ধর্মকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণে মানসিক তৃপ্তি ও সামাজিক সুনাম। পেশাদার শিল্পীদের শুভ সময়। ... বিশদ
দুগ্গার হাতে ঝোলানো বটুয়া। তার মধ্যে লিপস্টিক, পারফিউম, নেলপলিশ, কমপ্যাক্ট, কাজল, সিঁদুর, চিরুনি— মেয়েদের সাজগোজের সরঞ্জাম। সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে থাকতে হবে তো। বাপের বাড়িতে পাঁচদিন থাকার সময় মেয়ের যত্নের যেন কোনও ত্রুটি না হয়, সেদিকে তো নজর থাকেই। কিন্তু মেয়ের মেকআপ বক্স
এত যত্নে গুছিয়ে দিতে দেখেছেন কি?
নিজে মেকআপ করতে ভালোবাসেন। তাই দুগ্গাকেও মেকআপের জিনিস বটুয়া ব্যাগে গুছিয়ে দেন সংযুক্তা চট্টোপাধ্যায়। শুধু দুগ্গা নয়। লক্ষ্মী, সরস্বতীর হাতেও থাকে নকশাদার বটুয়া। তার মধ্যে প্রসাধনী। পাঁচদিনের পাঁচটা বেনারসি, সঙ্গে মানানসই গয়না। এভাবেই সংযুক্তা দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাটে দুগ্গাকে সাজিয়ে রাখেন পুজোর পাঁচদিন। যে পুজো শুরু হয়েছিল প্রয়াত অভিনেতা অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে। তাঁর স্ত্রী হিসেবে সংযুক্তা এই পুজোর দায়িত্ব নিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু আজও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, এটা অভিষেকেরই পুজো।
চট্টোপাধ্যায় পরিবারে পুজোর শুরু কীভাবে? সংযুক্তা বললেন, ‘বিয়ের পর থেকেই দেখেছি ঘট পুজো হচ্ছে। অভিই পুজো করত। আমিও খুব স্পিরিচুয়াল। আমরা দু’জনেই সাঁইবাবার ভক্ত। হঠাৎ ২০১৮ থেকে মূর্তি এনে ফ্ল্যাটের ড্রইংরুমেই পুজো শুরু করি আমরা।’ সংযুক্তার বাড়ির দুর্গা এবার একেবারে আলাদা। ১৮ হাতের মূর্তি আসবে। সে আবার এক অন্য গল্প।
‘আমাদের বিয়ের পর পর তখন অভি যাত্রা করতে গিয়েছে। আমি বাড়িতেই ছিলাম। সেসময় সাঁইবাবার ওয়েবসাইটে ১৮ হাতের দুর্গা ঠাকুরের ছবি লাগানোর একটা কাজ আসে। এমন দুর্গা আদৌ আছে কি না জানতাম না। স্বপ্ন পেলাম, সাঁইবাবা বলছেন দীপুর বাড়িতে আছে ১৮ হাতের দুর্গা মা। অভিকে জিজ্ঞেস কর, ও বলে দেবে’, অলৌকিকভাবে মাকে পাওয়ার গল্প বলছিলেন সংযুক্তা। কে এই দীপু? কীভাবেই বা চট্টোপাধ্যায় পরিবারে মায়ের প্রবেশ হল? ফেলে আসা দিনে ফিরে গেলেন সংযুক্তা, ‘রাত তখন আড়াইটে। আমি অভিকে ফোন করলাম। তুমি কোথায়? ও বলল, গাড়িতে, বাড়ি ফিরছি। দীপু ছিল অভির গাড়ির চালক। আমি বলি, দীপুকে জিজ্ঞেস করো তো, ওর বাড়িতে ১৮ হাতের দুর্গা মা আছে কি না। দীপুকে জিজ্ঞেস করতে ও অবাক। বলছে, দাদা আপনি কী করে জানলেন? এটা তো কেউ জানে না। সেই থেকে ১৮ হাতের দুর্গা মায়ের ছবি বাড়িতে ছিল। আসলে অভি ৯ নম্বর খুব পছন্দ করত। আমরা ন’তলায় থাকি। আমাদের বিয়ে, আমাদের মেয়ের জন্ম সব ন’তারিখ। সাঁইবাবার নম্বরও ৯। আমি আর অন্য কিছু না ভেবে ১+৮= ৯, তাই ১৮ হাতের দুর্গার পুজো করার পরিকল্পনা করলাম।’
