গুরুজনের চিকিৎসায় বহু ব্যয়। ক্রোধ দমন করা উচিত। নানাভাবে অর্থ আগমনের সুযোগ। সহকর্মীদের সঙ্গে ঝগড়ায় ... বিশদ
আমার মনে আছে ১৯৬৮-তে যুক্তরাষ্ট্রে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কাজকর্ম ভেঙে পড়েছিল। আর এই বিপর্যয় থেকে দেশকে উদ্ধারের দায়িত্ব বর্তেছিল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর। ১৯৬৮-র এই যে বিরাট সঙ্কট তার মূল কারণ ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ।
উত্তর ভিয়েতনাম ছিল কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রণে। আর দক্ষিণ ভিয়েতনামে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, এই অজুহাতে যে সেইদিকে কমিউনিস্টদের অগ্রগমন ও আগ্রাসন তারা ঠেকাবে এবং গণতন্ত্রকে রক্ষা করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী অধ্যায়ে ‘উদার গণতন্ত্র’ রক্ষা করার পক্ষের মতবাদটি জনপ্রিয় হয়েছিল। এই বিষয়ে সবচেয়ে স্পষ্ট বিভাজন ঘটে গিয়েছিল ইউরোপে। একপক্ষে ছিল কিছু তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশ আর অন্যপক্ষে ছিল কিছু তথাকথিত কমিউনিস্ট দেশ। এই বিভাজন রেখাটিকে উইনস্টন চার্চিল ‘লৌহ যবনিকা’ বলেছিলেন।
সেনা বাহিনীতে আবশ্যিকভাবে যোগদানের আহ্বান জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুবরা ‘দেশসেবা’র প্রয়োজনে প্রতিরক্ষার বিভিন্ন বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের গোড়ার দিকে আমেরিকার বহু যুবক স্বেচ্ছায় কাজটি করেছিলেন। যুদ্ধটা যখন থেমেও থামছে না, মন্থর-একঘেয়ে-ক্লান্তিকরভাবে চলছে, এবং একের পর এক সরকারের মিথ্যাচার খোলসা হচ্ছে, তখন মার্কিনিদের সেই সমর্থনের জায়গা নিল সংশয়বাদ। সংশয় বদলে গেল সন্দেহে এবং সন্দেহ বদলে গেল বিরোধিতায়।
প্রতিবাদী কণ্ঠ প্রথম ধ্বনিত হল যুবসমাজের মধ্যে থেকে—বিশেষ করে ছাত্র এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীতে আহূত হয়েছিলেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে থেকে। তাঁরা সরকারের কাছে প্রথম জানতে চেয়েছিলেন—বহু দূরে একটি দেশ ভিয়েতনাম, আমরা সেখানে যুদ্ধ লড়তে গিয়েছি কেন? শয়ে শয়ে আমেরিকান যুবককে সেখানে গিয়ে মরতে হচ্ছে কেন? তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যবস্থা এর সদুত্তর দিতে পারেনি।
মার্কিন কংগ্রেসে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা হাওয়া বুঝতে দেরি করে ফেলেছিলেন। আর ব্যাপারটা যখন তাঁরা ধরে ফেললেন তখন মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা একরোখা হয়ে উঠলেন এবং গলার জোরে যুদ্ধের প্রয়োজনটাই ব্যাখ্যা করতে প্রয়াসী হলেন। কী কেনেডি, কী জনসন, কী নিক্সন—সকলের শ্রীমুখে এক ধুয়ো—ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার জয় কেবল সময়ের অপেক্ষা!
