গুরুজনের চিকিৎসায় বহু ব্যয়। ক্রোধ দমন করা উচিত। নানাভাবে অর্থ আগমনের সুযোগ। সহকর্মীদের সঙ্গে ঝগড়ায় ... বিশদ
গবু কিছুক্ষণ পিছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে বললেন, ‘মান্যবর, শুনতে পাচ্ছেন?’
কোনও হুঁশ নেই হবুর। শত্রুঘাঁটিতে কমান্ডার ঢুকছে। সামনে শত্রুসেনা। মাউসের ক্লিকে তাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন হবু। তন্ময়তা কাটাতে আবার ডাকলেন গবু, ‘মান্যবর..’
ঘোর কেটে গেল হবুরাজার। পিছন ফিরে না তাকিয়েই বললেন, ‘কী হল?’ আর তখনই শত্রুপক্ষের এক সেনা গুলি করে কমান্ডারকে উড়িয়ে দিল। গেম সেখানেই শেষ। খেপে উঠলেন হবু। পিছন ঘুরে গবুকে বললেন, ‘তুমি একটা বেআক্কেলে ষাঁড়। আমার আ্যটেনশন নষ্ট করে খেলাটা শেষ করে দিলে। অন্য কেউ হলে তাকে ত্রিশূল দিয়ে খুঁচিয়ে মারার অর্ডার দিতাম। তুমি বলে তাই ছেড়ে দিলাম। এটা আরও একটা ওয়ার্নিং।’
গবু হাতজোড় করে কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ‘যেমন হুকুম করবেন মান্যবর। তবে কিনা আমি একটা জরুরি দরকারে এসেছিলাম। আপনার কি সকালের দন্ত প্রক্ষালন কিংবা শরীর চর্চা হয়ে গিয়েছে?’
হবু বললেন,‘হ্যাঁ, শুধু কুজ্ঝটিকাসনটা বাকি রয়ে গিয়েছে। একটু পরেই মন্ডা দেশের রাজা আসবেন। তাঁর সঙ্গে প্রাতরাশ সারতে হবে। তাই ওটা পরে করব। তা তুমি বল, কী খবর নিয়ে এসেছো।’
গবু বললেন, ‘মহারাজ চারিদিকে বিদ্রোহ বাড়ছে। স্কুল কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা বিদ্রোহ করেছে। ওরা নাকি আপনার শাসন মানবে না।’
হবু বললেন, ‘আমি আগেই জানতাম। তোমার মতো অপদার্থ যে রাজ্যের মন্ত্রী, সেখানে আন্দোলন, গণ্ডগোল এসব তো লেগে থাকবেই। তুমি আসলে কোনও কম্মেরই নও। গোমুখ্যু কোথাকার।’ বলেই জিভ কাটলেন হবুরাজা।
গবু মুখটা কাঁচুমাচু করে বললেন, ‘মান্যবর, আপনি আমাকে যা ইচ্ছে বলে তিরস্কার করুন। কিন্তু গোমুখ্যু বলবেন না। তাতে গোমাতাকেই অসম্মান করা হয়। গোমাতা হলেন ভগবতী। ভগবতী হলেন জ্ঞানের পূর্ণ আধার। ভগবতীর জ্ঞান যেকোনও ত্যাঁদড় অধ্যাপকদের থেকে অনেক বেশি। অবলা না হলে যেকোনও অধ্যাপককে ডিবেটে বলে বলে হারাত।’
হবু বললেন, ‘ঠিকই বলেছো গবু। আমিই ভুল বলে ফেলেছিলাম। আচ্ছা, আমার রাজ্যে কোন পণ্ডিত যেন বলেছিল, গোরু নিশ্বাসের সময় অক্সিজেন ছাড়ে, আর সেই অক্সিজেন টেনে নিয়ে আমরা বেঁচে আছি?’
গবু বললেন, ‘হ্যাঁ মান্যবর, একজন বিজ্ঞানী বলেছিল। ও আমাদের লোক।
হবু বললেন, ‘দাও, ওকে ভালো করে পুরস্কার দিয়ে তুষ্ট করে দাও। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে! আমার রাজত্বে কত অভিনব আবিষ্কার হচ্ছে, একবার ভাবো তো!’
