উকিল ও ডাক্তারদের কর্মব্যস্ততা বাড়বে। পত্নী/পতির স্বাস্থ্য আকস্মিক ভোগাতে পারে। মানসিক অস্থিরভাব। ... বিশদ
সাতপুরা ব্যাঘ্র সংরক্ষণ অরণ্য ভারতের অন্যতম পুরনো জঙ্গল। সোশ্যাল মিডিয়ায় হঠাৎ একদিন আমার এক বাল্যবন্ধুর পোস্ট দেখে অভিভূত হয়ে যাই। তখনই স্থির করি যেতেই হবে। ভাবনা অনুযায়ী বসন্তের এক ফুরফুরে সকালে সাতপুরার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। মধ্যপ্রদেশের এই অরণ্যে ট্রেন বা প্লেনে সরাসরি যাওয়া যায় না। ভেঙে যাত্রা করতে হয়। আমরা বিমানে নাগপুর পৌঁছে রাত্রিবাস করলাম সেখানেই। পরের দিন সকালে হোটেলে প্রাতরাশ সেরে ১৭৮ কিমি দূরে সাতপুরা অভয়ারণ্যের দিকে রওনা হলাম।
তাপমাত্রার পারদ বাড়তে শুরু করেছে। সুতরাং বার দুয়েক গাড়ি থামিয়ে, চায়ের বদলে লস্যি খেয়ে, প্রায় ঘণ্টা চারেক পরে সাতপুরার ‘গৌডিসা’ রিসর্টে পৌঁছলাম। সুন্দর সবুজের সমাহার। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রিসর্টটির গা ঘেঁষে সাতপুরার প্রাণ ‘দেওনা’ নদীর বয়ে চলা। জঙ্গলে প্রবেশ না করে এখানেও কয়েকটা দিন অনায়াসে কাটানো যায়!
রিসর্টে পৌঁছে জানা গেল, নদীবক্ষে সাফারি সম্ভব। তখনও সূর্য অস্ত যেতে বেশ বাকি। তাই আর দেরি না করে টিকিট কেটে ফেরি বোটে উঠে পড়লাম। জানা গেল, কপাল যদি গোপাল হয়, তাহলে ব্যাঘ্র দর্শনও সম্ভব! নদীর জলে প্রচুর কুমিরের বাস। যাদের কয়েকজনের দেখা মিলল ডাঙার উপরে। দেখতে দেখতে বিকেল পড়ন্ত হল। নদীর জলে রক্তিম আভা। পাখির কূজন স্তিমিত হয়ে এল। জঙ্গলের বাসিন্দা হরিণ, বাঁদর, শূকরের দল ধীর পায়ে নদীতে নেমে জল খেয়ে ফিরে গেল নিজ নিজ আস্তানায়।
পরের দিন সকালে আলো ফোটার আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম নদীর ধারে। জঙ্গলে প্রবেশ বা সাফারির জন্য নদী পেরতেই হবে। ফেরি বোট সবসময় প্রস্তুত থাকে। অনলাইনে বুকিং-এ আমাদের পাঁচটা সাফারি আগেই বুক করা ছিল। গলুবাবু যথেষ্ট পরিচিত ও দক্ষ গাইড। নদী পেরনোর সময়ই সূর্যমামা উঠে পড়ছে। নদীতে সোনালি আভা, পাখির বিভিন্ন স্বরে ও সুরে গান, বাঁদরের দলের হুপহাপ শুরু। রাত্রির অন্ধকার কাটিয়ে জঙ্গলে প্রাণ ফিরে এল।
এই জঙ্গলে পর্যটকের ভিড় কম। সারাদিন গোটা পনেরোটা গাড়ি ঢোকে। তাই জঙ্গলের নীরবতা সুন্দর উপভোগ করা যায়। আমাদের জিপ কিছুদূর এগতেই হঠাৎ একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক বাঘিনীর দেখা মিলল। সবুজ ঘাসের উপত্যকায় হেঁটে বেড়াচ্ছে আর করুণ সুরে কাকে যেন ডাকছে। ব্যাঘ্রজীবনের নিয়ম অনুযায়ী, তার মা তাকে ও তার ভাইকে সদ্য পরিত্যাগ করেছে। তাদের এখন স্বাধীন জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে। এখন ভাই-বোন তাই জোট বেঁধে রয়েছে। জানা গেল, বাঘিনী তার ভাইকে খুঁজে পাচ্ছে না। সুতরাং সে কেঁদে কেঁদে ভাইয়ের অনুসন্ধানই করে চলেছে। আমরাও তাকে অনুসরণ করে চলেছি। জীবনে বহুবার বহু জঙ্গলে বাঘ দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবুও প্রতিবারই এক আলাদা চমক, আলাদা শিহরন অনুভব করি। এই সময়, হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে একটি প্রকাণ্ড বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঘিনীর ওপর। বোঝা গেল, ইনি হচ্ছেন বাঘিনীর হারিয়ে যাওয়া ভাই। তারা কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করে বনের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল। তাদের আর দেখা মিলল না।