অবাক ব্যাপার, নিক্সনের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্ট শেষমেশ ওই যুদ্ধ থেকে পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিলেন। কে এই রাষ্ট্রনায়ক? অন্যের উপর বলপ্রয়োগই যাঁর বিদেশনীতির সারকথা এবং কমিউনিস্টদের বিরোধিতায় যিনি অকৃত্রিম। তাহলে কেন তাঁর এই চৈতন্যোদয়? কারণ, দেরিতে হলেও তিনি সার বুঝে গিয়েছিলেন যে বিপুল অর্থ আর লোকক্ষয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে যা কোনোদিনই জেতার নয়।
কিছু ভীষণ রকমের ভুল
আজ ভারতজুড়ে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যায় ক্যাম্পাসে যে আলোড়ন ক্ষোভ বিক্ষোভ আমরা দেখছি, তার সঙ্গে ১৯৬৮-র ঘটনার কিছু উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। আজকের ছাত্রসমাজ যুবসমাজ বুঝতে পারছে যে দেশ যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে তার ভিতরে কিছু ‘ভীষণ রকমের ভুল’ হয়ে যাচ্ছে। এই যে ক্ষোভের আগুন—তার সূত্র অনেক স্ফুলিঙ্গ। যেমন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ব্যক্তিদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করা হচ্ছে যাঁদের ‘ক্রিডেনশাল’ নিয়ে সংশয় রয়েছে, রাজ্যপাল/উপাচার্যদের অন্যায় হস্তক্ষেপ ঘটছে, তাঁরা অশোভনভাবে নিজেদের জাহির করছেন, অনেক শিক্ষকের নিয়োগও ত্রুটিপূর্ণ, পরীক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রেও অনেকসময় অব্যবস্থা লক্ষণীয়, ছাত্র-সংগঠনের স্বাভাবিক কাজকর্মও নিয়ন্ত্রিত করার প্রয়াস জারি রয়েছে, অন্যায়ভাবে ফি বৃদ্ধি করা হচ্ছে প্রভৃতি। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট মানসিকতা নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে এবং অন্যদের উপেক্ষা করে একটিমাত্র রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাত্রদের ‘ফেভার’ করা হচ্ছে এবং সংঘর্ষে মদত দেওয়া হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে নিন্দনীয় ঘটনাটি ঘটে গিয়েছে দিল্লিতে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ)। জেএনইউ প্রশাসন তো বিজেপির ছাত্র শাখা এবিভিপিকে খুল্লামখুল্লা মদত জুগিয়েছে। অন্যদিকে, প্রতিবাদী কণ্ঠকে ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’ বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। ছাত্রনেতাদের রাষ্ট্রদ্রোহের কেসেও ফাঁসানো হয়েছে।
যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নয়া ‘স্থিতাবস্থা’ ভয়তাড়িত করে থাকে তো সাধারণভাবে দেশের ‘স্থিতাবস্থা’য় চলছে দমন-পীড়ন। প্রতিটি দিন নতুন নতুন করে উঠে আসছে ধর্ষণ আর গণপ্রহারে মৃত্যুর খবর, অপছন্দের লোকদের অপমান অমর্যাদার ঘটনা, এবং ইচ্ছেখুশি গ্রেপ্তারের ঘটনা। সরকার বৃদ্ধি, উন্নয়ন আর চকারির অলীক গল্প ফেঁদেই চলেছে। এতে ভয়ানক ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন যুবক-যুবতীরা—যাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠায় কাটছে, বিশেষত চাকরি-বাকরি হবে কি হবে না তা নিয়ে যাঁরা অশান্তিতে আছেন। ঠিকমতো পর্যবেক্ষণ করলে একজন ছাত্র বুঝতে পারছেন যে এই নয়া ‘স্থিতাবস্থা’ চালনা করছে যে-শক্তি, যে এটার বৈধতার পক্ষে সওয়াল করছে, সে আর কেউ নয়—শাসকের গরিষ্ঠতার ঔদ্ধত্য। এই শক্তি নানাভাবে নিজেকে প্রকট করে তুলছে: ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতার প্রকাশ, অন্যের বিশ্বাসের প্রতি ঘৃণাপ্রদর্শন, আইনশঙ্খলারক্ষার নামে অহেতুক কঠোর মনোভাব দেখানো, সেন্সরশিপ এবং অন্যসকল নিয়ন্ত্রণের বাড়াবাড়ি (যেমন ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া), যুক্তিগ্রাহ্য ‘চার্জ’ আনতে না-পারা সত্ত্বেও অভিযুক্তদের দিনের পর দিন আটক করে রাখা, প্রতিবাদী বা অপছন্দের ছেলেমেয়েদের গায়ে প্রতিক্রিয়াশীল তকমা সেঁটে দেওয়া (অসবর্ণ কিংবা ভিন্নধর্মে বিবাহ অনুমোদন না-করা) প্রভৃতি।
অঙ্গীকারে প্রত্যাখ্যান
রাজনৈতিক স্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠের ঔদ্ধত্য দেখা গেল যখন সরকার বিরোধীদের প্রতি তার অঙ্গীকার প্রত্যাখ্যান করে দিল এবং বিতর্কিত আইন সংসদে তড়িঘড়ি পাশ করালো। একটি দৃষ্টান্ত এই: ভারতের সংবিধানের ৫-১১ নম্বর অনুচ্ছেদে নাগরিকত্বের বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে। এই অনুচ্ছেদ ক’টি গৃহীত হয়েছিল গণপরিষদে তিনমাসব্যাপী বিতর্ক-আলাপ-আলোচনার পর। আর এদিকে কী হল দেখুন! ৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ তারিখ নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল ২০১৯-কে মন্ত্রিসভা অনুমোদন করল, এরপর সংসদের উভয় কক্ষে তা পাশ করানো হল, এবং সেটাকে আইনে পরিণত করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হল ১১ ডিসেম্বর—অর্থাৎ সবটাই সেরে নেওয়া হল মাত্র ৭২ ঘণ্টার ভিতরে!
