শেয়ার প্রভৃতি ক্ষেত্র থেকে অর্থাগমের সম্ভাবনা। সন্তানের কর্ম প্রাপ্তির সুখবর পেতে পারেন। কর্মক্ষেত্রে জটিলতা কিছুটা ... বিশদ
মা হওয়া কি মুখের কথা? এই আপ্তবাক্য শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় আটকে থাকা নিছকই শব্দের খেলা নয়। সত্যিই সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য একটি মেয়েকে যে শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, সেটা এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। সন্তানসম্ভবা যে কোনও মহিলার শরীর যেমন ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে, বদলায় মনও। সন্তানসম্ভাবনার কয়েকটি মাস কী কী মানসিক স্তরের মধ্যে দিয়ে যান হবু মা, সেখান থেকে ভালো থাকা কীভাবেই বা সম্ভব?
আলোচনার শুরুতেই মানসিক অবস্থার নিরিখে হবু মায়েদের তিন ভাগে ভাগ করে নিলেন প্রসেনজিৎ। প্রথম ভাগে রয়েছেন সেই সব সন্তানসম্ভবা মহিলা যাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য স্বাভাবিক। কিন্তু সন্তানসম্ভবা অবস্থায় নানারকম উদ্বেগ, আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছেন সেই হবু মায়েরা যাঁদের মধ্যে আগে থেকেই অন্তর্নিহিত মানসিক সমস্যা রয়েছে। কিন্তু তাঁরা আপাত সাধারণ ব্যবহার করছেন। যখনই উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে তখন মানসিক সমস্যা প্রকট হচ্ছে। তৃতীয় ভাগে থাকা মহিলাদের মানসিক সমস্যা রয়েছে। তাঁরা হয়তো চিকিৎসাধীন, আবার চিকিৎসা শুরু হয়নি, এমনও হতে পারে।
প্রথম ভাগ
প্রেগন্যান্সির দুটো ভাগ রয়েছে। আর্লি এবং লেট প্রেগন্যান্সি। চিকিৎসক জানালেন, আর্লি অর্থাৎ প্রথম তিন মাস। সেসময় বাচ্চার স্বাস্থ্য কেমন হবে, প্রেগন্যান্সি চলাকালীন বাচ্চার গ্রোথের সমস্যা হবে কি না, সন্তান মানসিক এবং শারীরিকভাবে সুস্থ কি না— এসব নিয়ে মায়ের মনে চিন্তা থাকেই। আর একটা চিন্তা হয়, জন্মের পর বাচ্চাকে ঠিকমতো রাখতে পারবেন কি না। প্রথম তিন মাস বমি ভাব থাকে। কারও বা বমি হয়। মানসিক টেনশন, ডিপ্রেশনে এই বমিভাব আরও বেশি মাত্রায় দেখা দেয়। দুর্বলতা, আলস্য থাকে। যাঁদের মিসক্যারেজের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাঁদের টেনশন আরও বেশি।
লেট প্রেগন্যান্সি অর্থাৎ সন্তানসম্ভাবনার শেষ তিন মাস। প্রসেনজিৎ জানালেন, সেসময় যদি হবু মা ডিপ্রেশনে থাকেন, তার প্রভাব পড়ে বাচ্চার উপর। বাচ্চার গ্রোথেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। ‘লেট প্রেগন্যান্সিতে গর্ভস্থ সন্তান শব্দ বা মিউজিক শুনতে পায়। রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়। বাচ্চার গ্রোথ যথাযথ হয়। কিন্তু উদ্বেগ বেশি হলে অসময়ে সন্তান প্রসব হয়ে যেতে পারে। রোগী উদ্বেগে থাকলে চিকিৎসক হিসেবে তাকে আগে থেকে সাবধান করে দেব’, বললেন তিনি।
দ্বিতীয় গোষ্ঠী
প্রসেনজিতের কথায়, ‘হবু মা যদি রোগী হিসেবে দ্বিতীয় গোষ্ঠীর অন্তর্গত হন, তাহলে তাঁদের ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণ আরও একটু প্রকট হবে। স্ট্রেস আরও বেশি, আরও আগে দেখতে পাওয়া যাবে। রোগী আমার কাছে এসে ঠিক এই ভাষায় বলেন, ‘আমি বুঝতে পারি এই অবস্থাটা সামলানো দরকার। কিন্তু আমি সামলাতে পারছি না।’ ফলে উদ্বেগের সীমা এই রোগীদের ক্ষেত্রে আরও বেশি।’
তৃতীয় দল
চিকিৎসক জানালেন, এই তৃতীয় ভাগে যেসব হবু মায়েরা রয়েছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্তান সম্ভাবনার আগে থেকেই এরা সাইকিয়াট্রিক মেডিসিনে অভ্যস্ত। তিনি বললেন, ‘গর্ভস্থ সন্তানের সুরক্ষার কথা ভেবে প্রেগন্যান্সির সময় সব সাইকিয়াট্রিক মেডিসিন দেওয়া যায় না। এমন ওষুধ দিতে হবে, যাতে বাচ্চার সুরক্ষাও বজায় থাকবে আবার মায়ের উদ্বেগও কম থাকবে। মানসিক রোগ নানারকম রয়েছে। এমন রোগও আছে, যেখানে পরিস্থিতি অনুযায়ী সন্তান ধারণের পরিকল্পনাই হয়তো করা যাবে না।’
