বিদ্যার্থীদের কোনও বৃত্তিমূলক পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। বিবাহ প্রার্থীদের এখন ভালো সময়। ভাই ও বোনদের ... বিশদ
প্রাক-প্রস্তুতি স্নানযাত্রা
রথের ঢাকে কাঠি পড়ে অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যলগ্নে। ‘দেবস্নান পূর্ণিমায়’ গত ৫ জুন, শুক্রবার স্নানযাত্রার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক সূচনা হল রথযাত্রার। কোভিড কালবেলায় মন্দির প্রাঙ্গণে সেদিন ছিলেন শুধুই সেবাইতরা। গর্ভগৃহ থেকে আনন্দবাজারের ‘স্নানমণ্ডপে’, লোকচক্ষুর অন্তরালে, টিভি ক্যামেরার উপস্থিতিতে সুসম্পন্ন শ্রীজগন্নাথ-দেবী সুভদ্রা-বলভদ্র-সুদর্শন-মদনমোহনের রাজকীয় স্নান উৎসব। ভোর ১.৪০ মিনিটে শুরু ‘ধাড়ি পাহান্ডি’; শোভাযাত্রা সহকারে বিগ্রহদের রত্ন সিংহাসন থেকে স্নান-বেদিতে আনয়ন, জল-বিজে ৩.২০ মিনিটে, মঙ্গল আলাতি ৪.২০ মিনিটে, স্নান বেশ বা ‘সাদাবেশ’ পরিধান ৫.৫০ মিনিটে। তারপর একে একে সমাপন মদনমোহন বিজে, মৈলম, তড়পা লাগি ও আধারা ওছা। অক্ষয়বটের ডালপালার আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি মারছেন ততক্ষণে সূর্যদেব। ১০.৩০ মিনিটে ঝাড়ু হাতে ধূলিমলিন স্নান-মণ্ডপ পরিষ্কার (ছেড়া পহাঁরা) করার কথা ছিল গজপতি রাজা দিব্য সিংহদেবের। জগৎপিতার অধিষ্ঠান হবে সেই পবিত্র-পরিচ্ছন্ন স্নান-মণ্ডপে। কিন্তু লকডাউনের গেরোয় গৃহবন্দি গজপতি রাজা। জগন্নাথদেবের প্রধান সেবকের অনুপস্থিতিতে ‘মুদিরস্ত’ সেবাইত, ১৭ বছরের আদিত্য নারায়ণকে প্রথামাফিক স্নানযাত্রার যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠান মায় ‘ছেড়া পহাঁরা’র শুভারম্ভের দায়িত্ব নিতে হল।
গজপতি রাজা পুরুষোত্তমদেবের সঙ্গে কাঞ্চীর রাজকন্যা পদ্মাবতীর বিয়ের ঠিক হয়েছিল। কাঞ্চীর মহারাজ, সালো নরসিংহ রথের সময়ে গোপনে জামাইয়ের খোঁজখবরে তাঁর মন্ত্রীকে পাঠালেন। মন্ত্রী দেখলেন রাজা পুরুষোত্তমদেব স্বয়ং ঝাড়ু দিচ্ছেন রাস্তায়! মন্ত্রী জানতেন না, সম্মার্জনী হাতে রাজা পুরুষোত্তমদেব ধূলিময় যে পথে ঝাড়ু দিচ্ছেন সেই পথে অনতিবিলম্বে জগদীশ্বরের পা পড়বে! ঝাড়ুদার কখনও পদ্মাবতীর পাণিপ্রার্থী হতে পারে না! কৌলীন্যে ঘা লাগায় বিয়ে ভেঙে দিলেন কাঞ্চীর রাজা। অপমান-অসম্মানে বিপর্যস্ত রাজা পুরুষোত্তমদেব সৈন্যসামন্ত নিয়ে কাঞ্চী অভিযানে চললেন, যুদ্ধে গোহারা হারলেন। দিনরাত জগন্নাথদেবের পাদপদ্মে সমর্পিতপ্রাণ রাজা হৃত মনোবল ফিরে পেয়ে আবারও চললেন কাঞ্চী দখলে। এবার তাঁর সেনাধিপতি, কালো-সাদা ঘোড়ার পিঠে জগন্নাথ ও বলভদ্র, যুদ্ধ জয় নিশ্চিত। পদ্মাবতী বরমাল্য তুলে দিলেন, প্রেমাষ্পদ, বিশ্বের সবচেয়ে কুলীন ঝাড়ুদার, রাজা পুরুষোত্তমদেবের গলায়। গোটা ঘটনাটা যেহেতু রথকেন্দ্রিক তাই স্নানযাত্রা বা রথের সময় ‘ঝাড়ুদান পর্বের’ (আসলে পরিচ্ছন্নতার) রয়েছে বিশেষ মাহাত্ম্য।
বিজ্ঞানসম্মত আচার-অনুষ্ঠান