গবু বললেন, ‘আমাদের রাজ্যের বিজ্ঞান যে কোনও দেশের বিজ্ঞানকে হার মানিয়ে দেবে। আপনার মন্ত্রিসভাতেই গন্ডা গন্ডা বিজ্ঞানী আছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, আমরাই প্রথম টেস্টটিউব বেবি করেছিলাম। সেইভাবেই দুর্যোধনদের জন্ম হয়েছিল। আমাদের দেশে কতদিন আগে প্ল্যাস্টিক সার্জারি আবিষ্কার হয়েছিল, একবার ভাবুন তো। গণেশ ছিলেন তার প্রথম রোগী।’
হবু বললেন, ‘নতুন ইতিহাস লেখো। ওসব কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দিয়ে হবে না। উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্রগুলো আমি ভাবছি বন্ধ করে দেব। টোল খোল, গুরুকুল খোল। ফিরিয়ে আনো আশ্রমিক জ্ঞানের সেই যুগ। গোরুর দুধে আর গোবরে সোনা আছে, এটা কজন মুখ্যু জানে বলতো! নারদ মুনিই যে এখনকার গুগল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এখনও কেউ তা জানতেও পারল না। হায় রে শিক্ষা! ওসব ডারউইন, নিউটন, আইনস্টাইনদের লেখা পড়লে মানুষ মুখ্যু হবে। সেই মুর্খামি রাজার প্রতি, ঈশ্বরের প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টি করবে। ঔদ্ধত্য শিখবে। রাজাকে চ্যালেঞ্জ করতে শিখবে। ওরা সব দেশের শত্রু, মানুষের শত্রু, রাজারও শত্রু। ঢিঁচক্যাঁও। বুদ্ধিজীবী মানে দেশদ্রোহী, আধুনিকমনস্ক ছাত্র মানে সন্ত্রাসবাদী, প্রগতিশীল শিক্ষাবিদ মানেই সমাজের শত্রু, প্রতিবাদকারী জনতা মানেই টুকরে টুকরে গ্যাং। কলঙ্ক লেপে দাও।’
গবু হাত কচলে বললেন, ‘ঠিক বলেছেন মান্যবর।’
হবু বললেন, ‘ওদের শিক্ষা দাও। সহবৎ শেখাও। বল ওদের, তোমরা যদি রুটি চাও, তবে আমাকে দেশভক্তি দাও। যদি তোমরা চাকরি চাও, তবে আমাকে আনুগত্য দাও। সামনেই সাধারণতন্ত্র দিবস আসছে, তার আগেই আমি চাই দেশে ভক্ততন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে।’
হবু কথা থামিয়ে বললেন, ‘অমন হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’
গবু বলল, ‘মান্যবর, আপনার কথা শুনলে আমি সম্মোহিত হয়ে যাই। কী অসাধারণ কথা বলেন আপনি।’
হবু বললেন, ‘আমার একটা বড় প্ল্যান আছে।’
গবু বললেন, ‘কী প্ল্যান মহারাজ?’
হবু বললেন, ‘এই দেশে শুধু আমাদের লোকই থাকবে। মানে যারা ভক্ত। একটা তালিকা তৈরি করব। তালিকার নাম দেব ‘ভক্ততন্ত্র তালিকা’। সেই তালিকা নিয়ে রাজকর্মচারীরা প্রজাদের ঘরে ঘরে যাবে। তথ্য সংগ্রহের পর বাছাই হবে। যারা আমাদের লোক নয়, তাদের ভাগিয়ে দেব।’
হবু কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, ‘সেটা মান্যবর কেমন হবে, ঠিক বুঝতে পারছি না।’
হবু ব্যঙ্গের সুরে বললেন, ‘তুমিই যদি সব বুঝবে, তাহলে তুমিই তো এই সিংহাসনে বসতে।’
গবু ফিসফিস করে বললেন, ‘একদিন তো বসবই, কে আটকাবে?’
হবু বললেন, ‘বিড়বিড় করে কী বলছ?’
গবু বললেন, ‘না মহারাজ কিছু না।’
হবু বললেন, ‘আমি ঠিক করেছি, এদেশে যারা আমাদের লোক নয়, তাদের ভাগাব।’
গবু বললেন, ‘কী করে মান্যবর, সবাইকে কি সমুদ্রে ফেলে দেবেন?’