পুজোয় মাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে ভালোবাসেন সংযুক্তা। তাঁর কথায়, ‘নবমীর দিন নিরামিষ মাংস করি। জিরে দিয়ে মাটন। তাতে পেঁয়াজ, রসুন দেওয়া হয় না।’
অভিষেক চলে যাওয়ার পর কিছু বদল হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রির সতীর্থরা কি সংযুক্তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন? আসেন তাঁদের পুজোতে? স্মিত হেসে বললেন, ‘অভি চলে গিয়েছে শারীরিকভাবে। আমি ওকে সত্যিই ভালোবাসি। আর সত্যি ভালোবাসা একটা এনার্জি তৈরি করে। আত্মা মানে তো এনার্জি। আত্মার কোনও বিনাশ নেই। ওর পছন্দ ছিল এই দুর্গাপুজো। সেটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমার দায়িত্ব। দু’বছর হয়ে গেল। কীভাবে সময় চলে গেল আমি জানি না। আসলে সব সিক্রেট অভির মধ্যেই আছে। অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় ফোন করেন। খেয়ালি দস্তিদারের সঙ্গে মেসেজে কথা হয় মাঝেমধ্যে। বাকি কেউ খোঁজ নেন না। আমি আশাও করি না। তাই আমার খারাপও লাগে না। আসলে এটাও অভিরই মেসেজ ছিল। সেটা পরে বুঝেছি।’ কী সেই বার্তা? সংযুক্তা বললেন, ‘জানেন তো, প্রতিটি কথার নির্দিষ্ট অর্থ থাকে। শেষবার পুজোতে অভি অনেককে নিমন্ত্রণ করেছিল। যাদের ও আপন ভাবত। দশমীর দিন খুব আশা করেছিল সকলকে। দু-একজন শুধু এসেছিলেন। রান্না হয়ে গিয়েছিল। অনেক লোকের আয়োজন হয়েছিল। অভি রাগ করে আমাকে বলেছিল, ‘আর পরেরবার থেকে ডাকব না ওদের।’ এই কথাটা ও বলেছিল রাগের মাথায়। কিন্তু আমি পরে জেনেছি সব কথার আলাদা অর্থ থাকে। ‘আর ডাকব না ওদের’— আজ আমি বুঝতে পারি ওগুলো ওর মেসেজ ছিল। সেটাই সত্যি হল।’
পুজো আসছে। একইসঙ্গে আসছে বিসর্জনের গন্ধও। একটু অন্যভাবে ভাবতে ভালোবাসেন সংযুক্তা। ‘মা যতদিন থাকেন, সুরক্ষিত লাগে। তারপর চলে গেলে মন খারাপ হয়। আসলে বিসর্জন আমাদের কিছু থেকে বিচ্যুত হতে শেখায়। ভালোবাসার মতো সেই ‘ডিটাচমেন্ট’ গুরুত্বপূর্ণ। বিচ্ছেদ বলে সত্যিই কিছু হয় না। সেপারেশন বলে কিছু নেই। কারণ সকলেই আমাদের সঙ্গে থেকে যায়। অভি আমার আগে ‘রিটায়ার’ করাতে এটা আরও বুঝেছি। সেজন্য আমি গুডবাই বলি না মাকে। বলি কামিং সুন। ছাড়তে জানলে তবেই আবার আসবে’, চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে সংযুক্তার।