বিদ্যার্থীদের কোনও বৃত্তিমূলক পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। বিবাহ প্রার্থীদের এখন ভালো সময়। ভাই ও বোনদের ... বিশদ
অনেকটা যেন সেই খেলার ছলেই নেপালের ওলি সরকার হঠাৎ নতুন মানচিত্র করে ভারতের লিম্পিয়াধুরা, কালাপানি ও লিপুলেখকে নিজেদের সীমান্তভুক্ত করে নেপালের অঞ্চল বলে ঘোষণা করে। সেইমতো গত ১৩ জুন, ২০২০ নেপাল পার্লামেন্ট নতুন মানচিত্রে সম্মতি দেয়। সর্বসম্মতিক্রমে সংবিধান সংশোধন বিলটি পাস করে। যদিও গত ৩১ মে এই মানচিত্র বদলের খসড়া পেশের সময় পার্লামেন্টের এক সদস্য সরিতা গিরি একটি সংশোধনী প্রস্তাবে এ ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু স্পিকার অগ্নিপ্রসাদ সাপকোটা নিজ ক্ষমতাবলে প্রস্তাবটি বাতিল করে দেন। চীনের প্ররোচনায় ও পরামর্শে নেপাল সরকার চরম পথ গ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।
ভারত-নেপাল সম্পর্ক যুগ যুগ ধরে প্রতিষ্ঠিত। ছোট্ট দেশটির সামরিক এবং আর্থিক ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু আধুনিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নেপালের গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম। তাই চীন দীর্ঘদিন ধরে নেপালকে গ্রাস করার চেষ্টা করছে। এতদিন তা সফল হয়নি। কারণ, ভারত ও নেপালের সম্পর্ক অত্যন্ত আন্তরিক এবং গভীর বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই দেশ-বিদেশে এবং আন্তর্জাতিক-রাজনৈতিক মঞ্চে নেপাল সর্বদাই ভারতের পক্ষে থেকেছে, ভারতের পক্ষে সোচ্চার হয়েছে। অপরদিকে ভারতও নেপালের স্বার্থরক্ষায় ও উন্নয়নে সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা করেছে। নেপালের রাস্তাঘাট, পরিবহণ, পরিকাঠামো নিজ দায়িত্বে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে গড়ে দিয়েছে। তাছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, জ্বালানির তেল প্রয়োজন মতো সরবরাহ করেছে। এই বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়েছে উভয় দেশের সংস্কৃতিগত মিলের জন্য।
উভয় দেশের ঐতিহ্য উন্নত। উভয়েরই আদর্শ শান্তি ও সহযোগিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। উভয় দেশের আধ্যাত্মিক চর্চা, পূজা-অর্চনা, ধর্ম প্রায় একই। তাই উভয় দেশের আসা-যাওয়া, মুদ্রা এবং ভাষা পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতার প্রতীক। পারস্পরিক সম্পর্কের এই বন্ধনে কিছু অদ্ভুত নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন ভারত ও নেপাল সরকার দু’দেশের সেনাপ্রধানকেই নিজ নিজ দেশের ‘সাম্মানিক সেনাপ্রধান’ হিসেবে নিয়োগ করে। গত বছরেই নেপালের নবনিযুক্ত সেনাপ্রধানকে ভারতের সাম্মানিক জেনারেল পদ প্রদান করা দেওয়া হয়। আন্তরিক সম্পর্ক ও বিশ্বাসকে ভেঙেচুরে নেপাল এমন একটা বালখিল্যেরর মতো সিদ্ধান্ত নিল, যা বেদনার। তার মানে চীনের নির্দেশ নীরবে, বিনাপ্রতিবাদে পালন করাই এখন ওলি সরকারের নিয়তি।