হবু রেগে গিয়ে বললেন, ‘তোমার মাথায় কি গোবর পোরা?’
গবু বললেন, ‘মান্যবর, আপনি আবার গোমাতার প্রসাদ নিয়ে কথা বলছেন। গোমাতার গোবরে সোনা থাকে। সেই গোবর খেলে বুদ্ধি খোলে। আমাদের এক বিজ্ঞানী বলেছেন, ‘মাথায় গোবর পোরা মানেই নির্বোধ, এটা ভুল তত্ত্ব। কারও মাথায় গোবর থাকলে খুব বুদ্ধিমান হয়।’
হবু বললেন, ‘তাহলে মনে হয় আমার মাথায় সবথেকে বেশি গোবর পোরা। তাই আমার এত বুদ্ধি।’
গবু গদগদ হয়ে বললেন, ‘ঠিক বলেছেন মান্যবর। আপনার বুদ্ধি সবথেকে বেশি। নাহলে সবাইকে এভাবে ঘোল খাইয়ে, নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে পারেন?’
হবু বললেন, ‘তা সত্ত্বেও আমি কেন যে বেশি পড়াশোনা করতে পারিনি! যেটুকু পড়েছি, খুব খারাপ নম্বর পেয়েছি।’
গবু বললেন, ‘মান্যবর, আপনার জ্ঞানকে ধরার মতো শিক্ষাব্যবস্থা এতদিন ছিল না।’
হবু গর্বভরে বললেন, ‘আমারও তাই মনে হয়।’
গবু বললেন, ‘কিন্তু মান্যবর, আপনার রাষ্ট্রজ্ঞান অসাধারণ। পুরাণ বা ইতিহাস ঘেঁটেও আমি তার কোনও তুলনা পাইনি।’
হবু বললেন, ‘আমি তাই ঠিক করেছি, কাল মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকে দেশ থেকে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দেব। একবার ভেবে দেখেছো, কত আগ্রহী ছেলেমেয়ে পড়াশোনার করার সুযোগ পায় না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তাদের ঢোকার কোনও অধিকারই দেয়নি এই শিক্ষাব্যবস্থা। তাই সেই সব আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের রাতের অন্ধকারে মুখ ঢেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে হয়। তাদের হাতে লাঠি। আমার মনে হয় এরাই প্রকৃত বিপ্লবী। শিক্ষাঙ্গণে ঢুকে তাণ্ডব চালানোটা একটা বিপ্লব। গুরুকুল খুলে আমি ভক্তবৃন্দ বানাব। এই শিক্ষার পিছনে এত পরিমাণ অর্থ ব্যয় করব না। সেই অর্থে দেশে বড় বড় মন্দির বানাব। দেড় হাজার ফুট, দু’হাজার ফুট মূর্তি বসাব।’
গবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কার মূর্তি মান্যবর?’
হবু বললেন, ‘যাকে রাজ্যের মানুষ এতকাল শত্রু বলেছে, তার। উনি আমাদের লোক। উনি একজন মনীষী, বড় দেশভক্ত। সেদিন ওই লোকটাকে গুলি করে মেরে ওই মনীষী মহৎ কাজ করেছিলেন। কলঙ্ক মুছে আজ আমরা সেই মনীষীর মূর্তি বানাব। ওনার নামে মন্দির বানাব। ওনাকে পুজো করব। যাকে চর বলে কলঙ্কিত করেছে, তাঁরও মূর্তি বসাব। আমরাও পাল্টা কলঙ্ক লেপে দেশভক্তদের দেশবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে দেব। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে সব তছনছ করে দেব। ঢিচক্যাঁও।’
গবু বললেন, ‘সেই সঙ্গে মান্যবর, আপনারও একটা বড় মূর্তি আর মন্দির বানিয়ে নিন।’
হবু বললেন, ‘অত অস্থির হয়ো না গবু। সব ধীরে ধীরে হবে। তুমি এখন যাও। আমি একদান শত্রুনিধন গেম খেলে, কুজ্ঝটিকাসন সারব। আর একটু পরে মন্ডা দেশের রাজা আসবেন।’
গবু প্রণাম করে বিদায় নিলেন। হবু রাজা ডুবে গেলেন গেমের ভিতরে। ঢিঁচক্যাঁও....।