ভারত রাষ্ট্র এবং সংবিধানের পক্ষে এই যে বাস্তব বিপদটি উপস্থিত হল, তার বিরুদ্ধে সবার আগে ঘুম ভেঙেছে ছাত্রদের এবং যুবদের। তাঁদের এই ভূমিকা রাজনৈতিক দলগুলিকেও ছাপিয়ে গিয়েছে—এমনকী যেসব দল ব্যাপক হালুম-হুলুম করেছে, ছাপিয়ে গিয়েছে তাদেরকেও। ছাত্র-যুবরা যথার্থ উপলব্ধি করেছেন যে সংখ্যাগরিষ্ঠের এই ঔদ্ধত্য এবং পদক্ষেপই শেষমেশ ‘অথরিটারিয়ানিজম’-এর দিকে গড়াবে। আমরা জানি, অথরিটারিয়ানিজম হল এমন একটা ভয়ানক ব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতার জায়গায় গুরুত্ব পায় সরকারের প্রতি আনুগত্যের নীতি। ছাত্র-যুবরা আরও বুঝেছেন, সরকারের এই নীতি ভারতকে বিভক্ত করবে এবং ভারতবাসীকেই ভারতবাসীর বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেবে। অধিকার, বিশেষ মর্যাদা এবং সুযোগ-সুবিধার প্রশ্নে দেশের কিছু মানুষের গুরুত্ব খর্ব হবে। এই যে সর্বনাশা কাণ্ডটা হচ্ছে এর ফলে দেশ সত্তর বছর পিছনে ফিরে যাবে এবং স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যন্ত দেশের যাবতীয় প্রাপ্তি নস্যাৎ হয়ে যাবে।
আজকের প্রজন্মের ভিতরে নিরপেক্ষতা ও নিস্পৃহতার যে-ভাবটা ছিল নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন সেটাকে নষ্ট করেছে। অন্যদিকে, এই আইন ভীষণ লজ্জিত করেছে বয়স্কদেরকে। হাজার হাজার কমবয়সি নারী-পুরুষ রাস্তায় নেমে এসে জাতীয় পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে পদযাত্রা করেছেন, মোমবাতি হাতে মিছিল করেছেন, প্রতিবাদীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছেন আর সংবিধানের প্রস্তাবনার গভীর তাৎপর্য দেশবাসীর উপলব্ধিতে এনে দিয়েছেন। প্রত্যাশামতোই পাওয়া গিয়েছে শাসক গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া—তারা অন্ধ গতানুগতিক ভাবে ক্রোধে ফেটে পড়েছে। একইসঙ্গে লক্ষ করা গিয়েছে যে, শাসক আজ নার্ভাস, সোজা কথায়, বড্ড ভয় পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে দিয়েছেন যে, ‘‘আমরা সিএএ থেকে এক ইঞ্চিও সরছি না’’। মনে হচ্ছে একটা অপ্রতিরোধ্য শক্তি আর একটা অনড় বাধার সম্মুখীন। কাউকে অথবা কিছু একটা ছাড়তে হবে। ভারতের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ এটার উপরেই ঝুলে রয়েছে। বছরের একটা অশুভ সূচনা হল।