বিদ্যার্থীদের কোনও বৃত্তিমূলক পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। বিবাহ প্রার্থীদের এখন ভালো সময়। ভাই ও বোনদের ... বিশদ
গত ১৫ জুন গলওয়ান ভ্যালিতে ঘটে যাওয়া বর্বর-কাণ্ড গোটা বিশ্বের সবরকম সংবাদমাধ্যমই শিরোনামে যথাসম্ভব তুলে ধরেছে। ভারত-চীন সীমান্ত নিয়ে কয়েক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা বিতর্ক নিয়ে বহু মতামত রয়েছে। ‘সুপার পাওয়ার’ হিসাবে চীনের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কোনও গোপনীয়তা নেই। তবে করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হিসাবে চিহ্নিত চীন গত কয়েকমাস ধরে গোটা বিশ্বের বহু দেশের মারাত্মক চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। চীনের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ব্যাপকভাবে নিম্নমুখী হচ্ছে। চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো বা এনবিএসের দাবি, ১৯৯২ সালের পর চীনের জিডিপির হার চলতি আর্থিক বছরে সবচেয়ে কমে ৬.২ শতাংশ হয়েছে। কনফারেন্স বোর্ড ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের মতো সংস্থার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এই হার কমে ৪.১ শতাংশ হয়েছে। ২০১৩ সালে ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ (ওবিওআর) নামে চীন সরকার বিশ্বব্যাপী যে উন্নয়নমূলক নীতি চালু করে তাতে দুনিয়ার প্রায় ৭০টি দেশের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বিনিয়োগের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল। কোভিড পরবর্তী সময়ে এর সদস্য দেশগুলি এখন গম্ভীরভাবে তা পর্যালোচনা করে দেখছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ওবিওআর এর প্রধান সদস্য দুই দেশ ইরান এবং ইতালি ভৌগোলিকভাবে চীনের থেকে অনেক দূরে থাকলেও সেখানে কোভিডের অতিমারী আছড়ে পড়েছে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের (সিপিইসি) আওতায় পাকিস্তানের গাওয়াদর বন্দর পর্যন্ত পরিকাঠামো উন্নয়ন করার যে নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তার উল্লেখযোগ্য কোনও বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে না।
চীনের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে হংকং এবং তাইওয়ান সরকারের অসন্তোষ গোটা বিশ্বের সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনা ভাইরাসের প্রবর্তক হিসাবে চীনকে খোলাখুলি হুমকি দিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়া সরকার উহানের ল্যাবরেটরি নিয়ে তদন্তের দাবিতে সরব হয়েছে। বহু দেশ থেকে চীনা কোম্পানিগুলিকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। আফ্রিকা এবং এশিয়ার দেশগুলি থেকে চীনা ফার্মগুলির বহু চুক্তি বাতিল করিয়ে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছে তারা। সবশেষে ২০ মে থেকে তিনটি মার্কিন যুদ্ধবিমানবাহী রণতরীকে (ইউএসএস আমেরিকা, ইউএসএস রুজভেল্ট, ইউএসএস রেগন) দক্ষিণ চীন সাগরের মাঝামাঝি অবস্থানে রেখে দিয়ে চীনকে সম্পূর্ণ একঘরে করে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এই মুহূর্তে কোনও দেশকে চীনের বন্ধু বলে সম্বোধন করা কঠিন। পাকিস্তান, নেপাল এবং অন্যান্য যে অল্প কয়েকটা দেশ চীনের চাটুকার হয়ে রয়েছে তাদের বন্ধু বলে ডাকা যায় না। এত কিছুর মধ্যেও কোভিডের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ নিয়েও চীনের প্রধানমন্ত্রী লাই শিয়াং এবং প্রেসিডেন্ট জি জিনপিংয়ের মধ্যে মারাত্মক মতপার্থক্য রয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। লাই শিয়াং বাণিজ্যের দিক থেকে একজন অর্থনীতিবিদ এবং চীনা অর্থনীতিতে আর্থিক সংস্কার তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনা। তিনিই এর প্রধান নেপথ্য কারিগর বলে মনে করা হয়। সরকারের প্রশাসনে তিনি সর্বাধিক ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। চীনা সশস্ত্র বাহিনীতে তিনিই সর্বাধিনায়ক। কিছু মানুষ মনে করেন মাও জেডংয়ের পর জি জিনপিংই দেশের দ্বিতীয় নেতা।