কর্মে ও ব্যবসায়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য। কৃষিপন্ন বিক্রেতা ও ডাক্তারদের অর্থকড়ি প্রাপ্তি হবে সর্বাধিক। বন্ধুকে টাকা ... বিশদ
একটা সময় ছিল, যখন পুরুষের পোশাক নিয়ে খুব একটা কেউ মাথা ঘামাত না। অফিসের জন্য একঘেয়ে রঙে চেনা চেক বা স্ট্রাইপ শার্ট-প্যান্ট আর উৎসবে পাঞ্জাবি-পাজামা বা ধুতি— ব্যস ওই পর্যন্তই। ক্রমে কাল বদলেছে। ফ্যাশনের পালে হাওয়া লাগিয়ে পুরুষও হয়ে উঠেছে সচেতন। চেনা পোশাকই একটু অদলবদল হয়ে স্মার্ট লুক এনে দিয়েছে নানা বয়সি পুরুষের পরিধানে। এ যুগের পুরুষের পোশাকে যে অভিজাত ছোঁয়া লেগেছে, তা তো একদিনে হয়নি। চলুন বরং ফিরে তাকাই একটু অতীতের দিকে।
নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব’ থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালে পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার চল ছিল না। অখণ্ড একটাই বস্ত্র, যা পুরুষ পরলে হতো ধুতি। আর মেয়েদের জন্য তাই ছিল শাড়ি। এ বঙ্গদেশে এক সময় গাছের বাকল থেকেও কাপড় তৈরি হয়েছে। তারপর সরাসরি বাকল থেকে কাপড় তৈরির পরিবর্তে একসময় এল সুতিবস্ত্র। শন, পাট ইত্যাদি গাছের বাকল থেকে সুতো তৈরি শুরু হল। এর সঙ্গে পাশাপাশি খ্রিস্টপূর্ব ৩০০-৪০০ অব্দের সময়ে বঙ্গ ও মগধে রেশমের চাষ হতো বলে জানা যায় চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে। রেশম ছিল অতি মূল্যবান সুতো। রাজাদের পোশাকের সঙ্গেই যার মিলমিশ ছিল বলা যেতে পারে। ভারতে কিছুদিনের মধ্যে কার্পাস তুলা থেকে সুতো তৈরির কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছিল। বাংলায় কার্পাস সুতোর কাপড় ছিল বেশ ভালো।
সেন যুগে পুরুষের প্রধান পোশাক ছিল ধুতি। কোমরে কটিবন্ধ আর ঊর্ধ্বাঙ্গে উত্তরীয়। পনেরো শতকে উপমহাদেশের পোশাক ও সংস্কৃতিতে আবার যথেষ্ট মুসলিম প্রভাব লক্ষ করা যায়। বাদ পড়েনি বাংলাও। প্রাক-মোগল মুসলিম অভিযানকারীরা, যেমন সুলতান ও খানেরা আঁটসাঁট পাতলুন, কোমরের দিকে সরু ও নীচের দিকে ক্রমশ চওড়া ঘাগড়া-সদৃশ আঁটো আস্তিনের লম্বা কোট পরতেন। যাকে আলখাল্লাও বলা যেতে পারে। সমাজের উপরের তলার লোকদেরই মূলত এ ধরনের পোশাক পরতে দেখা যেত। আমজনতার এ পোশাকে ভাগ ছিল না।
পোশাকের ধারায় বড়সড় পরিবর্তন আসে উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের শুরুতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারত তথা বাংলার পুরুষ পশ্চিমী কায়দায় শার্ট, প্যান্ট, স্যুট, টাই পরতে শেখে। কুর্তা পাঞ্জাবি আর বাঁ কাঁধে শাল ছিল আনুষ্ঠানিক পোশাক। সময় যত এগিয়েছে পাশ্চাত্য পোশাক তত বেশি করে ঢুকেছে ভারতীয় পুরুষের আলমারিতে।
যদিও বিলেত থেকে ফিরে ১৮৮৫ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছিলেন, ‘বাঙ্গালীর পোশাক অতি আদিম ও আদমিক। বাঙ্গালীর কোন পোশাক নাই বলিলেও চলে। যদি জাতি, গুটিকতক সভ্য শিক্ষিত যুবকে না হয়, যদি জাতির আচার ব্যবহার ভদ্রতা শিক্ষা কেবল জগতের পঞ্চমাংশের স্বীকৃত না হয়, যদি অশিক্ষিত লক্ষ লক্ষ কৃষক ও ব্যবসায়ী জাতির মূল হয়, তাহা হইলে দুঃখের সহিত বলিতে হইবে, বাঙ্গালীর কোনই পোশাক নাই।’ আর এর বছর তেরো পরে ১৮৯৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন, ‘আমাদের মধ্যে যাহারা বিলাতি পোশাক পরেন, স্ত্রীগণকে তাঁহারা শাড়ি পরাইয়া বাহির করিতে কুণ্ঠিত হন না। একাসনে গাড়ির দক্ষিণভাগে হ্যাট কোট, বামভাগে বোম্বাই শাড়ি।’
