পারিবারিক ঝামেলার সন্তোষজনক নিষ্পত্তি। প্রেম-প্রণয়ে শুভ। অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষে মানসিক চাপ বৃদ্ধি। প্রতিকার: আজ দই খেয়ে ... বিশদ
১৯১০ সাল। বরোদার গায়কোয়াড় রাজবংশের রাজকুমারী ইন্দিরার বয়স ১৮। গায়কোয়াড়ের মহারাজা সোয়াজিরাও একবার শুধু মেয়েকে জানিয়েছেন যে তোমার বিবাহের ব্যবস্থা হচ্ছে। তৈরি থেকো। সেদিন রাতে মাকে ইন্দিরা প্রশ্ন করেছিলেন, মা, পাত্র কে? কার সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে? মা স্থির চোখে তাকিয়ে বলেছিলেন, গোয়ালিয়রের মহারাজ। সিন্ধিয়া। মানে? ইন্দিরা স্তব্ধ। সিন্ধিয়া? তিনি তো বিবাহিত বলেই জানি। আর বয়স অন্তত ৪০। তা সত্ত্বেও তাঁকে বিবাহ করতে হবে? কেন? মা বললেন, খুব স্বাভাবিক। গায়কোয়াড়দের সঙ্গে স্ট্যাটাসে একমাত্র সিন্ধিয়ারাই স্বজাতি। ওঁরাও মারাঠা। এই সম্বন্ধ রাজযোটক। আমরা জ্যোতিষী দেখিয়ে নিয়েছি। এসব করার আগে আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করা হল না? মহারানি চিন্নাবাঈ ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে আর কথা বলেননি। সিন্ধিয়ার প্রথম পক্ষের বিয়েতে কোনও সন্তান নেই। তাই তিনি আপাতত মরিয়া এক উত্তরাধিকারের জন্য। ইন্দিরার প্রকৃত আশঙ্কা অন্য। সে নিশ্চিত একবার সিন্ধিয়া পরিবারে প্রবেশ করলে তাঁকে আজীবন পর্দার আড়ালে চলে যেতে হবে। বরোদা রাজবংশে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিকে ধরে রাখার একটি কঠোর রীতি রয়েই গিয়েছে। তবুও সিন্ধিয়াদের থেকে বরোদা অনেকটাই আধুনিক আর লিবার্যাল বলাই যায়। তাই ইন্দিরার কিছুতেই এ বিয়েতে সায় নেই। কী করবে সে? মুক্তির বাতাস নিয়ে এলেন পঞ্চম জর্জ। ব্রিটিশ সম্রাট। কলকাতা থেকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী সরে এসেছে দিল্লি। সেখানে হাজির হবেন পঞ্চম জর্জ। আর তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে প্রতিটি দেশীয় রাজ্যের রাজাকে পারিতোষিকসহ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করতে হবে ব্রিটিশদের সঙ্গে তাঁদের মৈত্রী। সেই উপলক্ষে আয়োজিত হয়েছে দিল্লি দরবার। মহারাজ সোয়াজিরাও গোটা পরিবার নিয়েই হাজির। তাঁর যখন ডাক পড়ল, তিনি যথারীতি অভিবাদন করলেন। সম্রাটের দিকে মুখ করেই পিছিয়েও এলেন। কিন্তু কতটা পিছনে যেতে হবে? তাঁকে গাইড না করলে বুঝতে পারছেন না। অতএব মহারাজা পিছনে তাকালেন যে ঠিক কোন জায়গা পর্যন্ত বর্ডারলাইন। সেখানে