ধর্মকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণে মানসিক তৃপ্তি ও সামাজিক সুনাম। পেশাদার শিল্পীদের শুভ সময়। ... বিশদ
আজ? আমাদের চিন্তা শুধু স্বার্থের জালে নিজেদের আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলা। সবার প্রশ্ন তো একটাই—দিনের শেষে কী পাব? জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, ধ্যানযোগ বা কর্মযোগ নয়। একমাত্র প্রাপ্তিযোগ। আগে ওই হিসেবটা করে নিতে হবে। প্রথমেই অবশ্য আসল দাবিটা জানানো যাবে না। একটা মুখোশ সে জন্য সব সময় রেডি রাখতে হবে। বৃহত্তর স্বার্থ জাতীয় কিছু আর কী। যা দেখে স্বার্থপর দুনিয়ার বিবেক নাড়া দিয়ে উঠবে। সে ভাববে, আহা, এতো সবার স্বার্থ ভাবছে! ধীরে ধীরে চাহিদা নির্দিষ্ট হবে। তখন আর সমষ্টি নয়, শুধুই ব্যক্তি। ততদিনে জমিটা তৈরি হয়ে গিয়েছে। এই প্রবণতা যুগে যুগে চলে এসেছে। গণতন্ত্র হোক বা স্বৈরতন্ত্র, কলিকালের এই অভ্যাস বদলানোর নয়। এতে কি সমাজের কোনও উন্নতি হয়? কোনও বদল? না, হয় না। তবে রাজনীতি হয় বিস্তর। আমি, আমার ঘর-সংসার, সন্তান, ভবিষ্যৎ... ভাবতে তো হবেই। তাই তো মানুষ সামাজিক জীব। এটা স্বার্থচিন্তা। কিন্তু নিজের উন্নতির জন্য অন্যের পথে কাঁটা ছড়াতে হয়, তাহলে তা মনুষ্যত্ব নয়। স্বার্থপরতা আর পরশ্রীকাতরতার অদ্ভুত মিশ্রণ।
এটাই অশুভ, যা সমাজের অন্দরমহলকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। আমরা কিন্তু চিহ্নিত করতে পারছি সেই অশুভ শক্তিকে। কিন্তু দমন করছি না। উল্টে সযত্নে তারই লালন পালন চালিয়ে যাচ্ছি। আর তাই দু’টি বিষয় আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে—সচেতনতা, সঠিক শিক্ষা। চারটে বই পড়লে বা দুটো ডিগ্রি জোগাড় করলেই শিক্ষা মেলে না। শিক্ষিত আমরা তখনই, যখন নিজেদের শুভ এবং অশুভের ফারাক করতে পারব। পরবর্তী প্রজন্মকে শেখাতে পারব স্বার্থচিন্তা ও স্বার্থপরতার তফাৎ। চেনাতে পারব অশুভ শক্তিকে। শ্রীবিষ্ণুর কানের মল থেকে জন্ম হয়েছিল মধু ও কৈটভের। দুই দৈত্য। শ্রীবিষ্ণু তখন যোগনিদ্রায়। দীর্ঘ সময় তপস্যার পর দেবীর বর পেয়েছিল তারা। সুরাসুর কেউ তাদের বধ করতে পারবে না। তারপরই শুরু হয়েছিল মধুকৈটভের উৎপাত। এমনকী স্বয়ং ব্রহ্মাকে হত্যা করতে উঠেপড়ে লেগেছিল তারা। আতঙ্কিত ব্রহ্মা চেষ্টা করেছিলেন স্তব করে শ্রীবিষ্ণুর যোগনিদ্রা ভাঙাতে। কিন্তু পারেননি। তখন তিনি শুরু করেছিলেন মহামায়ার আরাধনা। কারণ, যে যোগনিদ্রা নারায়ণকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল, তিনি দেবী স্বয়ং।
খড়্গিনী শূলিনী ঘোরা গদিনী চক্রিনী তথা।
শঙ্খিনী চাপিনী বাণভূসণ্ডীপরিঘায়ুধা।।
আপনি খড়্গধারিণী, ত্রিশূল শোভা পায় আপনার হাতে। এক হাতে নরশির... আপনি ভয়ঙ্করী। গদাধারিণী, চক্রধারিণী, শঙ্খধারিণী, ধনুর্ধারিণী এবং বাণ, ভূশণ্ডী (পুরাণের সেই ত্রিকালদর্শী কাক) ও পরিঘাস্ত্রধারিণী (মুগুরের মতো প্রাচীন অস্ত্র)। এসেছিলেন মহামায়া। ভুবনমোহিনী রূপে দেখা দিয়ে বাধ্য করেছিলেন মধুকৈটভকে শ্রীবিষ্ণুর সামনে নতশির হতে। বধ্য হতে। কী পরিচয় ছিল মধু ও কৈটভের? শুধুই দুই অসুর? কে ছিল মহিষাসুর? বুঝতে হবে... আজকের যুগে দাঁড়িয়ে এরা স্রেফ প্রতীক। অশুভের। সামাজিক অবক্ষয়ের। তারা জানান দিচ্ছে, অজেয় কেউ নয়। অমর কেউ নয়। অহঙ্কার এবং লোভের পথে হাঁটলে গন্তব্য শুধুমাত্র পতনে। আজ না হোক কাল, পতন হবেই। বিচার মিলবেই। শুধু সময় দিতে হবে। ধৈর্য ধরতে হবে। দার্শনিক প্লেটো ‘রিপাবলিক’-এ ‘ট্রু ফলসহুড’ সম্পর্কে লিখেছিলেন। কোনও মিথ্যা যদি মানুষের মনে অভেদ্য হয়ে বসে যায়, সত্যিটাকে সে আর দেখতে পায় না। মনে মনে সে তখন একটা যুক্তি তৈরি করে নেয়। পারিপার্শ্বিক প্রমাণ বা তথ্য যদি সেই যুক্তির বিরুদ্ধে যায়, তাহলে তাকে মিথ্যা হিসেবেই মনে করে সেই ব্যক্তি। দোষী বলে যাকে মেনে নেয়, সে সাজা না পেলে ভেবে বসে, ন্যায়বিচার হয়নি। অশুভ যে এটাও! মিথ্যার কারাগারে বন্দি হয়ে পড়েছে আমাদের মনন। কারণ, সময় বদলেছে। অশুভের চরিত্র বদলায়নি। মিথ্যাকে নানা সূত্র থেকে সত্যি বলে চালানোর অপপ্রচার, ফেক নিউজ সমাজের কাঁধে পাহাড়প্রমাণ বোঝা হিসেবে চেপে বসেছে। প্রতিদিন আরও শক্তিশালী হচ্ছে অশুভ শক্তি। জনসংখ্যা আরও বাড়বে, পৃথিবীর বুকে জমে থাকা রিসোর্স কমবে, আর সেইসঙ্গে শিখর ছোঁবে প্রতিযোগিতা। বেঁচে থাকার। আদিম প্রবৃত্তি আরও বেআব্রু হবে। মনুষ্যত্ব ফিকে হবে প্রতি মুহূর্তে। এটাও কি অশুভ নয়?
