ধর্মকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণে মানসিক তৃপ্তি ও সামাজিক সুনাম। পেশাদার শিল্পীদের শুভ সময়। ... বিশদ
ক্রমশ বাড়ছে মানসিক নির্যাতন। ঘরে বাইরে হেনস্তা হচ্ছেন মেয়েরা। এর ফলে তাঁদের অবসাদ বাড়ছে। কাউকে বিশ্বাস করতে ভয় পাচ্ছেন। নিজের আচরণ বারবার যাচাই করার চেষ্টা করছেন। এগুলো সবই মানসিক সমস্যার নানা ধরন। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসবেন কীভাবে? পরামর্শ দিলেন মনোবিদ অমিত চক্রবর্তী।
হেনস্তা বনাম নির্যাতন
কাউকে অযথা হয়রান করা, যথাযোগ্য সম্মান না দেওয়া, কথায় কথায় ঠাট্টার ছলে হেয় করা— এগুলোই মানসিক হেনস্তা। অযথা বাধাপ্রাপ্ত হলে, অসুবিধায় পড়লে মনের উপর চাপ সৃষ্টি হয়। আর এই মানসিক চাপ থেকেই অবসাদের সৃষ্টি। কাউকে যদি শারীরিকভাবে নিরন্তর আঘাত করা হয় বা যন্ত্রণা দেওয়া হয়, তা চোখে পড়ে। কিন্তু মানসিক হেনস্তার ক্ষেত্রে অনেক সময়ই বিষয়টা অন্তরালে থেকে যায়। অথচ মানসিক হেনস্তার ফল কিন্তু সুদূরপ্রসারী।
ঘরে বাইরে হেনস্তা
ঘরোয়া হেনস্তা শারীরিকের চেয়ে মানসিকই বেশি। শুরুটা হয় ঠাট্টা দিয়ে। একাধিক সন্তান থাকলে বাবা-মা কোনও একজনের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েন। তখন নিজের অবস্থানের সুযোগ নিয়ে সে অন্যদের অসুবিধায় ফেলে। বাবা-মাও কথার মাধ্যমে সন্তানকে হেনস্তা করতে পারেন। এছাড়াও আছে বধূকে মানসিকভাবে নির্যাতন। ছোটখাট কথার মাধ্যমেই পরিবারে আসা নতুন বউটি নির্যাতিত হতে পারে। পারিবারিক নির্যাতন ও হেনস্তার প্রসঙ্গে অমিতবাবু বললেন, ‘এই ধরনের অপমান সাধারণত বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যেই সীমিত থাকে। কিন্তু বাইরে যে নির্যাতন বা হেনস্তা হয় সেটা অনেক বড়সড় রূপ নেয়। কারণ তার ক্ষেত্রটা বিস্তৃত।’ এই প্রসঙ্গে একটা উদাহরণও দিলেন তিনি। বললেন, ‘ধরা যাক কর্মক্ষেত্রে কোনও একজন কর্মী অপমানিত হলেন। তখন সহকর্মীরা সেই অপমানের কথা জেনে যায় এবং অনেক সময়ই তার সুযোগও নেয়। অপমানের আঁচটা বহু গুণ হয়ে যায়।’
আঘাতের প্রভাব কী কী
মনোবিদ হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করতে গিয়ে অমিতবাবু দেখেছেন শারীরিক নির্যাতনের ক্ষত সময়ের সঙ্গে কমে, কিন্তু মানসিক চাপ বা ‘ট্রমা’র ক্ষত পুরোপুরি যায় না। এর থেকে সমস্যা তৈরি হয়।
প্রথম যে মানসিক সমস্যাটা দেখা দেয় তা হল বিশ্বাস করার অক্ষমতা। যিনি ক্রমাগত হেনস্তার শিকার হন, তিনি আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেন না। এর ফলে নিজের মানসিক শান্তি নষ্ট হয়।
