বিদ্যার্থীদের কোনও বৃত্তিমূলক পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। বিবাহ প্রার্থীদের এখন ভালো সময়। ভাই ও বোনদের ... বিশদ
লোকসভা নির্বাচনের ফল পর্যালোচনা করে দেখা গিয়েছিল, তৃণমূল কংগ্রেসের উন্নয়ন ও সামাজিক প্রকল্পের লাভের গুড় সাবাড় করে দিয়েছিল ‘কাটমানি’র পিঁপড়ে। লোকসভা ভোট ছিল কেন্দ্রের সরকার গড়ার নির্বাচন। সেই নির্বাচনে বিজেপি সরকার কী করেছে, তার জবাবদিহি করে ভোট চাওয়াটাই ছিল রীতি। কিন্তু, বিজেপি নেতৃত্ব সে রাস্তায় হাঁটেনি। কারণ ২০১৪ সালে যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, তার অধিকাংশ অপূর্ণ থেকে গিয়েছিল। তাই এরাজ্যের ভোট প্রচারে এসে অমিত শাহ থেকে নরেন্দ্র মোদি কেন্দ্রীয় সরকারের ঢাক না পিটিয়ে কেবল তৃণমূলকেই আক্রমণ করেছিলেন। আর তাতেই হয়েছিল কিস্তি মাত। স্রেফ নেগেটিভ ভোটের সৌজন্যেই বিপুল সাফল্য ঘরে তুলেছিল গেরুয়া শিবির।
লোকসভা নির্বাচনের পর তৃণমূল নেতৃত্ব সেই নেগেটিভ ভোটকে ফেরানো লক্ষ্যেই একের পর কর্মসূচি নিয়েছে। সেই কারণেই প্রশান্ত কিশোরের মতো দক্ষ ‘ভোট ম্যানেজার’কে পরামর্শদাতার কাজে যুক্ত করেছিল। তাঁর পরামর্শেই চালু হয়েছিল ‘দিদিকে বলো’কর্মসূচি। শুধু দলের ভুল ত্রুটি সংশোধন নয়, জনবিচ্ছিন্ন নেতাদের মাটিতে টেনে নামানোর এক অভিনব পরিকল্পনা ছিল এই কর্মসূচিতে। তাঁর দেখানো রাস্তায় হেঁটে রাজ্যের তিনটি উপ নির্বাচনে তাক লাগানো সাফল্যও ঘরে তুলেছিল তৃণমূল। বিপুল বিক্রমে এগিয়ে চলা বিজেপি রীতিমতো ধরাশায়ী হয়েছিল। এমনই এক পরিস্থিতিতে করোনার আর্বিভাব। বন্ধ হয়ে যায় সমস্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি। এরপরই বিধ্বংসী উম-পুন। সাইক্লোনে বিধ্বস্ত জেলায় ক্ষতিপূরণ নিয়েই মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে বিক্ষোভ। সেই বিক্ষোভ বিজেপিকে অক্সিজেন জোগাচ্ছে।
‘গত ইংরেজি ২৫/০৫/২০২০ তারিখে উম-পুন সুপার সাইক্লোনে আমার বাড়ি সম্পূর্ণ রূপে/ আংশিক ভেঙে গিয়েছে। এমতবস্থায় আমি যাতে সরকারি সাহায্য পাই তার সুব্যবস্থা করতে আজ্ঞা হোক। আরও উল্লেখ থাকে এই যে, আমি উক্ত বিবরণ সত্য বলে ঘোষণা করলাম। কোনওরূপ মিথ্যা প্রমাণিত হলে সরকার বাহাদুর আমার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আমার তাতে কোনওরূপ আপত্তি থাকিবে না।’ এটা হুগলি জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া আবেদনপত্রের বয়ান। আবেদনপত্র না বলে মুচলেকা বললে ভুল হবে না। কারণ এই আবেদনপত্রে লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও সরকারি টাকা হাতানোর চেষ্টা করলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন।
প্রশ্নটা হচ্ছে, প্রশাসন বা সরকার কেন মুচলেকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল? দুর্নীতি ঠেকানোই যে উদ্দেশ্য, তা স্পষ্ট। প্রশাসন এবং সরকার চায়, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের হাতেই যাক ক্ষতিপূরণের টাকা।