থেকে অ্যাবাউট টার্ন করে আবার নিজের আসনে গিয়ে বসা। ব্যস! ওই যে নির্দিষ্ট স্থানের আগেই কেন তিনি মুখ ফেরালেন পিছন দিকে? ওটাই সম্রাটের প্রতি আনুগত্যহীনতা। সভাঘরে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। ব্রিটিশদের চোখে বরোদার মহারাজা গায়কোয়াড় হয়ে পড়লেন বিদ্রোহী। এবং অন্যদিকে তাবৎ জাতীয়তাবাদী সংগঠন আর স্বাধীনতাকামী জনতার চোখে তিনি হয়ে গেলেন হিরো। কিন্তু এই রাজনীতি আর কূটনীতির আড়ালে সকলের অলক্ষ্যে জন্ম নিচ্ছিল একটি রোমান্টিক রূপকথা। লন্ডনের ইস্টবোর্নের স্কুলে পড়া ইন্দিরার সহপাঠিনী ছিল দুটি বোন। তাঁরা কোচবিহারের মহারাজার বোন। দিল্লি দরবারে এসেছে তারাও। বড়দের সঙ্গে আর কতক্ষণ ভালো লাগে। অতএব তারা নিজেরা মেতে রইল গল্পে আর দিল্লিভ্রমণে। তারা বলল, আমাদের বাড়িতে একদিন এসো। দিল্লিতে প্রায় সব দেশীয় রাজন্যদেরই প্রাসাদ রয়েছে। কোচবিহার রাজের ভবনে এসে ইন্দিরা বেশ লাগল। সংস্কৃতি আলাদা। কিন্তু গোটা ঘরে সুরুচির ছাপ। ঠিক সেই সময় এক ঝকঝকে যুবক প্রবেশ করল দ্রুত। সে ঢুকে এক অচেনা ভাষায় বোনেদের উদ্দেশ্য করে বলল, আমার ক্রিকেট কিট কোথায় রেখেছিস? প্রশ্নটা করেই সেই যুবক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। তার সামনে এক অপরূপা নারী। আর সেই নারীও চিত্রার্পিতের মতো স্তব্ধ। দুজনের চোখ দুজনের চোখে নিবদ্ধ। এটা হল লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট! এই হল কোচবিহারের মহারাজের ছোটভাই জিতেন্দ্রনারায়ণ।
ঠিক ১৩ দিন পর বরোদায় ফিরে এসে রাজুকমারী ইন্দিরা এক ভয়ংকর কাজ করল গোপনে। সোজাসুজি মহারাজা সিন্ধিয়াকে একটি চিঠি লিখল, আমি আপনাকে বিয়ে করতে অপারগ। ক্ষমা করবেন। এবং সেই চিঠি পেয়েই মহারাজা সিন্ধিয়া ঠিক একটি বাক্যের একটি পাল্টা চিঠি লিখেছেন মহারাজ গায়কোয়াড়কে-‘রাজুকমারীর ওই চিঠির অর্থ কী?’ কোন চিঠি? মহারাজ গায়কোয়াড় তো জানেনই না কিছু। তিনি অগ্নিশর্মা। সেই ছোট চিঠি মহারানি চিন্নাবাঈ হাতে নিয়ে ঢুকেছিলেন জেনানা মহলে। ইন্দিরা স্বীকার করলেন তিনি চিঠি লিখে বিয়ে নাকচ করেছেন। মহারানি আর মহারাজা সোয়াজিরাও স্তব্ধ। এও সম্ভব! এত সাহস! তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হল। কারও সঙ্গেই দেখা করতে দেওয়া হবে না। পাঠিয়ে দেওয়া হল লন্ডনে। সকলের চোখের আড়ালে। এসব মোহ কেটে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। জানেন মহারাজা গায়কোয়াড়। কিন্তু অকস্মাৎ ইন্দিরাকে সবথেকে