গুরুজনের চিকিৎসায় বহু ব্যয়। ক্রোধ দমন করা উচিত। নানাভাবে অর্থ আগমনের সুযোগ। সহকর্মীদের সঙ্গে ঝগড়ায় ... বিশদ
তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা ফল! একদার বাম রাজ্য এবং বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একচ্ছত্র গড়ে রামভক্তদের প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট নিয়ে ১৮ আসন! ফল প্রকাশের পর অতিবড় রামভক্তও বলে উঠতে পারেননি যে এমনটাই তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন। পারেননি। তবে, ফলাফলের আনন্দসুখে তাঁদের অনেকেরই ছাতিই যে ২৮ থেকে ৫৬ ইঞ্চির দিকে প্রসারিত হয়ে পড়েছিল তা বলাই বাহুল্য। মমতাময় বাংলার সবুজ বুকে গেরুয়া বিজেপির সেই স্বপ্নের উত্থানের পর তাই সঙ্গত কারণেই রাজ্য রাজনীতির বিভিন্ন মহলে ভাবনা দুর্ভাবনার মিশ্র প্রতিক্রিয়ারও অভাব হয়নি। সিপিএমের একটা সুবিধে আছে—রাজ্যে বিজেপি কিছু একটা করলেই তাঁরা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায় খালাস করে দিতে পারেন। লোকসভা ফল প্রকাশের পরও তার অন্যথা হয়নি। বিজেপির ভালো ফলের দায় মমতার ওপর চাপিয়ে তাঁরা নিজেদের বেকসুর প্রমাণ করতে নেমেছিলেন—মনে করে দেখুন। অথচ, ভোটফলে পরিষ্কার ছিল আসন কিছু কমলেও মমতার তৃণমূলের ভোট বেড়েছে। পক্ষান্তরে, বীতশ্রদ্ধ বাম ভোটাররাই বিজেপির শিবিরে অতিরিক্ত ২২ শতাংশ সরবরাহ করে ১৭-কে ৪০ শতাংশের কাছে টেনে তুলেছে!
তো সে যা-ই হোক, মোদ্দা কথা বিজেপির এই ফলের পর সাধারণ জনতা মধ্যে এই কথাই চাউর হয়েছিল যে, একুশে রাজ্যে আসছে বিজেপি। এমনকী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতি বড় গুণমুগ্ধকেও কণ্ঠ ভরা শঙ্কা নিয়ে এমন ভবিষ্যদ্বাণী করতে শুনেছি। আর এই আবহের সঙ্গে তাল রেখে বঙ্গ রাজনীতির রঙ্গলোকে রাজনৈতিক ডিগবাজির সূচনাও হয়ে গিয়েছিল ভালোই। এবং সেই ডিগবাজিবাজদের চিহ্নিত করে ঘরে তুলতে সেরার সেরা কারিগর হয়ে উঠে এসেছিলেন মমতার প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট মুকুল রায়, তাঁকে বাংলার নতুন চাণক্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও কিছুমাত্র বিলম্ব করেনি গেরুয়া শিবির! সেই ‘যাকে পাবি তাকে খা’ গোছের রাজনীতি (যাকে সাধারণভাবে দলভাঙানোর রাজনীতি বলেন আপনারা) শেষপর্যন্ত এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছিল যে বীরভূমের এক অতি বিতর্কিত নেতাকে দলভুক্ত করতে গিয়ে নিজের দলের নেতৃত্বেরই কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হল রায়বাবুকে। শেষপর্যন্ত অবশ্য সেই বিতর্কিত ব্যক্তিকে আড়ালে ঠেলে দেওয়া হল। এখন তিনি কোথায় কে জানে! ভাটপাড়া নৈহাটি বারাকপুরের শিল্পাঞ্চলে জমি দখল নিয়েও বিরাট কাণ্ড চলল কিছুদিন। সব মিলিয়ে সে এক তাধৈমাধৈ অবস্থা যার মূল সুর বলে চলেছিল—বিজেপি আগত ওই!
