বিদ্যার্থীদের কোনও বৃত্তিমূলক পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। বিবাহ প্রার্থীদের এখন ভালো সময়। ভাই ও বোনদের ... বিশদ
কিন্তু দেশটি একদিনে এই উচ্চতায় ওঠেনি। দু’টি পুরনো কাহিনীতে নতুন করে চোখ রাখা যায়। উত্তর চীনের তাচাই অঞ্চল। ঢালু বালিময় রুক্ষ প্রান্তর। ন্যাড়া মাটির পাহাড়। চাষ-আবাদের কথা দুঃস্বপ্নেও কেউ ভাবেনি। গত শতকের ষাটের দশক। ৩৬০ জন কৃষকের এক সমবায় মরুবিজয়ের কেতন ওড়াল। চাষিরা পাহাড়ের ধাপে ধাপে বাঁধ দিলেন। মাটি বয়ে নিয়ে ভরাট করলেন। যা দেখতে বিশালাকার টবের মতো হল। ভাবলে অসম্ভব মনে হয়। সেটাই সম্ভব করলেন মহাপ্রাচীর নির্মাণের ঐতিহ্যকে স্মরণ করে। ১৯৬৩-তে হল প্রবল বন্যা। তাচাইয়ের এত মেহনত জলে গেল। নিয়মানুসারে ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য। কিন্তু চাষিরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে তা নিলেন না। ফের একইরকম নিষ্ঠা ও শ্রমে সেই গ্রাম গড়লেন। এত ফসল ফলালেন যে উদ্বৃত্ত হল!
১৯৫৮। সাংহাই। একটি কারখানা শুরু হল ১২ জন শ্রমিক নিয়ে। তাঁদের মধ্যে চারজন দৃষ্টিহীন এবং চারজন মূক ও বধির। সূচনা হয়েছিল হাতে চালানো ছোটখাটো যন্ত্র দিয়ে। ’৬৭-তে শ্রমিক বেড়ে হল ৪৬০ জন। তাঁদের মধ্যে ৩৩০ জন প্রতিবন্ধী। দৃষ্টিহীন এবং মূক-বধিরদের কাজ নির্দিষ্ট করা থাকে। তাঁরা সেইমতো মেশিন চালিয়ে কাজ করেন। মূক-বধিররা সঙ্কেতে কথাবার্তা বলেন। দৃষ্টিহীনরা পড়েন, লেখেন ব্রেইল পদ্ধতিতে। কারখানার পরিচালন ব্যবস্থায় যথেচ্ছাচারের প্রতিবাদে আন্দোলন করলেন দৃষ্টিহীনরাই। কমিউনিস্ট পার্টির স্থানীয় নেতৃত্ব ভুল স্বীকার করলেন। প্রতিকার পেলেন শ্রমিকরা। এহেন কারখানাও দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় অবদান রাখে। মাও সে তুং, চৌ এন লাইয়ের দেশে কেউ করুণার পাত্র নয়। প্রতিবন্ধীরাও না। সমাজগঠনে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু দিতে পারেন। কারও দান ছোট নয়।
লর্ড বেন্টিঙ্ক। ব্রিটিশ গভর্নরদের মধ্যে কিছুটা ব্যতিক্রম। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দ। এক রিপোর্টে তিনি লেখেন—'বাণিজ্যের ইতিহাসে তাঁদের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনীর কোনও তুলনা নেই। তাঁতিদের কঙ্কালে ভারতের পথঘাট সাদা হয়ে উঠেছে।'
বিলিতি পণ্যে ভারতের বাজার ছয়লাপ করে দেওয়ার মতলবেই দেশীয় শিল্প ধ্বংস করা হয়।
সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দু'হাতে লুটে নেওয়া অর্থ এবং অন্যান্য ধনসম্পদ বিলেতে পাচার করার প্ল্যানের বিরুদ্ধে রামমোহন থেকে নৌরজি—অনেক মনীষী সরব হন।