বড় উপকার করলেন আর কেউ নয়, স্বয়ং গোয়ালিয়রের মহারাজা সিন্ধিয়া। তিনি বরোদায় চিঠি লিখে জানালেন, রাজকুমারীর সামান্য অনিচ্ছাতেও এই বিবাহ হতে পারে না। তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আমি স্বেচ্ছায় এই বিয়ে থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি। সেই খবর লন্ডনে গেল। ইন্দিরাকে কাছে টেনে মা চিন্নাবাঈ বললেন, তোকে তো জোর করা হবে না আর। এবার অন্তত একটু হেসে কথা বল। ইন্দিরা ম্লানভাবে হাসল। বলল, মা, আমি কোচবিহারের মেজকুমারকে বিয়ে করব। চিন্নাবাঈয়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যেন। একটা থাপ্পড় মারলেন ইন্দিরার গালে। বরোদার তুলনায় কোচবিহার রাজত্বের স্ট্যাটাস যে কম, এটা কোনও প্রধান কারণ নয় আপত্তির। বরোদার মহারাজ আর মহারানির আপত্তি হল কোচবিহারের রাজবংশ সম্পূর্ণ অন্য জাতির। কাস্ট আলাদা। কোচবিহার রাজপরিবার বড় বেশি পশ্চিমী সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা অতি আধুনিক। আদব কায়দা সবই ব্রিটিশদের ধাঁচে। এই বিয়ে হতেই পারে না। দু’বছর ধরে মেয়েকে লন্ডনে রেখে দেওয়া হল। কিন্তু মেজকুমারকে কি আটকানো গেল? মোটেই নয়। অদ্ভূত অদ্ভূত চিঠির আদানপ্রদান। উটির কোনও এক মিসেস মিলি ব্রুক চিঠি দিচ্ছে ইন্দিরাকে। ইন্দিরার চিঠি যাচ্ছে ডালহৌসির মিস ফার্নহিলের কাছে। সকলেই বন্ধু। আসলে সব ছদ্মনাম। এসব ঘুরপথে চিঠি যাচ্ছে মেজকুমার জিতেন্দ্রর কাছে। আর আসছেও তাঁর থেকেই। অতএব গোপন ভালোবাসা ঠেকিয়ে রাখা গেল না। সব আপত্তি ভেসে গেল। একটা সময় মহারানি খবর পেলেন শেষ পর্যন্ত মেয়ে পালিয়েও যেতে পারে। সে তো সাংঘাতিক স্ক্যান্ডাল! অতএব রাজি হওয়া ছাড়া উপায় নেই। ১৯১৩ সালে লন্ডনে মিস টোটেনহ্যামের সাক্ষ্যে বিয়ে হল কোচবিহারের মেজকুমারের সঙ্গে বরোদার রাজকন্যার। গোটা ভারত স্তম্ভিত! কারণ বরোদার মহারাজা এই বিয়েতে অংশ নিলেন না। প্রাসাদে কোনও অনুষ্ঠানও হল না। আর সর্বোপরি এই মেজকুমার কখনও সিংহাসনে বসতে পারবেন না। কিন্তু নিয়তি অলক্ষ্যে বিষাদের হাসি হেসেছিলেন। কারণ মেজকুমারের দাদা মহারাজ রাজেন্দ্রনারায়ণ ভালোবাসলেন এক ব্রিটিশ অভিনেত্রীকে। এডনা মে। তাঁকে বিয়ে করতে মরিয়া মহারাজ। কিন্তু পরিবার রাজি নয়। রাজা কিছুই বললেন না। তিনি জানিয়ে দিলেন আমি নিজেকে তাহলে তিলে তিলে শেষ করে দেব। এবং সত্যিই তাই অবিরত মদ্যপানে তিনি প্রবল অসুস্থ। মেজকুমার জিতেন্দ্রনারায়ণ আর ইন্দিরার বিবাহের তিন সপ্তাহ পর কোচবিহারের