দ্বিতীয়ত এর ফলে আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। ক্রমাগত অন্যের কাছে হেয় হতে হতে নিজেরও মনে হয় তিনি কিছু করতে পারবেন না। অমিতবাবু বললেন, আমাদের সমাজে মেয়েরা মানসিক ও শারীরিক নিগ্রহের শিকার বেশি হন বলে তাঁদের আত্মবিশ্বাসে আঘাত আসে। তিনি দেখেছেন, কোনও মেয়ে তার কৈশোরে হয়তো পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, সেই সময় প্রতিবাদ করতে পারেনি, অথবা প্রতিবাদ ধোপে টেকেনি। কিন্তু মনের উপর সেই নির্যাতনের ছাপ থেকেই গিয়েছে। ফলে বিয়ের পর স্বামীর সোহাগেও তার ভয় লাগে।
তৃতীয়ত একটা হীনম্মন্যতা তৈরি হয়। মনে হয় নিজের গলদ আছে বলেই তাকে হেনস্তা হতে হচ্ছে।
চতুর্থ সমস্যা হল ভয়। অন্যের প্রতি, সমাজের প্রতি একটা ভীতিবোধ জন্মায় যেটা ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই খারাপ।
পঞ্চম সমস্যা, নিজেকে ভিক্টিম বা দোষী মনে করা। এটা সবচেয়ে বেশি হয় শারীরিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে। অমিতবাবু বললেন, একটি মেয়ে ধর্ষিত হলে আমাদের সমাজ তাকে মূলত করুণা করে, কেউ হয়তো সমবেদনা দেখায়। মোটের উপর ধর্ষিত মেয়েটির গায়ে ধর্ষণের তকমা লেগে যায়। সেই ক্ষেত্রে মেয়েটি নিজেকেই দোষারোপ করতে শুরু করে। অধিক রাতে একা বেরনো ঠিক হয়নি, আচরণ যথেষ্ট সংযত ছিল না, পোশাক নির্বাচন ভুল হয়েছিল— এমন নানারকম দোষ সে নিজেকেই নিজে দিতে থাকে। তার মধ্যে একটা ভিক্টিম অ্যাটিটিউড বা দোষী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। যা তার মানসিক স্বাস্থ্য নষ্ট করে।
এই ধাক্কাগুলোর ফলে মানসিক অবসাদ তৈরি হয়, নৈরাশ্য গ্রাস করে। শারীরিক নিগ্রহের ব্যথাটা কমে গেলেও মানসিক অপমান বা লজ্জা থেকেই যায়।
যুঝবেন কীভাবে
এই অবসাদ থেকে বেরনোর একটা বড় উপায় হল সচেতনতা। আমাদের সমাজ বিভিন্ন দোষে দুষ্ট। তার মধ্যে প্রধান হল পুরুষের প্রতি পক্ষপাত। ফলে মেয়েদের অতিরিক্ত সচেতন থাকতে হবে।
মনের জোর বাড়াতে হবে। সহজে দমে গেলে চলবে না। নিজের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে জানতে হবে। প্রতিবাদের প্রথম ধাপই হল ‘অ্যাসারশন’ বা নিজের মত প্রতিষ্ঠা করা। কোনও জিনিস অপছন্দ হলে তা এড়িয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু তার চেয়েও ভালো নিজের অপছন্দটাকে জোর দিয়ে বলা। অযথা অপমানিত হলে প্রতিবাদ করতে হবে। সজোরে ‘না’ বলতে পারতে হবে।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, যে বা যারা অন্যকে অযথা অপমান করে তারা আসলে নিজেরাই হীনম্মন্যতায় ভোগে। তারা নিজেরাই বিকৃতমনস্ক। অতএব ত্রুটিটা তাদের। এই সারসত্য মনে রেখে মাথা উঁচু করে সমাজে বাঁচতে হবে। হেনস্তার আঁচ নিজের গায়ে লাগতে দিলে চলবে না। বরং যে হেনস্তা করছে তাকে উপেক্ষা করতে হবে। সেটাই তার সঠিক শাস্তি।