কর্মোন্নতি ও কর্মের প্রসার। সামাজিক সুনাম বৃদ্ধি। শারীরিক সমস্যার আশঙ্কা। ধনাগম মন্দ নয়। দাম্পত্যে চাপ, ... বিশদ
রঙিন পাড়ের সাদা শাড়ি। কাঁধে হাতে সেলাই করা পাটের ঝোলা ব্যাগ। নিরাভরণ। কালো পুরু ফ্রেমের চশমার আড়ালে আগুনের পরশমণির মতো দু’টি চোখ। পায়ে হাওয়াই চটি। ফুলের বৃতির মতো সতেজ, সাহসী। এই ছিল আমাদের বেলামাসি। একবার ১৫ আগস্টে ওই সাতপুরনো ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা লাল মলাটের বই বের করে বেলামাসি আমাদের তিন ভাইবোনকে বলেছিল, ‘কিসের স্বাধীনতা রে? জানিস, এই বইটা পড়েছিলাম বলে আমাকে একটা স্বাধীন দেশে জেল খাটতে হয়েছে’! শুনেছিলাম, বাড়ির বউ হয়েও পার্টি করত বলে বেলামাসি শ্বশুরবাড়িতে টিকতে পারেনি। আমার দিদি তখন দশম শ্রেিণ, দিদি তখন ষোলো। বড় বিস্ময়ে সে জানতে চেয়েছিল, ‘মেয়েরা এসব না করতে পারলে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বা মাতঙ্গিনী হাজরা কোন স্বাধীনতার জন্য লড়েছিলেন?’ বেলামাসি দৃঢ়স্বরে বলেছিল, ‘আমরা মেয়েরা সেই স্বাধীনতা পাইনি রে মা!’ তারপর আমার দিদির কাঁধে হাত রেখে, গানের মতো সুরে বেলামাসি বলেছিল, ‘যেদিন কেয়া চক্রবর্তীর মতো থিয়েটার করে তুই মাঝরাতে শিস দিতে দিতে পাড়াতে ঢুকতে পারবি, আমাদের দেশ স্বাধীন হবে সেদিন!’ আমি আর দাদা একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেদিন দেখেছিলাম, বেলামাসির কথা শুনে, ক্লাস টেনের ওই মেয়েটার দুই চোয়াল রাইফেলের মতো কঠোর হয়ে উঠছে। আমার অকালবিধবা, শিক্ষয়িত্রী মা সেদিন বেলামাসির হাত ধরে বলেছিল, ‘আমার মেয়েটা যেন তোর মতো হয় রে বোন।’ বেলামাসি বলত, ‘মেয়েরা স্বাধীনতা না পেলে কোনও দেশ মুক্তি পায় না!’
আমার ঠাকুরমা বলত, ‘মাইয়্যা মানষের বাইরে বাইরন দরকার!’ ঢাকা বিক্রমপুরের ধন্বন্তরি ডাক্তার ছিল আমার ঠাকুরদা। এক দুর্ভাগা মাঝরাতে নিজের ভিটেমাটিকে সেদ্ধ ডিমের খোসার মতো ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঠাকুরদা কলকাতায় ঢুকে পড়েছিল। পিছু পিছু সাত সন্তান-সন্ততিকে নিয়ে আমার ঠাকুমাও। তখন শহরের এধার-ওধারের সব উদ্বাস্তু কলোনিতে চিকিৎসা করে বেড়াত ঠাকুরদা। ওই সময় সাত ছেলেমেয়েকে একা হাতে নিজের মনের মতো করে বড় করে তুলেছিল ঠাকুরমা। আমাদের টালিগঞ্জের বাড়িটা এর অনেক পরে। এই বাড়িটা করেই ঠাকুরদা মারা যায়। ততদিনে ঠাকুরমার ছেলেমেয়েরাও জীবন জীবিকার কারণে ছড়িয়েছিটিয়ে গিয়েছে। ঠাকুরমার তখন ওই একলাটি নিজের মতো জীবন। ফি দুপুরে খাওয়ার পরে, মুখে এক খিলি পান গুঁজে, সোনালি ফ্রেমের একটা চশমা পরে, ঠাকুরমা ‘দৈনিক বসুমতী’ খুলে বসত। সঙ্গে আর সব গুচ্ছের বইপত্র। গরমের ছুটিতে আমরা গেলে অবশ্য সিন বদলে যেত। দুপুরে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বসত ঠাকুরমা। আমার মাকে ডেকে ঠাকুরমা বলত, ‘ও চিনিবউ, আমাগো কুলের আচারের বয়ামটা দিয়া যাও তো!’ ডান গালে কুলের বিচি জমিয়ে ঠাকুরমা আমাদের ‘যোগাযোগ’-এর কুমু, ‘ঘরে বাইরে’-র বিমলা, কিংবা ‘চিত্রাঙ্গদা’-র গল্প শোনাত। সেবার আমাদের সেজজেঠুর বড় মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে, আগস্টে। ঠাকুরমা তাকে সমঝে দিল, ‘বুঝলা দিদিভাই, ফুইলশইয্যার রাইতে, নাতজামাই যখন তুমার অনামিকায় অঙ্গুরীয় পরাইব, তখন তারে জিগাইবা, সুনার আংটি চাই না, আমি স্বাধীনতা চাই। দিবা?’ ঠাকুরমার এই কথা শুনে, দক্ষিণী-তে গান শেখা আমার জ্যাঠতুতো দিদি সেদিন গেয়ে উঠেছিল, ‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’! আমাদের ঠাকুমার প্রিয়তম রবিগান!