কয়েক দশক ধরে চীন নেপালে অনুপ্রবেশে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের রূপরেখা তৈরি করেছিল। প্রথম দিকে চীন নেপালের মাওবাদী-জঙ্গি আন্দোলনকে অর্থ, অস্ত্র, আশ্রয় দিয়েছিল। তারপর অতি জঙ্গিনেতা প্রচণ্ডের উত্থানে চীন হাতে চাঁদ পায়। তখন থেকেই সরাসরি নেপালের শাসনভার দখল করে একটি পুতুল সরকার গঠনে তৎপর হয়। মাওবাদী নেতা প্রচণ্ড প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় চীনের ষড়যন্ত্র দ্রুত সফল হয়। কিন্তু চৈনিক পুতুল প্রচণ্ডের অযোগ্যতায় সরকার বেশিদিন টেকেনি। তখন চীন তার পরিকল্পনায় কিছু বদল ঘটায়। নয়া উপনিবেশবাদী তত্ত্ব অনুসারে চীন সাহায্যের ঝুলি নিয়ে নেপালের অন্দরে প্রবেশ করে। ক্রমশ ভারতকে সরিয়ে তার স্থান দখল করে। তার এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গী ছিল পাকিস্তান। সেইসঙ্গে চীন নেপালের রাজনৈতিক দলগুলির ওপর তার প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে।
ইতিমধ্যেই রাজতন্ত্রের বিলোপ, রাষ্ট্রের ‘হিন্দুত্ব’ ঘুচিয়ে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র নীতি গ্রহণ, সংবিধান সংশোধন, মদেশীয় আন্দোলন প্রভৃতি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নেপাল উত্তাল হয়ে ওঠে। রাজতন্ত্র উচ্ছেদের ব্যাপারে প্রায় সব দল একমত হলেও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে মতানক্যৈ ছিল। সরকার গণভোট নিতে চায়। কিন্তু চীন ও পাকিস্তান মত বদলাতে বাধ্য করে। কারণ, নেপালের ৯৪ শতাংশ মানুষ হিন্দু। মজার কথা হল, যে পাকিস্তান ও চীন কাশ্মীরে গণভোটের জন্য গলা ফাটাচ্ছে, তারাই নেপালে গণভোট করতে বাধা দিচ্ছে। তাই নেপাল সরকার রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে পরামর্শ করে সংবিধান সংশোধন করে। কিন্তু নতুন সংবিধানে মদেশীয়দের প্রতি অন্যায় হয়েছে। তারা প্রবল প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলে। সরকার মদেশীয়দের উপেক্ষা করায় মদেশীয়রা নেপাল-ভারত সীমান্তে পথ অবরোধ করে। নতুন সংবিধানে কয়েকটি ধারার বিরুদ্ধে নেপালের নারীসমাজ প্রবল বিরোধিতা করে। কারণ, নতুন সংবিধানে নারীসমাজের প্রতি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা রয়েছে।
যাই হোক, মদেশীয়দের দীর্ঘ পথ অবরোধের ফলে নেপাল ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। খাদ্য, শস্য, তেল, নির্মাণসামগ্রী ও পর্যটক আসা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে নেপালে এক গভীর সঙ্কট সৃষ্টি হয়। চীন তার সুযোগ নেয়। ভারত নিরুপায়। নেপালের চাহিদামতো ভারত সবকিছু পাঠাতে তৈরি ছিল, কিন্তু অবরোধের জন্য পারেনি। নেপালকে বোঝাল চীন: ভারত ইচ্ছে বিপদে ফেলেছে, তার স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য। এই অবস্থায় চীন তেল ও খাদ্যসহ বহু দ্রব্যাদি নেপালে পাঠাল। ফলে, নেপালের ভারতনির্ভরতা কমল। বলতেই হয় যে, এটা ভারতের কৌশলগত ব্যর্থতা। কারণ, মদেশীয়দের ওপর ভারতের গভীর প্রভাব ছিল। তাই ভারত চেষ্টা করলে অবরোধ উঠতে পারত এবং চীনের প্রবেশ তাতে রুখে দেওয়া যেত। ভারতের বক্তব্য ছিল, আমরা চেষ্টা করেও পারিনি। কারণ, মদেশীয়দের অস্তিত্ব যুক্ত ছিল।