অথচ অশুভের বিনাশ করতেই বারেবারে আবির্ভূতা হয়েছেন মহামায়া। পুজো হয়তো আমাদের কাছে একটা উৎসব। আনন্দ। অপেক্ষার চারটে দিন। বছরভরের চাপ থেকে মুক্তির। খানিক বেশি উপার্জনের। কিন্তু দুর্গাপুজো একটা অভ্যাসও। পাড়ার মণ্ডপের পাশের গাছে বাঁধা মাইকে ভেসে আসা চণ্ডীস্তোত্র... মনে করিয়ে দেওয়া, শিকড় ভুললে চলবে না। কর্মকে ভুলে যাওয়া যাবে না। সর্বভূতে বিলীন ‘মা’কে অস্বীকার করা যাবে না। দুর্গাপুজো মানে অশুভের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়েরও। মহামায়ার আরাধনা শুধুই ‘রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি’ নয়। দেবী রূপ, জয়, যশ দেবেন। শত্রুরও বিনাশ ঘটাবেন। কিন্তু কর্ম ও দুষ্কর্মের ভার নিক্তি দিয়ে মেপে। সেখানে স্বার্থসিদ্ধি একমাত্র লক্ষ্য হবে না। তিনি মাকে দেখেছেন... শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুর বলেছিলেন নরেনকে। ‘ঠিক যেভাবে তোকে দেখছি’। আজ আমরা কি দেখতে পাই তাঁকে? অনুভব করতে পারি? না, পারি না। কারণ, এখন আমাদের কাছে সমষ্টির থেকে স্বার্থ বড়। নিবৃত্তির থেকে প্রবৃত্তি বড়। খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ... বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। কারা এরা? কেমন অপরাধী? কোনও রাজনৈতিক দলের? বিকারগ্রস্ত? সমাজের বাইরের কেউ? প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তরই কিন্তু ‘না’। এরা কেউ দাদা, প্রতিবেশী কাকু, কিংবা সহকর্মী। আমরা মিছিল করছি, অবস্থানে বসছি, স্লোগান তুলছি... কিন্তু আমাদের ঘরের ভিতর অন্ধকার কোণ তৈরি করে বসে থাকা অপরাধের বীজটাকে হত্যা করছি না। মা, বোন, স্ত্রী হয়ে শিক্ষা দিচ্ছি না বাড়ির পুরুষকে। যখন সে ঘৃণ্য চোখে পাশের বাড়ির সদ্য কিশোরী মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছে, সপাটে তার গালে একটা চড় মারছি না। তখন আমরা চিন্তা করছি ‘সম্মানে’র। ‘ক্লাসে’র। হাতে ধরে থাকা মিহি বালির মতো ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছে প্রকৃত শিক্ষা। থেকে যাচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়। অশুভশক্তি। এরপরও ন্যায়বিচারের আশা করব আমরা? আসলে আমরা ভুলে যাই, ঠাকুরের সামনে বসে প্রণাম করলেই তিনি দর্শন দেবেন না। অপরাধীদের শাস্তি দিতে অস্ত্রও তুলে নেবেন না। ওই কাজটা আমাদেরই করতে হবে। সমাজকে করতে হবে। শেখাতে হবে বাড়ির মেয়েকে... সাহসী হতে। আর ছেলেকেও... সম্মান করতে। এইটুকুতেই তো লুকিয়ে আছে অশুভ শক্তির দমন। পুজো মণ্ডপে বসে মন দিয়ে শুনতে হবে প্রতিটি মন্ত্র। স্তোস্ত্র। চিনতে হবে শুভকে। অশুভকেও। নিতে হবে সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা থেকে মুক্তির শপথ। শ্রীচণ্ডী স্তবেই তো আছে, ‘অহংকারং মনো বুদ্ধিং রক্ষেন্মে ধর্মধারিণী।’ অর্থাৎ, দেবী... আমার অহংকার, মন ও বুদ্ধি রক্ষা করুন। অহঙ্কারের অর্থ এখানে আত্মসম্মান, মন হল মনুষ্যত্ব, আর বুদ্ধি সঠিক ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।।