বাঙালি নারীর সাজপোশাকে ঠাকুরবাড়ির প্রভাব নিয়ে প্রচুর কথা হয়। কিন্তু ভুললে চলবে না, সেকালের পুরুষের ফ্যাশনেও ভিন্ন ধারা তৈরিতে ঠাকুরবাড়ির ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের কালো মখমলের জামা, গলায় মোটা সোনার চেন, জমকালো কাশ্মীরী শাল— আভিজাত্যের সেই ছাপ বাঙালির মজ্জায় ঢুকে গিয়েছে একটা সময়। ধুতি সকলের পোশাক হলেও ঠাকুরবাড়ির পুরুষ পরতেন পাজামা ও পিরহান। উৎসবে কেবল জড়ি দেওয়া সিপাই পেড়ে ধুতি।
রবীন্দ্রনাথের লেখায় বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে পোশাক সংক্রান্ত মুহূর্ত। তাঁর নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘ভারতবর্ষের একটা সর্বজনীন পরিচ্ছদ কী হইতে পারে এ বিষয়ে জ্যোতিদাদা তাহার নানা প্রকার নমুনা উপস্থিত করিতে আরম্ভ করেন। ধুতিটা কর্মক্ষেত্রের উপযোগী নহে, অথচ পায়জামা বিজাতীয়, এইজন্য তিনি এমন একটা আপোষ করিবার চেষ্টা করিলেন, যেটাতে ধুতিও ক্ষুণ্ণ হইল, পায়জামাও প্রসন্ন হইল না।’ সেই সাজের বিবরণও দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ— ‘তিনি (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ) পায়জামার উপর একখণ্ড কাপড় পাট করিয়া একটা স্বতন্ত্র কৃত্রিম মালকোঁচা জুড়িয়া দিলেন। সোলার টুপির সঙ্গে পাগড়ির মিশাল করিয়া এমন একটা পদার্থ তৈরি হইল যেটাকে অত্যন্ত উৎসাহী লোকেও শিরোভূষণ বলিয়া গণ্য করিতে পারে না।... জ্যোতিদাদা এই কাপড় পরিয়া মধ্যাহ্নের প্রখর আলোকে গাড়িতে গিয়া উঠিতেন আত্মীয় এবং বান্ধব, দ্বারী এবং সারথি, সকলেই অবাক হইয়া তাকাইত। তিনি ভ্রুক্ষেপ মাত্র করিতেন না।’
শতক গড়িয়ে একসময় পুরুষের পোশাকে লেগেছে বলিউডের ছোঁয়া। এসেছে বেলবটম প্যান্ট আর প্রিন্টেড শার্ট। ফ্যাশন বলতে তখন সেটাই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তারপর ফ্যাশন দুনিয়ায় অনেক বিপ্লব পেরিয়ে এ যুগের পুরুষের পোশাকে এখন কথা হচ্ছে জেন্ডার ফ্লুইডিটি নিয়েও। পুরুষ-নারীর পোশাকে ভাগাভাগি কেন থাকবে? নারী যদি পুরুষের মতো জিনস বা ট্রাউজার্স পরতে পারে, পুরুষ ঘেরওয়ালা পোশাক পরলেই কেন চোখ কপালে উঠবে? লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে সরব যেসব ডিজাইনার, তাঁরা এধরনের প্রশ্ন তুলে পুরুষের ফ্যাশনে এনেছেন চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন। তা নিয়ে কখনও সমালোচনা, কখনও প্রশংসা, কখনও আবার নিন্দে চলছে নানা স্তরে।