মদেশীয়রা ভারতীয় বংশোদ্ভব। নেপালে একটি বৃহত্ সম্প্রদায়। অথচ নতুন সংবিধানে মদেশীয়দের জন্য মাত্র ৫৬টি আসন রেখে ‘পাহাড়ি’ কাঠমান্ডুর জন্য ১০০টি আসন রাখা হয়। তাছাড়া, এমনভাবে মদেশীয় অঞ্চলে নির্বাচনী কেন্দ্র বিন্যাস করা হয়, যাতে মদেশীয়রা কিছুতেই সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করতে না-পারে। তাদের উন্নয়নের নানা দাবিকে সরকার নস্যাৎ করেছে। তাই পথ অবরোধ তুলতে তারা রাজি হয়নি। অবশেষে, ভারতের হস্তক্ষেপে নেপাল সরকার সংবিধানের কিছু সংশোধন করতে এবং মদেশীয়দের কিছু দাবি মেনে নিতে রাজি হয়। ১৩৫ দিনের অবরোধ ওঠে। কিন্তু তত দিনে ভারতের ভুলে উভয় দেশের সম্পর্কে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।
আলোচ্য তিনটি এলাকার আয়তন চারশো বর্গ কিমি। সামরিক দিক থেকে এর গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া কৈলাশ ও মানস তীর্থযাত্রীরা যুগ যুগ ধরে লিপুলেখ ব্যবহার করেন। চীন অধিকৃত তিব্বত লাগোয়া পিথোরগড় জেলার এই অঞ্চলটি নেপাল মারফত চীন নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। চীন ইতিমধ্যেই নেপালে রাস্তা নির্মাণের নামে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত এমন সংযোগ তৈরি করেছে যে, প্রয়োজনে নেপালের ভেতর দিয়ে উত্তরবঙ্গের বাগডোগরায় সহজে পৌঁছনো যাবে। অথচ ভারতের বিদেশমন্ত্রক এবং গোয়েন্দা বিভাগ নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমিয়েছে। নেপাল চাইলেও ভারত আলোচনার সময় পায়নি। নেপালের নতুন মানচিত্র পার্লামেন্টে পাস হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরে বিজেপি নেতাদের সভায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ বললেন, ‘এটা সামান্য ভুল বোঝাবুঝি। দুই দেশই মাকালীর ভক্ত, বিশেষ করে কলকাত্তা কালী, কামাখ্যা কালী ও বিন্ধ্যাচল কালীর। মাকালীই আমাদের রক্ষা করবেন।’ ঘটনার চল্লিশ ঘণ্টা পরে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘আমরা এটা মানব না।’ কী করবেন তিনি?
নেপালে ভারত-বিরোধী প্রচার তুঙ্গে। তাই করোনা পরিস্থিতিতে প্রচুর ওষুধ, কিট ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পাঠানোর পর নেপাল সরকারের একজন বললেন, ‘আমাদের সাহায্যের নামে করোনা ভাইরাস পাঠিয়েছে ভারত!’ বোবা এবং বোকা ভারত সরকার। নির্লিপ্ত। তাই নেপালের জের না কাটতেই চীন আবার এক থাপ্পড় কষাল মোদি সরকারের গালে। সরকারের ভ্রান্ত-নীতি ও নির্দেশের (সেনা বাহিনীকে) জন্য বিশজন ভারতীয় বীর সেনা লাদাখে শহিদ হলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘আমরা ঘটনার প্রতি নজর রাখছি, চুপ করে থাকবো না।’ ভারতের বিশাল এলাকা গত দু’মাস চীন দখল করে রেখেছে। বিরোধীরা সরব হলেও সরকার তা চাপা দিতেই ব্যস্ত। আসলে, এখন সরকারের তৎপরতা বিরোধী সরকার ভাঙতে এবং রাম মন্দির গড়তে।
লেখক কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথ কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তন অধ্যাপক