আবহাওয়া দপ্তরের নিখুঁত বিশ্লেষণে আগে থেকেই জানা গিয়েছিল, এরাজ্যের উপর আছড়ে পড়বে সুপার সাইক্লোন। সেই মতো আগে থেকেই সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল ত্রাণ। বর্ষায় যাতে ঝড়ে ভেঙে পড়া বাড়ির বাসিন্দাদের নাকাল হতে না হয়, তার জন্যই সরকার দ্রুত আথির্ক ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছিল। শুধু বাড়ির জন্য নয়, ধানচাষ থেকে পানচাষ, মাছচাষ, সব ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে উদ্যোগী হয় সরকার। বলতে গেলে, উম-পুনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকার এবার হয়েছিল ‘কল্পতরু’। নজিরবিহীন দ্রুততায় ত্রাণ ও ক্ষতিপূরণের টাকা পৌঁছে দিয়েছিল সরকার। কিন্তু, ব্যক্তিলোভ সেই উদ্যোগেও চোনা ছেটাতে শুরু করে।
হুগলি জেলার চণ্ডীতলা থানার গরলগাছা পঞ্চায়েতের ক্ষতিপূরণের তালিকা প্রকাশ্যে আসতেই চোখ কপালে ওঠে। ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় খোদ পঞ্চায়েত প্রধান নরেন্দ্রনাথ সিংহের স্ত্রীর নাম। প্রধানের দোতলা বাড়িতে আঁচড় কাটাতে পারেনি উম-পুন। তবুও তাঁর স্ত্রীর নাম ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায়। হইচই হতেই প্রধান বদলে ফেললেন তালিকা। দ্বিতীয় দফার তালিকায় স্পষ্ট হল, দুধে জল মেশানো হয়নি, বরং জলে মেশানো হয়েছিল দুধ। কারণ প্রথম তালিকার ১০২টি মধ্যে ৯২টি নামই তিনি নিজে বাদ দিয়ে সংশোধিত তালিকা জমা দিয়েছিলেন। সাফাই, তড়িঘড়ি তালিকা দিতে গিয়েই নাকি এমন বিপত্তি। কিন্তু, ২২ বছরের জনপ্রতিনিধির এই কথা পাগলের পক্ষেও বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। করেওনি।
নরেন্দ্রনাথবাবু কোনও ভুঁইফোঁড় বা চাপিয়ে দেওয়া নেতা নন। এলাকার মানুষ তাঁকে দক্ষ প্রশাসক এবং সংগঠক হিসেবেই চেনেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত গরলগাছা পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্য।
২০১৩ সালে পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি। ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত প্রধান। তাঁরই নেতৃত্বে পঞ্চায়েতের ১৩টি আসনই যায় তৃণমূলের দখলে। অর্থাৎ নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। অধিক ক্ষমতা মানে আরও বেশি দায়িত্ব, এই কথাটাই তিনি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। উল্টে তিনি ফের জন ডেল বার্গের উক্তিকেই অভ্রান্ত প্রমাণ করলেন, ‘পাওয়ার ট্রেন্ডস টু কোরাপ্ট অ্যান্ড অ্যাবসলিউট পাওয়ার কোরাপ্টস অ্যাবসলিউটলি’।
শুধু হুগলির গরলগাছা বা তারকেশ্বর নয়, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর সহ উম-পুনে বিধ্বস্ত সমস্ত জেলা থেকেই ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির নেশায় বুঁদ হয়ে অনেক প্রধানই তাঁদের ঘনিষ্ঠ দোতলা, তিনতলা
বাড়ির মালিকের নাম ঢুকিয়েছেন। তা নিয়েই শুরু হয় ক্ষোভ বিক্ষোভ।