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ড্রাগন এক কানা সরু গলিতে আঘাত করেছে বলে মনে হচ্ছে। অতিমারী এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়টি দুর্বলভাবে পরিচালনা করায় চীন সরকারের অভ্যন্তরে মারাত্মক চাপ রয়েছে। গোটা বিশ্ব যদি তাদের একঘরে করে দেয় তবে চীনা জনসাধারণের বিরাট অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এখন সব ক্ষেত্রে কার্যত রপ্তানি ভিত্তিক যে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো চীন গড়ে তুলেছে বর্তমান বিশ্বের মনোভাব তাতে প্রভাব ফেলবে। গোটা বিশ্বে নিজের ইচ্ছাকে প্রয়োগ করতে গেলে সামরিক দিক থেকে চীনকে আমেরিকা অথবা ন্যাটো বাহিনীর ক্ষমতার স্তর পর্যন্ত উঠে আসতে হবে। সুতরাং জনসাধারণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে অথবা কিছু মানুষের সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করতে গেলে জিনপিং প্রশাসনের কিছু একটা করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে কোন দেশকে বিরোধী পক্ষ হিসেবে বেছে নেওয়া যায়, তা একদমই স্পষ্ট।
১৩টি দেশের সঙ্গে সীমান্তের অংশীদারি রয়েছে চীনের। তবে ভারতের সঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা ইচ্ছে করে চিহ্নিত করেনি চীন। সর্বোপরি, ২০২০-র
আর ১৯৬২ সালের ভারত এক নয়। ভারতের
জাতীয় নীতির আমূল পরিবর্তন এবং অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে। হাতাহাতি এবং একটি গুলিও না চালিয়ে পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি করে যুদ্ধের পরিণতি কী হতে পারে এবং অর্থনীতি তাতে কতটা প্রভাবিত হবে সে ব্যাপারে দু’দেশই ওয়াকিবহাল। তবে হঠাৎ কি এমন পরিবর্তন ঘটল? কাঁটা লাগানো লাঠি এল কোথা থেকে? এটা নির্ঘাত ঘটনাচক্র নয়, বরং সুপরিকল্পিত। সান তজু-র আরও একটি রণকৌশল হল-বিস্ময়ের উপাদান তৈরি করা।
সেটাই পিএলএ-র (পিপলস লিবারেশন আর্মি) ওয়েস্টার্ন কমান্ডের নয়া সেনা কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জু কুইলিং নিয়ে এসেছে।
গত ৫ জুন চীন-ভারত সীমান্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে জি জিনপিং নিজের বাছাই করা নতুন সেনা কমান্ডার নিয়োগের কথা ঘোষণা করেন। জেন জু চীনা সেনাবাহিনী পিএলএ-র এক উদীয়মান তারকা। ২০১২ সালে অন্যান্যদের সঙ্গে সবচেয়ে তরুণ এই সেনা অফিসারকেও জেনারেল পদে উন্নীত করেন জি জিনপিং। আগের কমান্ডারকে সরিয়ে বয়সে ৫ বছরের ছোট ৫৭ বছর বয়সি এই লেফটেন্যান্ট জেনারেলকে এই পদে উত্তরাধিকারী করা হয়। সেনা ছাড়াও বিমানবাহিনীর কাজেও তিনি বিশেষজ্ঞ। এর আগে তিনি চারটি অন্য অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল জু চীনের ভূতপূর্ব ৫৪ পিএলএ বাহিনীর চিফ অব স্টাফ বা প্রধান ছিলেন। পিএলএ-র এই ৫৪তম সেনাদলটি তিব্বতীয় অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে দমন অভিযানে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। তিয়েনানমেন স্কয়্যারে বিক্ষোভ দমনেও এই বাহিনীর ভূমিকা ছিল। চীন-ভারত সীমান্ত বিতর্ক নিয়ন্ত্রণ করে জেনারেল জু যদি তাঁর প্রেসিডেন্টকে সন্তুষ্ট করতে পারেন তবে তাঁর সামনে নিশ্চিত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। ওই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার অন্তত দিন দশেক আগে ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডে চীন সবচেয়ে অভিজ্ঞ এবং ‘হিংস্র’ জেনারেলকে মোতায়েন করেছিল। ১৫ জুন, ২০২০-র ঘটনা ইতিহাসে খোদাই করা থাকবে। এতে বিজয় না পরাজয় হল তা সময়ই বলবে। কিন্তু চীনা সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সীমান্তে রণনীতি পরিবর্তন হতে পারে, তা আমাদের দেশের সেনা কর্তৃপক্ষ নেতৃত্ব আঁচ করতে পারেনি। সেনাবাহিনী এবং জাতীয় নিরাপত্তার সর্বোচ্চ স্তরে এটা বিচার করাই নীতিনির্ধারকদের এটি এখন গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
সান তজুর ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ বইয়ের উল্লিখিত রণনীতি অনুযায়ী চীনা সেনারা প্রশিক্ষিত। সেই ড্রাগনকে যদি আমাদের বাগে আনতে হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে হয়, তাহলে সান তজু-র নীতি মেনেই তাদেরকে প্রত্যাঘাতই করতে হবে। এই কারণেই নিজেকে জানার পাশাপাশি শত্রুপক্ষের সব রণনীতি এবং নেতৃত্বের ভাবধারণাকে খুঁটিয়ে জানা উচিত। আশা করি, গলওয়ানে আমাদের বীর সেনাদের উৎসর্গীকৃত ত্যাগ থেকে সঠিক শিক্ষালাভ হবে এবং তা সঠিক দিশা দেখাবে।
ভারতীয় বায়ুসেনার অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন
তথা জয়েন্ট ডিরেক্টর এয়ার ডিফেন্স অপারেশনস (সুখোই-৩০)