ইংরেজরা করেছিল ভারতে ঢুকে। বণিকের বেশে এসেছিল। সুচ থেকে ফাল হওয়ার ম্যাজিক সাহেবরা দেখিয়েছে। বণিকরাই একচ্ছত্র শাসক হয়ে উঠেছিল। শাসনক্ষমতা দখল করার পর দখলে নিয়েছিল ভারতবাসীর ইচ্ছে-অনিচ্ছেটুকুও।
আজকের চীন করছে দূর থেকে। বন্ধুত্বের ছলনায়। বিশ্বায়নের বাধ্যবাধকতার সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রবেশ করে। চীন প্রবেশ করেছে ভারতের আলপিন টু এলিফ্যান্ট মার্কেটে। শুধু ভারতের বাজার দখল করেনি, দখল করেছে প্রতিবেশী দেশগুলিরও বাজার। ভারতের পণ্য উৎপাদন যেসব দেশে রপ্তানির উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। প্রতিবেশী দেশগুলিতে ভারতের পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলিও সঙ্কুচিত করে দিতে মরিয়া বেজিং।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, চীন একে একে ভারতের এবং প্রতিবেশীদের বাজারের দখল নিচ্ছে। প্রতিবেশীদের উস্কানি দিচ্ছে ভারত সম্পর্কে বিরূপ হওয়ার জন্য। চেষ্টা করছে ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত বিরোধে নতুন মোড় দিতে। আকসাই চীন ’৬২-তে দখল করেছে লালফৌজ। এখন তাদের লক্ষ্য, ভারতের ভিতরে ঢুকে চীনের ভূখণ্ডের আয়তন তস্করের মতো কিছুটা বাড়ানো।
সম্প্রতি লাদাখের গলওয়ানে ঘটে যাওয়া আগ্রাসনের পর ভারতকে ভাবতেই হচ্ছে, চীনের দূর লক্ষ্যটা কী? মানচিত্র কিছুটা চওড়া করেই কি থামবে মাওয়ের দেশ? কমিউনিস্ট চীনের প্রথম চেয়ারম্যানের অপূর্ণ স্বপ্ন তো এত সামান্য নয়। তা যে আরও অনেক বড় …! জিনপিংয়ের লালসা দেখে মনে হয়, তিনিই মাওয়ের যোগ্যতম উত্তরসূরি। এর পাথুরে প্রমাণ রেখে যেতে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ! ২০১৭-তে ভুটান সীমান্তের ডোকলামে জি জিনপিং প্রশাসনের অসভ্যতার সময়েই বুঝে নেওয়া দরকার ছিল। নেপালে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পিছনে চীনের অতি উৎসাহ দেখেই বুঝে নেওয়া দরকার ছিল। পালা বদলের পর থেকে নেপাল সরকারের উগ্র চীন-প্রীতির ভিতরেও রসদ রয়েছে। মশলা রয়েছে ইমরান সরকারের তিড়িবিড়িংয়ের ভিতরেও। এত বার চীনের মুখচিত্র পড়তে না-পারার মূল্যই কি দিতে হচ্ছে ভারতকে? এবার উপলব্ধি করা দরকার, চীন কি একবিংশ শতকের প্রধান সাম্রাজ্যবাদী হয়ে উঠতে বদ্ধপরিকর? অথচ, এই চীন একদিন ভারতবন্ধু সোভিয়েত রাশিয়ার নিন্দে করত ‘সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী’ বলে!
বয়কটের ইতিহাস ১৪০ বছরের পুরনো। বয়কট আন্দোলনের শক্তিটা আমরা জানি। কিন্তু চীনকে নিয়ে এই যে সঙ্কট, তাতে এই অস্ত্রের কার্যকারিতা কতটুকু?