স্নানযাত্রা পর্বে শীতলা মন্দিরের কাছে ‘সোনা কুয়োর’ ১০৮ ঘড়া জলে বিগ্রহদের স্নান-পর্ব চলে। ষোড়শ উপাচারে হলুদ-চুয়া-চন্দন-চাল-কর্পূর-বিভিন্ন ফুলের নির্যাস-সুগন্ধি মারফত জলকে জীবাণুশূন্য করা হয়। যে সেবাইতরা ‘জল-বিজেতে’ অংশ নেন সংক্রমণ এড়াতে তাঁদের মাস্ক বা মুখাবরণে মুখ ঢাকা বাধ্যতামূলক। বিগ্রহদের মুখও ঢেকে দেওয়ার নিয়ম। তুলসীপাতায় বিগ্রহদের গাত্রমার্জনা চলে। ‘গরাবাড়ু সেবক’রা জল আনবেন, দাদা বলভদ্রকে ৩৩ ঘড়া জলে স্নান করানো হবে, প্রভু জগন্নাথদেবের বরাদ্দ ৩৫ ঘড়া, দেবী সুভদ্রার ২২ এবং সুদর্শনের বরাদ্দ ১৮ ঘড়া জল। স্নান-পর্ব সমাপনে রাতের বেলা দেবতারা ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা লাইক ইলনেসে’ আক্রান্ত হন। ‘অনবসর গৃহে’ বা কোয়ারেন্টিনে স্বেচ্ছায় তাঁরা ১৪ দিন কাটান। নিভৃতবাসে মেনে চলেন শারীরিক দূরত্ববিধি। ভক্তরা ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারবেন না। রাজবৈদ্য বিভিন্ন ভেষজ অনুপানে তৈরি ১২০টি ‘দশমূলা’ মোদক মারফত চিকিৎসা করবেন দেবাদিদেবের। বেল-গামারি-সোনাপতি-গনিয়ারি-শঙ্করজটা-শালপানি-কাঁটাকারি-পারুল প্রভৃতির নির্যাসে তৈরি হবে পাঁচন। গায়ে মাখানো হবে ভেষজ তেল ‘ফুল্লুরি’। সারবে জ্বর, ১৪ দিনের মধ্যেই। ব্রাক্ষ্মণ নন, অন্ত্যজ শবর সম্প্রদায়ের দয়িতারা সেবা শুশ্রূষায় সারিয়ে তুলবেন ত্রিমূর্তিকে, ভেদ-অভেদ জ্ঞানে, টুটে যাবে ছোঁয়াছুঁয়ির জাত-বিচার।
অতিমারী, রথ, প্রাসঙ্গিক কিছু নিদান
সারা পৃথিবীতেই প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে ইনফ্লুয়েঞ্জার আবির্ভাব ঘটে, জগন্নাথদেবও জ্যৈষ্ঠের পূর্ণিমায় ভাইবোনের সঙ্গে আক্রান্ত হন ইনফ্লুয়েঞ্জায়। সঠিক বিজ্ঞানসম্মত স্বাস্থ্যবিধিতে মুখাবরণে, দূরত্ববিধি মেনে, কোয়ারেন্টিনে থেকে শীঘ্রই সপারিষদ তিনি সেরেও ওঠেন। কিন্তু এখন দেখুন, তাঁর ভক্তকুল বেঘোরে মারা পড়ছেন এই সামান্য অনুশাসন ঠিকঠাক পালনের অনীহায়। ১৪ দিনে, ছাপ্পান্ন ভোগের চর্বচষ্য ছেড়ে ফলাহার ও প্রোটিন সমৃদ্ধ দুগ্ধজাত নানা সুখাদ্যে ত্রিমূর্তি ‘ইমিউনিটি’ বাড়িয়ে তোলেন, তারপর রথের দিন সুস্থ শরীরে, ফুরফুরে মেজাজে ‘নবযৌবনবেশে’ মাসির বাড়ি বেড়াতে যান। জগন্নাথদেবের প্রতিটি আচরণে স্পষ্ট মহামারী বা অতিমারীকে পরাভূত করার নিপুণ বৈজ্ঞানিক কৌশল। মানুষ আর সার্স সিওভি-টু—দুটিই প্রাকৃতিক নির্বাচনের সুবিধাপ্রাপ্ত, প্রকৃতির আশীর্বাদধন্য। জগদীশের দরবারে মানুষ এবং ভাইরাস—দুটিই অনন্যসাধারণ। প্রকৃতিতে ভারসাম্য রক্ষা করতে ভাইরাসের মারণ-খেলাও নিতান্ত প্রয়োজন। কিন্তু বিশ্বপিতা সেই ঘাতক ভাইরাসের করাল গ্রাস থেকে বাঁচার কৌশল নিজেই নিজের আচরণের মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে বুড়বাক মানুষকে দেখিয়ে/শিখিয়ে দিচ্ছেন। বলে দিচ্ছেন চিকিৎসা-ওষুধ-টিকার অভাবে কৌশলে কীভাবে পরাজিত করতে হবে হন্তারক ভাইরাসটিকে! ভ্রুক্ষেপ-হীন তথাপি অসচেতন-অর্বাচীন কূপমণ্ডূক মানুষ!