মহারাজার মৃত্যু হল। ইউরোপে হানিমুন চলছিল মেজকুমারের। জলদি তলব। কোচবিহারে। নতুন মহারাজা হলেন জিতেন্দ্রনারায়ণ। আর ঠিক ৬ বছর পর সবেমাত্র সমাপ্ত হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। মহারাজা জিতেন্দ্রনারায়ণ তাঁর পরিবার নিয়ে বেড়াতে গেলেন ইউরোপ। চার সন্তান। মহারানি ইন্দিরা দেবী আবার গর্ভবতী। ১৯১৯ সালের ২৩ মে লন্ডনে জন্ম হল এক কন্যার। গর্ভবতী অবস্থায় মহারানি ইন্দিরা দেবী পড়ছিলেন রাইডার হ্যাগার্ডের একটি বই, ‘SHE’। সেই বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম আয়েশা। সে এতই প্রিয় ছিল ইন্দিরার যে মেয়ের নাম দিলেন আয়েশা। কিন্তু আত্মীয়পরিজন আঁতকে উঠলেন। আরে, এটা তো মুসলিম নাম। কোচবিহারের রাজপুরোহিত আর অন্য ব্রাহ্মণরা জানালেন, এই মেয়ের নাম ‘গ’ দিয়ে রাখতে হবে। অতএব নতুন রাজকন্যার নাম হল গায়ত্রী।
রাজা জিতেন্দ্রনারায়ণের ঠিকুজিতে বলা ছিল যদি তিনি ৩৬ বছর বয়স পেরিয়ে যান, তাহলে তাঁর ভাগ্য হবে অতি সুপ্রসন্ন। তিনি হবেন দীর্ঘজীবী ও অসীম সম্পদ ও ক্ষমতাশালী। ৩৬ বছর জন্মদিন আসার একমাস আগে তাঁর হঠাৎ নিউমোনিয়া ধরা পড়ল। মহারাজা শয্যাশায়ী। লন্ডনে চিকিৎসা হচ্ছে। ২০ ডিসেম্বর, ১৯২২। ৩৬তম জন্মদিন। মহারাজা জিতেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু হল। কোচবিহারের মহারানি ইন্দিরা দেবী ৩০ বছর বয়সে স্বামীহারা হলেন। পাঁচ সন্তান নিয়ে। ১৮৯৬ সালে একবার ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় কোচবিহার শহরের। কিন্তু তারপর ফের গড়ে তোলা হয়েছে একটু একটু করে। ওই যে মনোরম সবুজ গালিচা পেরিয়ে প্রসাদের অলিন্দে ঝুলছে ওয়াল হ্যাংগিং। ম্যুরাল আর কার্পেটের রঙের অদ্ভুত সাযুজ্য। অভ্যাগতদের বসার আসনে যে বোলস্টার দেওয়া হবে। ড্রইং রুমে টেবিল এসেছে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্স থেকে। ইতালি থেকে ফেব্রিকস। কাশ্মীরের সিল্ক হ্যাংগিং। বেলজিয়ামের রোজ কোয়ার্টজ গ্লাস। ইন্দিরা দেবীর রুচির ছাপ সর্বত্র। নিজে কতটা ফ্যাশন সচেতন? একটা ছোট তথ্য। তাঁর জুতো আসতো ফ্লোরেন্সের ফেরাগোমা থেকে।