আর এই সুর যত চড়ছিল ততই বাংলার সংখ্যালঘু মহলে একটা অস্বস্তির ভাব জাগছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাণপণে সেই অস্বস্তি দূর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাতেও পুরোপুরি স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছিল না। কারণ, তখন নরেন্দ্র মোদিজির নেতৃত্বে নতুন সরকার একের পর এক প্রতিশ্রুতি পালন করছেন, ভাঙছে দীর্ঘকালের প্রথা অভ্যাস। তিন তালাক বিল পাশ হল, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল হল, কাশ্মীর আর লাদাখ দুটি পৃথক জেলা হল এবং আকারে ইঙ্গিতে বোঝা গেল এবার আসছে নাগরিকতা প্রসঙ্গ—এনআরসি, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করে পাঠানো হবে ক্যাম্পে ইত্যাদি ইত্যাদি। সেইসঙ্গে আকারে ইঙ্গিতে এবং ক্ষেত্রবিশেষে রেল পেট্রোলিয়াম কোম্পানি সমেত বহু বড় শিল্পের বেসরকারিকরণ, ছাঁটাই, কর ব্যবস্থা সংস্কার প্রভৃতি কঠিন কঠিন সব সংস্কার সিদ্ধান্তের রূপায়ণ তো আছেই। ফলে সংখ্যালঘু সমেত বহু সাধারণের মনেই একটা অজানা ভয় দানা বাঁধতে শুরু করল আর অনিবার্যভাবেই স্ব-স্ব অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা অনিশ্চয়তার বাতাবরণও তৈরি হতে লাগল, খোঁজা শুরু হয়ে গেল আত্মরক্ষার উপায় এবং ভরসাদার রাজনৈতিক শক্তি। এটা অবশ্য গোটা দেশেই ঘটল, কেবল বাংলায় নয়।
প্রাথমিকভাবে বিজেপির নবীন অগ্রগামী ভারতের তলে তলে এই বিপরীত প্রতিক্রিয়ার স্রোতকে দেশ রাজ্যের গেরুয়া নেতৃবৃন্দের কেউই বিশেষ পাত্তা দেননি। এমনকী এনআরসির অসমে ১৯ লক্ষ (যার মধ্যে ১২ লক্ষ বাঙালি বলে কথিত) নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিলের পরও নয়! কিন্তু, অসমের ১২ লক্ষ বাঙালির সেই চরম দুর্দশা নিয়ে যেই গর্জে উঠলেন মমতা চটকা ভাঙল যেন! বিজেপি নেতৃত্বের তরফে তখন প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা হল— এটা নাগরিক বিরোধী আইন নয়, নাগরিকত্ব সুরক্ষিত করার আইন। বোঝানো হল, পাকিস্তান আফগানিস্তান বাংলাদেশের মতো মুসলিম রাষ্ট্রে পীড়িত হিন্দু সমেত সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দেবার জন্যই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। কিন্তু দেখা গেল, এইসব কথা সত্য বলে জনতার সিংহভাগ গ্রহণ করছেন না! বরং, তাঁরা গেরুয়া বিরোধীদের কথায় মান্যতা দিচ্ছেন!
বিশেষ করে এই পশ্চিমবঙ্গে যেমন আগে তেমন এই এনআরসি ইস্যুতেও মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই শিরোধার্য করছেন সংখ্যালঘু থেকে সাধারণ সকলেই। কেন? বিশ্বাস, অটুট অনড় বিশ্বাস। সে বিশ্বাস মমতা একদিনে অর্জন করেননি। প্রথমাবধিই জনতা দেখেছে মমতা যে কোনও বিপদে আপদে মানুষের পাশে থাকেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বিরোধীদের কটূক্তি ব্যঙ্গ সত্ত্বেও সংখ্যালঘুদের প্রতিও তাঁর সহানুভূতি অনুকম্পা যথারীতি জারি আছে। শুধু তাই নয়, ক্ষমতায় আসার পর মমতা রাজ্যের যেখানে যা উন্নয়ন উন্নতি করেছেন তার ফল সরাসরি পেয়েছেন সাধারণ মানুষ। বড় ও ভারী শিল্প হয়তো তিনি এখনও তেমন আনতে পারেননি, তবে ওই উন্নয়নের জোয়ারে এবং অব্যর্থতায় বাংলার গরিব সাধারণের জীবনযাত্রার মান ও গতিতে যে উন্নতি ঘটিয়েছেন— তা এই বঙ্গের ইতিহাসে অনন্য, মুখে না মানুন মনে মনে মানেন সকলেই। সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম আমলের সূচনায় ভূমি সংস্কার ছাড়া মমতার এই উন্নয়নের তুল্য উদ্যোগের নজির খুব কি আছে যাতে উপকৃত হয়েছেন গরিব প্রান্তিক মানুষ থেকে শহর বস্তির সাধারণজন? বলতে কী এককালে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামেদের প্রতি মানুষের বিশ্বাস যেভাবে দৃঢ়তা পেয়েছিল ঠিক সেভাবেই সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম পর্ব থেকে একটু একটু করে বঙ্গজনতার মমতায় বিশ্বাস শিকড় ছড়াতে ছড়াতে আজ অনড় অটল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর বলতে কী, এনআরসি সিএএ নিয়ে বিদ্রোহের পর শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতের নানা প্রান্তেই আজ মমতায় বিশ্বাসীর সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। না হলে ভোট সমীক্ষার ফল একতরফাভাবে পক্ষে যাওয়ার পরও দিল্লির শাসক কেজরিওয়াল তাঁকে নির্বাচনী প্রচারে আহ্বান জানান?!