প্রথমে আসা যাক উচিত শিক্ষা দেওয়ার প্রসঙ্গে। চোখে চোখ রেখে কথা বলা। গর্জন। আস্ফালন। এসব চলতেই পারে। কিন্তু সামরিকভাবে উচিত শিক্ষা দেওয়ার দিন আজ কতটা বাস্তব? ভারত চীন, দুটি দেশই যে পরমাণুশক্তিধর! সেক্ষেত্রে কূটনৈতিক লড়াই অনেক নিরাপদ। দুই দেশের জন্যই। আঞ্চলিক শান্তি সুস্থিতির
পক্ষেও। সবার আগে প্রতিবেশীসহ নিকটবর্তী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক আরও উন্নত করতে হবে। তারপর পাশে পেতে হবে বিশ্ব জনমত। চীন যে কী বস্তু তা করোনা-বিধ্বস্ত পৃথিবী জানে। এখন কাজটা খুব কঠিন নয়। ভারতের আজকের গার্জেনদের মুনশিয়ানার পরীক্ষা এখানেই।
‘ছেড়ে দাও রেশমি চুড়ি বঙ্গনারী/ কভু হাতে আর প’রো না’-র দিন তো দু’হাজার কুড়ি নয়। চীনকে বা চীনা পণ্য বয়কটের যে আওয়াজ উঠেছে, তার ভিতরে স্বদেশি যুগের আবেগ কিছুটা আছে বটে, প্রকট হচ্ছে বাস্তব বোধের অভাবটিও। সেদিন রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের বাধ্যবাধকতা ছিল। মানুষ কৃচ্ছ্রসাধন করেছিল পুণ্যার্জনের জ্ঞানে।
স্বাধীন দেশের নাগরিককে সেই পথে হাঁটতে আজ বাধ্য করা যায় না। চীনকে সর্বতোভাবে ত্যাগের জন্য অন্তত সমমানের বিকল্প রাখতেই হবে। উন্নততর বিকল্পের দাবিটা পরবর্তী অধ্যায়।
রবীন্দ্রনাথ সেদিন রাষ্ট্রের উপরে সমাজকে স্থান দিতে বলেছিলেন। ব্রিটিশ রাজশক্তির কথা মনে রেখে বলেছিলেন, সুগঠিত সমাজকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন শেষ করতে পারে না। সমাজ তার প্রাণশক্তি দিয়ে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ। কিন্তু রাষ্ট্রনির্ভর দেশ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কবি গ্রিস ও রোমের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। বিপরীতে বার বার বিদেশিদের হাত লুণ্ঠিত হওয়ার পরেও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ভারত। সমাজপ্রধান দেশের লক্ষণ: পরমুখাপেক্ষী নয়। সততার সঙ্গে দেশের বুদ্ধিশক্তি ও কর্মশক্তিকে সংঘবদ্ধ করে। দেশের সব প্রান্তে এই আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার উপর গুরুত্ব দেয়।
গ্রিক ‘autarkeia’ থেকে এসেছে ইংরেজি ‘autarky’। অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা। প্রাণশক্তিতে ভরপুর এক সমাজের কথাই রবীন্দ্রনাথ কল্পনা করেছিলেন। মোদিজির গলাতেও অবিকল সেই সুর। এমন সমাজনির্ভর দেশ বিশ্বাসঘাতক চীনকে রুখতেই পারে। কিন্তু সেই সংঘবদ্ধ সমাজ তৈরির প্রথম শর্তটি যে সততা! রাষ্ট্রনির্মাণ প্রক্রিয়ার ভিতরে তার কতটুকু অবশিষ্ট রেখেছে ভারতের আজকের রাজনীতি? যে-দেশে একটি প্রকল্প গড়ার আগে শাসক দল অঙ্ক কষতে বসে জায়গাটিতে বিরোধীদের প্রভাব বেশি কি না কিংবা সামান্য ত্রাণ থেকে বিধবাভাতা, সবেতেই রাজনীতি পার্সেন্টেজ চায়, সেই দেশ শিল্প-বাণিজ্যে চীনকে টক্কর দেবে!
বুদ্ধির জড়তা না এলে সম্প্রীতির সঙ্কট অনিবার্য করে তোলা যায় না। এজন্য অবশ্যই দুয়ো প্রাপ্য জিনপিংয়ের। কিন্তু, এই বয়কটের রাজনীতির ভিতরে তুঘলকের পরিণতি কিছুমাত্র লুকিয়ে নেই কি?