আচমকা একদিন হইচই। প্রজারা ছুটে এসেছে। আর বাঁচার পথ নেই। একটা বাঘ গ্রামে গ্রামে অত্যাচার চালাচ্ছে। আমাদের বাঁচান যুবরাজ। যুবরাজ হলেন গায়ত্রীর বড়দাদা। রাজুকমার জগদীন্দ্রনারায়ণ। কিন্তু সে নেই। স্কুলে। অতএব গায়ত্রী, ছোট রাজকুমার ইন্দ্রজিৎ আর বোন মানেকাকে নিয়ে হাতিতে উঠল। সঙ্গে এডিসি। সেই হাতি জঙ্গলে ঢুকল সন্ধ্যার পর। এবং ঢোকার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই হাতির সামনে একটা প্যান্থার। গায়ত্রীর হাতে টুয়েন্টি বোর শটগান। এডিসি কানের কাছে এসে বলল, শ্যুট! গায়ত্রী একটুও নার্ভ ফেল করল না। প্যান্থারটি ওখানেই গুলিবিদ্ধ হল। সে বছর কলকাতার কোচবিহার রাজপরিবারের প্রাসাদ উডল্যান্ডসে পোলো খেলতে আসা বিভিন্ন রাজা ও যুবরাজদের ডিনারের ব্যবস্থা। ইন্দিরা দেবী তাঁর ছোট মেয়ের এই শিকার কাহিনী বলছিলেন সকলকে হাসতে হাসতে। মাত্র ১২ বছর বয়সে প্যান্থার? সত্যিই বিস্ময়কর। সকলেই হাসছে। ১৯৩১ সালের ক্রিসমাস। কলকাতায় উৎসবের আবহ। সেই আলোকোজ্জ্বল আবহে ওই ডিনার পার্টিতে ১২ বছরের গায়ত্রীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন এক যুবক। গায়ত্রী জানতেই পারেনি। তার নাম ছিল মহারাজা দ্বিতীয় সোয়াই মান সিং। ডাক নাম জয়। জয় সিং সাংঘাতিক ভালো পোলো প্লেয়ার। কলকাতা ছিল পোলো সিজনের সেরা ইভেন্ট। ২১ বছরের জয় ইংল্যান্ডের উলউইচ মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে সবেমাত্র ট্রেনিং শেষ করে এসেছেন। স্লিম, হ্যান্ডসাম, ফ্ল্যামবয়েন্ট। জয়কে দেখে অন্য সব রাজকুমারীদের মতোই বুকে এক টুকরো স্বপ্ন দানা বেঁধেছে গায়ত্রীর। কিন্তু জয় তাকে পাত্তা দেবে কেন? সে এমনই ভাবতো। কলকাতায় এসেই জয় চলে আসে উডল্যান্ডসে। বন্ধু জগদীন্দ্র আর ইন্দ্রজিতের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে। জয়কে ভালো না লেগে উপায় নেই। প্রতি বছরের ইন্ডিয়া পোলো অ্যাসোসিয়েশন চ্যাম্পিয়নশিপে জয়পুর টিম লাগাতার চ্যাম্পিয়ন। ক্যাপ্টেন জয়। ১৯৩২ সালেও জয়পুর জয়ী হল। একদিন উডল্যান্ডসে এসে জয় ইন্দিরা দেবীকে বললেন, আমি কী গায়ত্রীকে নিয়ে রেস্তরাঁয় যেতে পারি? জয় ছিল মায়ের খুব প্রিয়। তাই অনুমতি না দেওয়ার প্রশ্নই নেই। কলকাতার সবথেকে ফ্যাশনেবল রেস্তরাঁর নাম ফারপোজ। এতদিন গায়ত্রী পরত টিউনিক আর পায়জামা। কিন্তু সেদিন সে পরল শাড়ি। জয় সিং বিবাহিত। কিন্তু বিবাহ তাঁর নিজের পছন্দমতো হয়নি। মহারাজা সোয়াই মান সিং জয়কে সিংহাসনে বসানোর আগেই যোধপুরের দুই রাজকন্যার সঙ্গে জয়ের বিয়ে স্থির করেছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে জয়ের বিয়ে হয়ে যায়। তাঁর প্রথম স্ত্রী তাঁর থেকে বয়সে বড়। সেদিন ফারপোজে গায়ত্রীর সঙ্গে ডিনারের পরদিন জয় ফিরে যান জয়পুরে। আর একমাস পর খবর এল জয় আবার বিয়ে করেছে। বর্তমান মহারানির ছোটবোনের সঙ্গে!