সুস্থ হওয়ার উপায়
দীর্ঘ ন’মাস মানসিকভাবে সুস্থ থাকা বড় চ্যালেঞ্জ। প্রত্যেক হবু মায়ের ক্ষেত্রে সমস্যা আলাদা হতেই পারে। স্বাভাবিকভাবেই তার সমাধানও আলাদা। কিন্তু সাধারণভাবে কী কী পদ্ধতিতে সুস্থতার দিকে এগনো সম্ভব? প্রসেনজিৎ বললেন, ‘রোগী যে দলেরই হোন না কেন, চিকিৎসক হিসেবে আমি তাঁকে ভরসা দিতে পারি। দীর্ঘ ন’মাস হবু মা একজন চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করছেন। ফলে চিকিৎসকের উপর প্রসূতি অনেকটা নির্ভর করেন। ডাক্তারের ব্যক্তিত্ব, আত্মবিশ্বাস এগুলো আনস্পোকেন কমিউনিকেশন। অনেকক্ষেত্রে এতেই স্ট্রেস কেটে যায়।’
এখন অনেক উন্নত পরীক্ষার ফলে বাচ্চার মানসিক, শারীরিক সুস্থতার বিষয়ে আগে থেকে জানা যায়। ফলে মায়ের আশঙ্কা সেদিক থেকে অনেকটাই কমানো সম্ভব হয়।
এরপরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কেয়ারগিভাররা। চিকিৎসক, নার্স, ডাক্তারের চেম্বারের বাকি কর্মীরা, সকলেই কেয়ারগিভার। হবু মাকে তাঁরা কতটা আস্থা জোগাচ্ছেন, তাঁর সমস্যার কথা শুনছেন, সেটা হবু মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে।
প্রেগন্যান্সির দিনগুলোতে হবু মায়ের মন ভালো রাখায় পরিবারের বড় ভূমিকা রয়েছে। চিকিৎসক বললেন, ‘মহিলার স্বামী বা বাড়ির বয়স্কা মহিলা— মা, শাশুড়ি মা বা দিদি স্থানীয় কাউকে আমি আসতে বলি। যিনি কেয়ারগিভার হতে পারেন। তিনি এই সব আলোচনায় থাকলে আমরা তাঁকেও গাইড করে দিতে পারি। তাঁদেরও অনেক প্রশ্ন থাকে। সেখানে মানসিক সাপোর্ট দেওয়া আমাদের কাজ। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে এতেই ভালো কাজ হয়। যাতে হবু মা বুঝতে পারেন, আমি একা নই। চিকিৎসক সহ এতগুলো লোক আমার পাশে রয়েছেন।’
প্রসেনজিৎ স্পষ্ট করে দিলেন, এতে যদি কাজ না হয়, তখন একজন সাইকোলজিস্টকে যুক্ত করা হয়। তাঁর কথায়, ‘হতে পারে হবু মায়ের সমস্যাটা প্রেগন্যান্সি সংক্রান্ত নয়। হয়তো তার একটা অসুখী ছেলেবেলা রয়েছে। সেই খারাপ অভিজ্ঞতা হয়তো প্রেগন্যান্সিতে কোনও ভাবে সমস্যা তৈরি করছে। হয়তো ছোটবেলায় কোনও শিশুকে তিনি অবহেলিত হতে দেখেছেন, তিনি হয়তো ভাবছেন, আমার বাচ্চাও যদি অবহেলিত হয়! সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নিতে হবে। তাঁর পরামর্শেও কাজ না হলে সাইকিয়াট্রিস্টকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পরিস্থিতি খুব বিপদজনক হলে সেটা হয়। কিন্তু প্রথম দলের ক্ষেত্রে সেই উদাহরণ কম।’ তিন দলের রোগীর ক্ষেত্রেই একই পদ্ধতিতে চিকিৎসা চলবে। কিন্তু তৃতীয় দলের ক্ষেত্রে অনেক দ্রুত চিকিৎসা শুরু হওয়া দরকার।
প্রশাসনিক উদ্যোগ
প্রসূতির মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেন প্রসেনজিৎ। তিনি বলেন, ‘সারা পৃথিবীতে প্রেগন্যান্সি এবং ডেলিভারির ব্যাপারে যে হেলথ সিস্টেম রয়েছে, তার মাপকাঠি হল মেটারনাল মর্টালিটি এবং গর্ভস্থ ও সদ্যোজাত শিশু মৃত্যুর হার। সরকার এই দুটো মাপকাঠি নিয়ে সচেতন। সেজন্য সরকার ১০০ শতাংশ ‘ইনস্টিটিউশনাল ডেলিভারি’ চাইছে। অর্থাৎ সব ডেলিভারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে হবে।’
তিনি আরও জানান, এখনও এমন জায়গাও রয়েছে, যে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আসতে চার ঘণ্টা সময় লাগে। সেখানে সরকার প্রাইমারি হেলথ ওয়ার্কার বা অঙ্গনওয়ারি কর্মীদের উপর জোর দিচ্ছে। এই কর্মীরা গ্রামে গিয়ে প্রসূতি ও তাঁর বাড়ির লোকেদের শিক্ষিত করেন। তার মধ্যে টিটেনাস ইনজেকশন নেওয়ার গুরুত্ব যেমন বোঝানো হয়, তেমনই ভিটামিন, আয়রন ক্যাপসুলও ওঁরা পৌঁছে দেন। সেই আলোচনাতেই মানসিক স্বাস্থ্যের কথাও বলা হচ্ছে। মানসিক অবসাদে কোন রোগী ভুগছেন, সেটা বুঝলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসককে জানানো হয়।
মাতৃত্বের পথে যত বাধাই আসুক, তা কাটিয়ে আলোর খোঁজ পেতে পারেন একমাত্র মায়েরাই।