বাঘহীন জঙ্গল বড় শান্ত। বিশাল গাছের তলায় বাঁদরের বিরাট পরিবারে সাংসারিক আলোচনা চলছে। ইন্ডিয়ান গাউড়ের দল মনের সুখে ঘাস খেয়ে চলেছে। ময়ূর গাছের ডালে নিশ্চিন্তে একটু দিবানিদ্রা দিয়ে নিচ্ছে। কোথাও দুষ্টু খরগোশ মুখ বাড়িয়ে জঙ্গলের খবরাখবর নিয়েই গর্তে পালাচ্ছে। জায়ান্ট স্কুইরেল খাওয়ায় এত মশগুল যে উপরে টাওহি ঈগল ওত পেতেছে সেকথা টেরই পেল না।
দুপুরে রিসর্টে ফিরে এসে খানিক বিশ্রাম ও খাওয়াদাওয়া সেরেই আবার দুপুরে সাফারি। সাতপুরার জঙ্গলে রাতের সাফারিও হয়। বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। শুরুতে ভাগ্য বিশেষ সুপ্রসন্ন ছিল না। জঙ্গলের এদিক-ওদিক ঘুরে বেরিয়ে মুগ্ধ হয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। একটা প্রকাণ্ড বটের ছায়ায় জিপ দাঁড় করিয়ে একটু দিবানিদ্রার উপক্রম হয়েছিল, ঠিক তখনই একটা ‘কল’ (বাঘের উপস্থিতি জানান দেওয়ার সংকেত) শোনা গেল। মানে বাঁদরের ‘সাবধানী চিৎকার’ আসন্ন বিপদ সম্পর্কে। তৎক্ষণাৎ আমাদের গাইড গলু গাড়ি দৌড় করালেন। কিছু দূরে যেতেই ছোট একটি বাচ্চা লেপার্ড দেখা গেল। সে নিশ্চয়ই মায়ের কথার অবাধ্য হয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে তার মা রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে বেরিয়ে, সটান বাচ্চা নিয়ে টিলার উপরে দৌড়ল। অবাক হয়ে দেখতে থাকলাম, পশু হোক বা মানুষ, মা তো মা-ই!
আস্তে আস্তে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। চারপাশে স্তব্ধ। সূর্য অস্তমিত, মিলিয়ে যাওয়া দিনের আলোয় জঙ্গলের কী অপূর্ব রূপ! দেখতে দেখতে কালো আকাশে কখন একফালি চাঁদ দেখা দিল। স্নিগ্ধ আলোয়, একটা জলাশয়ের ধারে জিপ দাঁড় করিয়ে রিসর্ট থেকে ফ্লাস্কে করে দেওয়া গরম কফি খেতে খেতে কোন এক নিস্তব্ধ নির্জন জগতে প্রবেশ করে ফেলেছিলাম। হঠাৎ দূরে ময়ূরের আর্তনাদে যেন ঘুম ভাঙল। তবে কি কেউ নিঃশব্দে শিকারে বেরিয়েছে? যাকে অন্য কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু সে সবাইকে দেখছে! যাই হোক, নাইট সাফারিতে আমরা বিশেষ কিছু দেখতে পাইনি। কিন্তু রাত্রির অন্ধকারে অপার্থিব জঙ্গলের রূপ প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা আজীবন মনে থাকবে। এরপর পরপর তিনটি সফরে বাঘ আর দেখা যায়নি। মনটা একটু বিষণ্ণ। সেদিন শেষ সাফারি সকাল থেকে অনেক ঘোরাঘুরির পর স্থির হল প্রাতরাশ করে ফিরে যাওয়া। জঙ্গলের মধ্যে নির্দিষ্ট প্রাতরাশ করার জায়গা থেকে ফিরে আসার সময়, খুব কাছ থেকে একটা গর্জন শোনা গেল। গাড়ি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অদূরেই দেখা মিলল বৃহদাকার সেই ভাইজানের! এখানকার বাঘেদের প্রকাণ্ড চেহারার অন্যতম কারণ এরা প্রধানত ইন্ডিয়ান গাউর শিকার করে খায়। সে প্রকাণ্ড বাঘ গর্জন করতে করতে আমাদের দিকেই অগ্রসর হতে লাগল। তার চাহনি আর চলনে হৃদস্পন্দন স্থির হওয়ার উপক্রম। ঠিক তখনই তার বাঘিনী বোন আহ্লাদ করে ভাইকে জড়িয়ে ধরে, মাঝ রাস্তায় খেলা শুরু করুল। হঠাৎ তারা চুপ করে গিয়ে আমাদের জিপের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমরাও হতবাক হয়ে গেলাম। তখন গলু বলল ওরা আসলে জিপের ঠিক পেছনে একদল গাউর ঘাস খাচ্ছে সেই দিকেই তাকিয়ে আছে। শিকার সামনে, অন্য কোনওদিকে মন দেওয়ার সময় নেই। কিছুক্ষণ পর বড়ভাই যেন বোনকে বলল, ‘চল, আমরা বনের ভিতর যাই। এখন তো আর মা নেই। নিজেদের খাবার নিজেদেরই জোগাড় করতে হবে।’ শিকারের উদ্দেশ্যেই দুই ভাই-বোন গভীর জঙ্গলে মিলিয়ে গেল। সাতপুরা জঙ্গলের বাঘ ‘ভাই-বোনের’ মধুর স্মৃতি নিয়ে ঘরে ফিরলাম আমরা। অপেক্ষায় আছি আবার জঙ্গলের ডাকে সাড়া দেব বলে।
ছবি: তীর্থঙ্কর দাস