গায়ত্রীর একটু মন কেমন করল। তার বেশি কিছু নয়। কারণ সে কখনও ভাবেইনি জয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হতে পারে। দুই পরিবারের অনেক ফারাক। মেয়ো কলেজ থেকে খবর এল ইন্দ্রজিত অসুস্থ। আজমিরে পড়াশোনা করে কোচবিহারের ছোট রাজুকমার ইন্দ্র। তাকে দেখতে যাওয়া হবে। ফেরার পথে মনে হল এত কাছে এসেছি। একবার জয়ের সঙ্গে দেখা হবে না? মা ইন্দিরা দেবীর এই প্রস্তাবে গায়ত্রী মুখে একটা নির্লিপ্তির চাদর রাখল। অথচ ভিতরে ভিতরে তার খুশির অন্ত নেই। জয়ের সঙ্গে দেখা হবে। নীল আকাশ। পিছনেই মরুভূমির আভাস। রুক্ষ বাতাস। গোলাপি টাইলসের বাড়ি। শাড়ি নয়। কেমন যেন শালের মতো কাপড় আর স্কার্ট পরেছে মেয়েরা। পুরুষদের মাথায় পাগড়ি লাল, নীল, সবুজ, হলুদ..। জয়ের প্রাসাদটা রামবাগে। জয়কে একা নয়, জয়পুরও ভালো লাগছে গায়ত্রীর। প্রাসাদের অতিথিশালায় থাকতে দেওয়া হল। দ্বিতীয় দিনে জয় আর গায়ত্রী গেল হর্স রাইডিংয়ে। এবং যখন ফিরল গায়ত্রীর মুখে একটা প্রসন্নতার ছাপ। নজর এড়াল না ইন্দিরা দেবীর। সেই হর্স রাইডিংয়ে দুটি মনের দেওয়া নেওয়া হয়েছিল। ইন্দিরা দেবী কিছু আন্দাজ করলেন। কিছু বললেন না। ফেরা হল কোচবিহার। ১৫ বছর বয়স হয়ে গেলেও গায়ত্রীরা সেভাবে বাংলা শিখছে না। এভাবে চলবে না। ইন্দিরা দেবী চাইছেন বাংলা শিখতেই হবে। পড়তে হবে। অতএব একটা জায়গায় পাঠানো ছাড়া উপায় নেই। সেটি হল শান্তিনিকেতেন। ১৯৩৫। সেই স্কুলের যিনি গুরুদেব সেই মানুষটি আশ্চর্য! গায়ত্রী বাড়িতে ছুটিতে এসে মাকে গল্প বলে। একদিনের কথা তো খুব মনে পড়ে। হঠাৎ গাছের নীচেই ক্লাস চলাকালীন প্রবল ঝড় উঠেছে। সকলেই পড়িমড়ি করে পালাচ্ছে। ঝড় আর মেঘের গর্জন। গায়ত্রী খুব শান্ত ভঙ্গিতে বইখাতা নিয়ে ধীরে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছিল নিজের ঘরে। পরদিন সকালের প্রার্থনার পর তাঁর দিকে হঠাৎ এগিয়ে এলেন গুরুদেব। গায়ত্রী ভয় পাচ্ছে। গুরুদেব বললেন, তুমি ঝড়ে ভয় পাও না? গায়ত্রী মাথা নেড়ে বলল, না তো! গুরুদেব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, একটি কিশোরী মেয়ে ঝড় আর মেঘগর্জনের আগমনে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যখন প্রকৃতির দিকে তাকায় এই দৃশ্যটির সৌন্দর্য কিন্তু অপরিসীম জানো তো! গায়ত্রী ওই বয়সে এই কথাটির অর্থ বোঝেনি। গায়ত্রীর সৌন্দর্য আশ্রমের চর্চায় পরিণত। শুধু গুঞ্জন শুনেছে সৌন্দর্যে তাঁর সবথেকে নিকট প্রতিপক্ষ ছিল নাকি একজন মাত্র ছাত্রী। মাত্র কয়েকমাস আগেই চলে গিয়েছে শান্তিনিকেতেন ছেড়ে। তার নাম ইন্দিরা নেহরু!