এবার পুজোর আগে পুরুষদের ফ্যাশনে কী কী নতুনত্ব থাকছে? তা জানতে কথা বলেছিলাম কলকাতার কয়েকজন ডিজাইনারের সঙ্গে। তার মধ্যে ডিজাইনার অভিষেক দত্ত জানালেন, পুরুষদের জন্য তাঁর এবারের পুজো কালেকশনে রয়েছে ফিউশন ওয়্যার। তাতে রয়েছে বোল্ড প্রিন্টস আর ব্রাইট কালার্স। তিনি এবারের জন্য মাথায় রেখেছেন রিল্যাক্সড স্টাইল। ঘরে বসে কাজের ক্ষেত্রে যেটা খুবই প্রয়োজন। থাকছে ডিজিটাল প্রিন্ট এবং আর্কিটেকচারাল মোটিফে টেক্সচারড এমব্রয়ডারি। অভিজিৎ দত্তের সংগ্রহে রয়েছে শর্টার বন্ধগলা যা যোধপুরী প্যান্ট ও প্রি-স্টিচড ধুতির সঙ্গে টিম আপ করে পরা যাবে। রয়েছে হ্যান্ড এমব্রয়ডারি করা অ্যাসিমেট্রিকাল এবং ড্রেপড কুর্তা। ওয়েস্টার্ন আউটফিটের মধ্যে আছে গ্রাফিক প্রিন্টে বম্বার জ্যাকেট ও লেপেল বম্বার, যেটি অনেকটা বম্বার আর লেপেল-এর মিক্স।
ডিজাইনার দেবারুণ মুখোপাধ্যায় বিশ্বাস করেন সার্কুলার ফ্যাশনে। তাঁর মতে, পোশাক, জুতো বা অন্য অ্যাক্সেসরি যা-ই হোক না কেন, তা যেন ডিজাইন করার পর, একবার ব্যবহার করার পর আবারও পরা যায় এবং এভাবে চক্রাকারে চলতে থাকে। তার জন্য পোশাকটি অবশ্যই হতে হবে টেকসই, পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং বায়োডিগ্রেডেবল। স্থানীয় স্তর থেকে কাঁচামাল সংগ্রহে গুরুত্ব দেন তিনি। দেবারুণ মনে করেন, পোশাক তৈরির পর যত্নে সেটিকে রাখা, প্রয়োজনে মেরামত করা, পুরনোর সঙ্গে নতুনকে মিলিয়ে একটা ব্যতিক্রমী লুক দেওয়া এবং পোশাক অনেকে যাতে নানা উপায়ে পরতে পারেন তার ব্যবস্থা করা খুব প্রয়োজনীয়। একটি পোশাক বারবার পরার পর যখন সেটি আর পরিধানযোগ্য থাকছে না, সেটি রিসাইকেল করে অন্য নতুন পোশাক তৈরিতে কাজে লাগানো যেতে পারে। আর যদি তা-ও করা না যায়, সে পোশাক থেকে কমপস্ট করে যা বেরবে, তা যেন গাছের বা বাস্তুতন্ত্রের অন্য কোনও উপাদানের জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে। অর্থাৎ মানুষের পোশাক তৈরির জন্য পরিবেশ বা আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে কোনও ক্ষতি না করে বরং পরিবেশের জন্য কিছু করা যা আখেরে গোটা সমাজের কাজে লাগবে।
পুরুষদের জন্য পোশাক তৈরি করেন সুরভি পানসারি। তাঁর কালেকশনেও উৎসবের ছোঁয়া লেগেছে। তিনি রেখেছেন হ্যান্ড এমব্রয়ডারি করা কোরাল বন্ধগলা। আছে মিন্ট গ্রিন রঙে অ্যাসিমেট্রিক কাটের বন্ধগলা, যার বুননে সূক্ষ্ম সুতোর কাজ রয়েছে। পাটিয়ালার সঙ্গে টিম আপ করে সেটি একই সঙ্গে আধুনিক পুরুষের জন্য মানানসই ও নজরকাড়া হয়ে উঠেছে। সুরভির করা স্যান্ডস্টোন কালারে পাপড়ির এমব্রয়ডারি করা কুর্তাগুলোও বেশ চোখ টানে। তার সঙ্গে ম্যাচ করে দেওয়া হয়েছে বেজ ধুতি। খুব সৌম্য সাজ পছন্দ যাঁদের, তাঁদের জন্য আদর্শ। বস্তুত এই ডিজাইনারের কালেকশনে থাকা অনেক রংই প্যাস্টেল শেড থেকে নেওয়া, কিন্তু তার মধ্যেই মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ করে এসেছে উৎসবের আমেজ। একরঙা বেজ ধুতি-কুর্তার সঙ্গে রয়েছে নানা উজ্জ্বলরঙা জ্যাকেট, যার সঙ্গে মিলেমিশে সাজ হবে উৎসবের। তাই অভিজাত পোশাকে ব্যতিক্রমী সাজে সেজে উঠতে পারেন একালের নানা বয়সের পুরুষ।
ডিজাইনার কিরো রায়চৌধুরী তাঁর ব্র্যান্ড ১০০ পার্ক স্ট্রিটে সাজিয়েছেন পুজোর সম্ভার। তাঁর সংগ্রহে আছে রাজস্থানি এবং আজরাখ কুর্তা। থাকছে লং জ্যাকেট যা কিনা ইন্দো ওয়েস্টার্ন থিমে সেমি ফরম্যাল হিসেবে পরা যাবে। আর বাঙালি কায়দায় পুজোয় পরার পাঞ্জাবির অর্ডার এসময় বেশিই পাচ্ছেন বলে জানালেন তিনি।