একটা গল্প শুনিয়েছিলেন আশাপূর্ণা দেবী। এক যে ছিল রাঙাপিসি। আলোর মতো তার গায়ের রং। একমাথা চুলে ছড়ানো ছিটানো রুপোলি অভ্রকণা। দুই চোখ যেন ময়ূরাক্ষী নদী। ঘরোয়াভাবে পরা কুচিহীন সাদা ছাপার শাড়ি। আঁচলের খুঁটে চাবির গোছা। পায়ে কোলাপুরি চটি। সব মিলিয়ে আপাত কোমলতায় জড়ানো একটা অদৃশ্য চাবুক যেন। অল্পবয়সে স্বামী মারা যাওয়ার পর, ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে অনেক কষ্ট করে একমাত্র ছেলে ধীমানকে বড় করে তুলেছিল রাঙাপিসি। ধীমানদা আইআইটি খড়গপুর, আইআইএম জোকা। ধীমানদা স্বভাবতই বড়সড় একটা চাকরি পেল। ঘটা করে ধীমুর বিয়েও দিল রাঙাপিসি। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই ফ্যাক্টরি সাইটে কোনও গন্ডগোল হওয়ায় ধীমানদাকে শহরের বাইরে যেতে হল কয়েক দিনের জন্য। এর মধ্যেই চলে এল পনেরোই আগস্ট, স্বাধীনতা দিবসের ছুটি। বলা নেই, কওয়া নেই, সেদিন সকালে হইহই করে নতুন বউদির বন্ধুবান্ধবী— সবাই কলাভবনের প্রাক্তনী— একটা হুডখোলা জিপ নিয়ে হাজির হল রাঙাপিসির বাড়ি। উদ্দেশ্য, নতুন বউদিকে নিয়ে সবাই মিলে দু’দিনের স্মৃতি সফর, পড়ুয়াবেলার শান্তিনিকেতন। আর ঠিক এর পরদিন সাইটের ঝামেলা মিটিয়ে বাড়ি ফিরে এল ধীমানদা। বউ বেড়াতে গিয়েছে শুনে সে তো অবাক। যেন গ্রহান্তরের নাটক! ক্ষুব্ধ ধীমানদা অগত্যা রাঙাপিসিকে বলল, ‘ঘরের নতুন বউ ইয়ারদোস্তদের সঙ্গে ফুর্তি করতে বেরিয়ে গেল, তুমি সেটা অ্যালাউ করলে!’ রাঙাপিসি প্রথমে খানিক ঝলসে উঠল, ‘ধীমু, এই বাড়িতে এই ভাষায় কথা বলাটা অপরাধ!’ তারপর, রাঙাপিসি খুব শান্ত শীতল গলায় ধীমানদাকে বলল, ‘ধীমু, এই বাড়িতে তুমি যতটা স্বাধীন, আমার বউমাও ততটাই
স্বাধীন। ওকে স্বাধীনতা না দিতে পারলে, তুমিও তো পরাধীন!’ সেদিন রাঙাপিসির সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, সম্ভবত,
অন্তত একবারের জন্য ধীমানদার মনে হয়েছিল, তার তথাকথিত আইআইটি খড়গপুর, আইআইএম জোকা আসলে ‘ষোলো আনাই ফাঁকি’!
এই ঠাকুরমা, এই রাঙাপিসি, এই বেলামাসিদের দেখলে মনে পড়ে, একদা আমাদের দেশে সংসারের লৌহকপাট ভেঙে বাইরে বেরিয়ে হীরের মণিমালার বদলে স্টেথোস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে নিয়েছিলেন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। রমণীয় মণিহারের বদলে বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা মালা গলায় পরে মরুবিজয়ের কেতন ওড়াতে মিছিলে নেমেছিলেন ইলা মিত্র। সব হাতকড়া ছিঁড়ে দিয়ে গোলাপ ফুলের মতো হাতে কৃপাণের মতো কলম তুলে নিয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। ওঁরা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন শুধু একটা দেশ নয়, গোটা দুনিয়াটা স্বাধীন হবে সেদিন, যেদিন ‘নারীরা থাকবে জুড়ে পৃথিবীর অর্ধেক আকাশ’!