ম্যাট্রিকুলেশনে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে গায়ত্রী লন্ডনে চলে এল পড়তে। গায়ত্রী পড়ছে সায়েন্স স্কুল ব্রিলিয়ান্টমন্টে। কী আশ্চর্য যোগাযোগ। কয়েকমাস পরই হাজির জয়। স্যার হ্যারল্ড ওয়ার্নহারের টিমের সঙ্গে পোলো খেলতে। ফোন এল এক বিকেলে। ওপ্রান্তে জয়। গায়ত্রী, একবার ডরস্টারে আসতে পারবে? গায়ত্রী রাজি। সোজা হাইড পার্কে এসে গাড়ি দাঁড় করাল জয়। গায়ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, একটু ভেবে বলো। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। মনে রেখো আমি পোলো খেলি। যে কোনওদিন সাংঘাতিক অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে। সব ভেবেই উত্তর দাও। ভেবেচিন্তে। কোনও তাড়া নেই। গায়ত্রী হাইড পার্কের উত্তর দিক থেকে আসা হাওয়ায় উড়ে যাওয়া চুলের অলকচূর্ণ হাতে নিয়ে বলল, ইয়েস....।
কোচবিহারে ফিরে গিয়ে সবথেকে বেশি যে বাধা দিল সে হল ভাইয়া। রাজা জগদীন্দ্রনারায়ণ। তাঁর কথায়, জয়ের মহিলাপ্রীতি সকলেই অবগত। তোমাকে একসময় ভালো লাগবে না। এখনও ভেবে দ্যাখো। আর সবথেকে নিরুত্তাপ যিনি তাঁর নাম ইন্দিরা দেবী। তিনি আগেই টের পেয়েছিলেন যে এই সম্পর্ক যেদিকে এগোচ্ছে, এই বিয়ে হবেই। তাই তিনি বিয়ের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন আগেই। বিয়ে হয়ে গেল গায়ত্রী আর জয়ের। রাজাদের বিয়েতে ঠিক কেমন উপহার পাওয়া যায়? গায়ত্রী জয়পুরে এসে ভোপালের মহারাজের থেকে পেয়েছিলেন একটি ডার্ক ব্ল্যাক বেন্টলে গাড়ি। সিন্ধিয়া দিয়েছিলেন উটিতে একটি অতিথিভবন। বরোদার মামাবাড়ি থেকে পেলেন মুসৌরিতে প্রাসাদ। পাতিয়ালার মহারাজা উপহার দিলেন লন্ডনের ফ্ল্যাট। নেপালের মহারাজা দিলেন ১০০ হিরো বসানো মুকুট। ওই যে বাংলার এক প্রত্যন্ত জেলার রাজপরিবারের কন্যা রামবাগ প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। শতাব্দীর সেরা সুন্দরীর শিরোপা পাওয়া মহারানী গায়ত্রী দেবী!
জীবনের দ্বিতীয় পর্বটি গায়ত্রী দেবীর ছিল ততোটাই চমকপ্রদ যতটা প্রথম পর্ব। ১৯৬২ সালের পর তাঁর জীবনে আসবে এক অন্য চ্যালেঞ্জ। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র পার্টির হয়ে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে ১৯৬২ সাল থেকে লাগাতার তিনবার গায়ত্রী দেবী জয়ী হবেন বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে। গায়ত্রী দেবী কেমন ছিলেন এমপি হিসাবে? চীন যুদ্ধের সময় লোকসভায় বিতর্কে স্বতন্ত্র পার্টির নেতা প্রফেসর রংগাকে কটাক্ষ করে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বললেন, প্রফেসর যা জানেন তার থেকেও বেশি জানার প্রমাণ দিতে চেষ্টা করছেন। এই কটাক্ষে গোটা কংগ্রেস বেঞ্চ হাসছে। একেবারে পিছনের সারি থেকে উঠে দাঁড়ালেন প্রথমবারের এমপি গায়ত্রী