এহেন মমতার রাজ্যে ২০১৯ লোকসভায় চমক দেখানো আর ২০২১ ভোট জয়টা যে এক কথা নয় সেটা বঙ্গবিজেপি খুব ভালোই জানে। তার ওপর ঝাড়খণ্ড ও মহারাষ্ট্রের ভোটফল প্রকাশের পর এটুকু বোধহয় ফের বোঝা গেল রাজনীতির জগতে শেষ কথা বলে কিছু নেই, বন্ধু-বিশ্বাস বলেও না! হিন্দুত্ববাদী শিবসেনার মতো বিজেপির স্বাভাবিক শরিকবন্ধু নিছক ক্ষমতার সিংহাসনের টানে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে— ভাবা যায়! আর ঝাড়খণ্ডে তো যাকে বলে ধূলিসাৎ। অথচ, অমিতজি এখনও এনআরসি নিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছেন। জনগণনার জায়গায় নাগরিকপঞ্জি নিয়ে তৎপরতা দেখাচ্ছেন। অন্যদিকে জামিয়া মিলিয়া থেকে জেএনইউ— কোথাও তার বিরোধিতায় কোথাও ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে নামা ছাত্রছাত্রীরা পুলিস কি এবিভিপির গেরুয়া গুন্ডাদের আক্রমণে রক্তাক্ত হচ্ছেন। উত্তরপ্রদেশের মতো নানা জায়গায় নাগরিকত্ব বিক্ষোভে প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটেছে! গোটা দেশ এসব কিছু নিয়ে আজ উত্তাল উত্তপ্ত বজ্রগর্ভ! গতকাল সারা দেশ স্তব্ধ করে একটা প্রতিবাদের ধর্মঘটও হয়ে গেল।
এমতাবস্থায় বঙ্গে বিজেপির ১৮ আসনের সেই উদ্দীপনা যে প্রভূত ধাক্কা খাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। মতুয়া এবং উদ্বাস্তুদের সঙ্গে বাম বিমুখ মমতা বিরোধী ২২ পার্সেন্ট— এই দিয়ে ২০২১-এ বিজেপির শিকে ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখেছিলেন যাঁরা আজ তাঁদের মধ্যেও দোলাচল। নাগরিকত্ব ইস্যু মেরুকরণের ব্যবস্থা করেছে ঠিকই কিন্তু এরপর বাংলার অপেক্ষাকৃত উদারবাদী হিন্দু জনতাকে শেষ অবধি ভোটযুদ্ধে কতটা পাশে পাওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয় বাড়ছে। তাই, ইউপি ইলেকশনে বিপুল জয়ের পর উৎফুল্ল বিজেপি নেতৃত্ব মহাকলরবে যে মিশন বেঙ্গল ২০২১ ঘোষণা করেছিলেন তার ভবিষ্যৎ নিয়েই উঠছে প্রশ্ন: নাগরিকত্ব ইস্যু মিশন ২০২১-এর পথে বঙ্গবিজেপির সবচেয়ে কঠিন কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে না তো? উত্তর খুঁজছে বঙ্গবিজেপি।