উম-পুনে ক্ষতিপূরণ নিয়ে দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার পর তৃণমূল কংগ্রেস গরলগাছার প্রধানকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে। চুঁচুড়া পুরসভায় মজদুরদের চাকরি নিয়ে দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসতেই বাতিল করেছে নিয়োগের তালিকা। এভাবেই নিতে হবে আরও কঠিন, কঠোর পদক্ষেপ। তবেই মানুষ উপলব্ধি করবে, দুর্নীতিতে সরকার বা প্রশাসনের প্রশ্রয় নেই। আর তা না করে দলের আপদদের সম্পদ ভাবলেই বাড়ে বিপদ। তৈরি হয় ক্ষোভ, বিক্ষোভ। মানুষই তখন তুলে নেয় অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার। যেমনটা হয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়দিঘির পূর্ব কৈলাসপুর গ্রামে। স্বপন ঘাটিকে কান ধরে ওঠবস করে এলাকার মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছেন, নেতা বিচ্যুত হলেই জনগণের চোখে সে হয়ে যায় ‘ন্যাতা’।
ক্ষতিপূরণ নিয়ে স্বজনপোষণের ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই তৃণমূল নেতৃত্ব অভিযুক্তদের ‘দলের সম্পদ’ বলে আড়াল করেনি। উল্টে দল থেকে তাড়িয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, ব্যক্তিলোভের দায় একান্তভাবেই ব্যক্তিগত। দায় দলের নয়। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার সর্বদলীয় বৈঠকের পর জানিয়ে দিয়েছেন, ত্রাণ নিয়ে দলবাজির কোনও জায়গা নেই। তিনি নিজেই চারজনকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের লোককে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া যাবে না বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।
মুখ্যমন্ত্রী এখানেই থেমে থাকেননি। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে ক্ষতিপূরণ পান, তার জন্য নতুন তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। ইতিমধ্যেই জেলায় জেলায় সেই কাজও শুরু হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন সরেজমিনে তদন্ত করে প্রায় ১৫ হাজারজনকে চিহ্নিত করেছে। এঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু, জনপ্রতিনিধিদের তৈরি ক্ষতিপূরণের তালিকায় তাঁরা স্থান পাননি। ইতিমধ্যেই এই জেলায় বিভিন্ন ব্লকে, ব্যাঙ্কে ক্ষতিপূরণের টাকা আটকে দিয়েছে প্রশাসন। হুগলিতে চালু হয়েছে মুচলেকা ব্যবস্থা। এই চাপ জারি রাখতে পারলে প্রমাণ হবে, জনপ্রতিনিধি নয়, শেষ কথা বলবে প্রশাসন। পশ্চিমবঙ্গের বুকে তৈরি হবে নতুন নজির।
দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, মারামারি, খুনোখুনি পার্থিব জগতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। চাওয়া-পাওয়ার জগতে অন্যায়, অপরাধ সংগঠিত হবেই। তাকে ঠেকানোর ক্ষমতা কোনও রাজনৈতিক দলের, কোনও সরকারের নেই। কিন্তু মানুষ চায়, অন্যায়ের প্রতিকার, অপরাধীর শাস্তি। নির্ভয়ার মা তাঁর মেয়ের অত্যাচারীদের ফাঁসির পর বলেছিলেন, আমি খুশি। আমার মেয়ের আত্মা শান্তি পেল।
অপরাধীরা শাস্তি পেলে শান্তি পায় অন্তরাত্মা। তাতে সন্তানহারা মায়ের কোল ভরে না, কিন্তু মন ভরে। প্রশাসনের উপর জন্মায় আস্থা, বাড়ে ভরসা। ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন’ই প্রকৃত শাসকের ধর্ম। একথা আমাদের শিখিয়েছে গীতা।