দেবী। বললেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী যদি অন্তত কিছু বিষয়েও সামান্য কিছু বুঝতেন, তাহলে আজ আমাদের ভারতের এই দুর্দশা হয় না। নেহরু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিলেন। সেই গায়ত্রী দেবী নেহরুর মৃত্যুর পর সংসদের সেন্ট্রাল হলে শোকসভায় বলেছিলেন, ভারত এমন একজনকে হারালো যিনি ভারতকে ভালোবাসতেন প্রাণের চেয়ে বেশি এবং নিজের সহজ জীবন ছেড়ে স্বাধীনতার জন্য যিনি বেছে নিয়েছিলেন কঠিন পথ।
ব্যস্ততা বাড়ছে গায়ত্রী দেবীর। স্বামী জয় সিং স্পেনের রাষ্ট্রদূত। আর গায়ত্রী দেবীকে সামলাতে হচ্ছে রাজনীতি। ১৯৭০। কুইনস কাপের ফাইনাল হয়ে যাওয়ার পর মহারাজা সোয়াই মান সিং অর্থাৎ জয় সিং এবং গায়ত্রী দেবী লন্ডনে একটি ককটেল পার্টি দেন। প্রতি বছরই এটাই দস্তুর। যথারীতি এসেছেন ইংল্যান্ডের রানি, প্রিন্স ফিলিপ। জয় লর্ড মাউন্টনব্যাটেনের সঙ্গে ব্যাঙ্কোয়েট হলের এক প্রান্তে কথা বলছিলেন। মাঝেমধ্যে তাঁর হাত চলে যাচ্ছে বুকে। গায়ত্রী দেবী লক্ষ্য করলেন। সেদিন গভীর রাত হল রুমে ফিরতে। তোমার কি শরীর খারাপ? গায়ত্রীর প্রশ্ন শুনে ফ্যাকাশে চোখে জয় বললেন, একটু। তোমার খেলার কী হবে? পরশু? ও কিছু হবে না! পোলোর আম্পায়ার হয়েছেন জয় সিং। বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে। থামার পর খেলা শুরু হলেও ঠিক জমছে না। ধীর লয়ে খেলা চলছে। একটা ধপ করে শব্দে প্যাভিলিয়নে থাকা গায়ত্রী দেবী তাকালেন। মাঠে কখন যেন অ্যাম্বুলেন্স ঢুকেছে। কী হয়েছে? আম্পায়ার পড়ে গিয়েছেন মাটিতে! মানে? ২৬ জুন ১৯৭০। মহারাজা দ্বিতীয় সোয়াই মান সিং লন্ডনের এক পোলো গ্রাউন্ডে প্রাণ হারালেন। মহারানি গায়ত্রী দেবী একলা হলেন।
এরপর তাঁকে আয়কর ফাঁকির অভিযোগে ইন্দিরা গান্ধী তিহার জেলে পাঠাবেন। পাঁচ মাস জেলে থাকতে হবে। তাঁর রামবাগ প্রাসাদে তিনমাস ধরে গোয়েন্দাবাহিনী খোঁজ করবে গোপন গহনার সাম্রাজ্য। কিন্তু খুঁজে পাবে না কিছুই। সেসব অন্য রুদ্ধশ্বাস কাহিনী। পরে হয়তো কখনও বলা যাবে। ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই জয়পুরের দুর্লভজি মেমোরিয়াল হাসপাতালে গায়ত্রী দেবীর শারীরিক মৃত্যু হয়েছে বটে। কিন্তু মহারানি গায়ত্রী দেবীর রহস্যময় সৌন্দর্য, আভিজাত্যের শেষতম পরাকাষ্ঠা, ফ্যাশন আর স্টাইলেব রোলমডেল হিসাবে বছরের পর বছর বিশ্ববিখ্যাত ‘ভোগ’ পত্রিকার সেরা সুন্দরীর আখ্যা পাওয়া আর এলিগেন্ট ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বলতার কাহিনীগুলি আজও অম্লান। মহারানি গায়ত্রী দেবীর জন্মশতবার্ষিকী হল? অবিশ্বাস্য! তিনি তো চিরনবীনা! আধুনিক ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বিউটি আইকন!
.............................................................
গ্রাফিক্স সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় উজ্জ্বল দাস