার বাট বা সোনার বিস্কুট কিনে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাপারটা তবুও মানা যায়। কিন্তু ‘সোনার গয়না’ কিনে ইনভেস্টমেন্টের মতো ধোঁয়াটে কনসেপ্ট খুব একটা মার্কেটে নেই। আচ্ছা, আর একটা কথা! যাঁরা বলেন যে, কলিকাল এসে গিয়েছে – আজকাল আর শাপ দেওয়া, চোখের দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দেওয়া ইত্যাদি ট্রাডিশন্যাল জিনিসগুলো কাজ করে না, তাঁরা একটা জিনিস ট্রাই করতে পারেন। বউকে একবার বলতে পারেন, ‘আচ্ছা সোনার দাম তো বেড়ে গেছে। কিনেছিলে তো ইনভেস্টমেন্ট বলে, তা লকার থেকে বের করে দাও না, বিক্রি করে দিই।’ বলার পর বউয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখবেন। টের পাবেন যে, প্রাচীন অনেক জিনিস কলিকালে অবলুপ্ত হলেও চোখের দৃষ্টি নিক্ষেপে ভস্ম করে দেওয়ার ব্যাপারটা এখনো টিকে আছে।
পরিশেষ আর একটা ব্যাপার—পুজো মানেই কি সব কিছু গহনা কেনার মতো পুনরাবৃত্তি? প্রথমবারের মতো কিছুই কি দেখিনি মাঝেসাঝে? সেবারে ফ্রাঙ্কফার্ট এয়ারপোর্টে বসে আছি পুজোর ঠিক আগে, বাড়ি ফেরার ফ্লাইট ধরব বলে। ততদিনে ইউরোপ থেকে কলকাতার ডিরেক্ট ফ্লাইট ওই একটাতেই দাঁড়িয়েছে। অনেকেই আমেরিকা থেকে ফেরেন, তাঁরা এখানে ফ্লাইটে চেঞ্জ করেন। আমার পাশে এক একটু বয়স্ক ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা বসেছিলেন। তাঁরা বাঙালি। কথা শুনে বুঝতে পারলাম আমেরিকায় ছেলের কাছে ঘুরে ফিরছেন। ফ্লাইট একটু লেট ছিল। ভদ্রলোক বারবার উঠে কাউন্টারে গিয়ে হালচাল জিজ্ঞেস করছিলেন। লক্ষ করলাম যে, উনি গলায় টাই পরে আছেন। এত ঘণ্টা প্লেন জার্নিতে খামোকা কেউ টাই পরে থাকবে কেন, বুঝতে পারলাম না। থাকতে না পেরে একসময় জিজ্ঞেস করেই বসলাম, ‘আচ্ছা কাকু, কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। আপনি টাই পরে আছেন কেন?’
উনি উত্তর দিলেন, ‘পুজোয় বাড়ি ফিরছি তো, তাই আর কী!’
দুর্গাপুজোর সঙ্গে টাইয়ের কী সম্পর্ক সেটা আর সেদিন কাকুকে জিজ্ঞেস করা হয়নি! ব্যাপারটা অজানাই থেকে গিয়েছে আমার কাছে, এই এখনও।