নিচুজাতের শবর দয়িতাদের ভক্ষণ করা ফল আহ্লাদে খেয়ে পুরুষোত্তম বলছেন মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বিশেষত: অতিমারীর সময়ে সমূলে বর্জনীয়। মানুষ রোগ ছড়ায় না। ছড়ায় জীবাণু বা ভাইরাস। তাই মানুষের সঙ্গে ভাইরাসের মত কুৎসিত আচরণ কাম্য নয়। ক্ষতিকর জীবাণুনাশক দিয়ে অসহায় নিরালম্ব মানুষকে (পড়ুন পরিযায়ী শ্রমিক) জন্তুর মত চান করানো অনুচিত। তাঁর আচরণে সুস্পষ্ট, ইনফ্লুয়েঞ্জার মত ছোঁয়াচে অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়া একটি রোগকে বাগমানাতে ছোট্ট একচিলতে জায়গায় বহু-মানুষের একত্রিত না হওয়াই বাঞ্ছনীয়, শারীরিক দূরত্ববিধির অভাবে দাবানলের মত তাতে ছড়িয়ে পড়বে রোগটি। কিন্তু তাঁর দীঘল, আয়তাকার, নির্লিপ্ত, অকর্মক চোখের অন্তরালের হিরণ্যগর্ভ উপলব্ধি ও অমোঘ চেতাবনির অর্থ মানুষের কর্ণের মধ্যে দিয়ে মরমে পশে বিন্দুমাত্র অভিঘাত তুলতেও অপারগ। তাই দু-শিফটের কাজে তৈরি অর্ধসমাপ্ত রথের খণ্ডহর অনাদরে রাস্তায় পতিত। আর পতিতপাবন, তিনি, ক্ষুদ্র মানুষের বালখিল্যতায় মূঢ়ম্লান।
অতিভক্তির বিপদ
কোভিড কালবেলায় অযোধ্যায় রামলালার জন্মদিন বাড়িতেই পালনের সুপরামর্শ দিয়েছে সরকার, এবছর। ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদের’ বিনোদ বনসাল বলছেন পুণ্যার্থীদের বঞ্চিত করার কাজটা মোটেই ঠিক হয় নি। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে শারীরিক দূরত্ববিধি গোল্লায় যাওয়ায় ইরান সরকার যখন ‘মাসাড’ আর ‘কোম’ মসজিদ বন্ধ করলো ইরানের কয়েকজন ধর্মগুরু তখনও সোচ্চারে বলেছিলেন কাজটা ঠিক হয় নি। বহু-মানুষের একজোট হওয়ার নিষেধকে কাঁচকলা দেখিয়ে, ‘হাসিডাক’ ইহুদি সম্প্রদায়ের ভিড়েঠাসা একটি বিয়ের আসর থেকে নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে রাতারাতি কোভিডে সংক্রমিত হলেন ৫২ জন। তথাপি ফিরলো না হুঁশ। একাধারে আকুলপ্রাণে ভগবানকে কোভিড পরিত্রাণের রাস্তা বাতলানোর সজল মিনতি, অন্যদিকে তাঁর দেখানো পথকেই সজ্ঞানে অবহেলা করা! কোভিড অতিমারীর দোহাই পেড়ে নিরপরাধ মানুষকে একঘরে করা! আমেরিকার ‘লঙ আইল্যান্ডে’ ১৯০০ সালে উপসর্গহীন ‘মেরী ম্যালন’ ৫১ জনের শরীরে নিঃশব্দে চারিয়ে দিয়েছিলেন টাইফয়েড, মারা গিয়েছিলেন ৩ জন। ইতিহাসে কুখ্যাত ‘টাইফয়েড মেরী’ তিনি। অপরাধের শাস্তিস্বরুপ নর্থ ব্রাদারের ‘রিভারসাইড হাসপাতালে’ ২৬ বছর কোয়ারেন্টিনে কাটাবার পর ১৯৩৮এ তিনি মারা যান। তাঁর চোখের জলের হিসাব রেখেছেন শুধু ঈশ্বর। ভারতে আজ করোনা রোগী শুধু নন, চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদেরও একঘরে করা হচ্ছে, করোনা আক্রান্তের বাড়িতে স্টিকার সেঁটে দেওয়া হচ্ছে, আরোগ্য সেতুর মাধ্যমে পাশের সুস্থ/নীরোগ মানুষটিকেও সন্দেহভাজন করে তোলা হচ্ছে। পুলিস করোনা রোগীকে অপরাধীর মত কোথাও টেনে হিঁচড়ে কোয়ারেন্টিনের কয়েদখানায় চালান করছে। ভাইরাসটির বদলে কখনও-বা অচ্ছুত অস্পৃশ্য করোনা রোগী তুমুল রোষের শিকার হচ্ছেন। রথের পুণ্যতিথিতে শ্রীজগন্নাথদেবের শরণাগত হয়ে সেই মানহারা মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো আজ জরুরি। হিংস্র প্রলাপের মাঝে সেটাই হবে সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।