গুরুজনের চিকিৎসায় বহু ব্যয়। ক্রোধ দমন করা উচিত। নানাভাবে অর্থ আগমনের সুযোগ। সহকর্মীদের সঙ্গে ঝগড়ায় ... বিশদ
করে নতুন কাঠামোয় আত্মপ্রকাশ করেছে নীতি আয়োগ। বিল্ডিংটা অবশ্য ভেঙে ফেলা হয়নি। সামনের নেমপ্লেটে বড় করে লেখা হয়েছে নীতি আয়োগ। এরপর পুরনোকে সরিয়ে ফেলে ২০১৬ সালে
ভারতে নতুন মুদ্রা ব্যবস্থা চালু হল। মনে করা হয়েছিল, শুধুই বোধহয় ৫০০ ও ১০০০ টাকার দুটি নোটই বাতিল করা হচ্ছে। বাকি সব নোট পুরনো আকারেই থাকবে। কিন্তু ধীরে ধীরে পুরনো ডিজাইনের ১০০ টাকা, ৫০ টাকার নোটও পাল্টে নতুন ঝকঝকে অন্য ডিজাইনের নোট এসেছে। আর তার সঙ্গেই এই সরকারের স্বভাবসিদ্ধ চমকও এল। ২০০ টাকার নোট। এবার পাল্টে যাচ্ছে পার্লামেন্ট ভবনও। নতুন লোকসভা হল তৈরি হবে ২০২৪ সালের আগেই।
সাম্প্রতিক কিছু কিছু কার্যকলাপ দেখে মনে হচ্ছে, নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর করার প্রকল্পও বেশ গতিশীল। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ, জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই দলে দলে রিসার্চ স্কলার উত্তীর্ণ হবেন এবং দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়বেন সেই একই অর্থনীতি, পদার্থবিজ্ঞান, অঙ্ক নামক প্রাচীনতম বিষয়বস্ত নিয়ে, এটা যেন একটা একঘেয়ে প্রবণতা। তাই নতুন কিছু করতে হবে। তাছাড়া ওরকম চরম কঠিন কঠিন অ্যাডমিশন টেস্ট কিংবা শুধুই মেধার মাধ্যমে এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া সম্ভব হবে, এই পুরনো পন্থাও অনেকে মানতে নারাজ। এই যথেচ্ছাচারের সমাজের নতুন দাবি, গণতান্ত্রিক ভারতে সব প্রতিষ্ঠানে সবাই ঢুকতে পারে। রেজাল্ট ফেজাল্ট মাপকাঠি হতে পারে না। সুতরাং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ঢুকতে গেলে একান্তই যদি প্রশাসনিক বাধা থাকে, তা হলে রাতে মুখ ঢেকেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার নিয়ম করতে হবে। যেহেতু রেজিস্টারে ছাত্র হিসাবে নাম থাকবে না, তাই অ্যাটেন্ডেন্স হিসাবে একটা দুটো মার্কামারা স্লোগান রাখা যেতে পারে। হাতে পেন খাতা ব্যাগের বদলে ইঁট, পাথর, আয়রন রড থাকবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনধিকারীদের প্রবেশে কেউ আপত্তি করলে, বিরুদ্ধমতাবলম্বীদের বাছাই করে করে মারতে হবে। এবং মাথায় মারাই নিয়ম এক্ষেত্রে। কারণ দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাশক্তি এবং ভাবনায় ফারাক করে দেয় একটাই জিনিস, মাথা অর্থাৎ মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কেই থাকে মেধা। সুতরাং মাথাকে সবরকম ভাবে টার্গেট করাই যুক্তিযুক্ত ভাবা হচ্ছে। এভাবে একটি প্রচ্ছন্ন বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, হয় মগজ ধোলাইয়ের কোর্স চালু হোক অথবা মাথা ফাটানোর পারমিশন দেওয়া হোক। একান্তই যদি এগুলো সম্ভব না হয়, তা হলে যে সব মনীষী আধুনিক উন্নত চিন্তাশক্তির জনক, তাঁদের মূর্তি ভাঙতে হবে। যেমন কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে হয়েছে। ভাঙতে হলে বাঙালি মনীষীর মূর্তিই হয় টার্গেট। মাথায় মারতে হলেও বাঙালি ছাত্রী ও অধ্যাপিকাই টার্গেট হয়।
এদিকে আবার প্রাচীন একঘেয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি নতুন নতুন কিছু অত্যাধুনিক এবং উন্নত কোর্সও চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেমন, অযোধ্যার রামমনোহর লোহিয়া অবধ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সার্টিফিকেট কোর্স চালু করার কথা ভাবা হয়েছে। কোর্সের নাম ‘গর্ভ বিজ্ঞান সংস্কার’। গর্ভের সন্তানকে কীভাবে জন্মগ্রহণের আগেই মানসিক ভাবে শক্ত করে তোলা সম্ভব, এটাই এই কোর্সের উপজীব্য। যোগা থেরাপি বিভাগ আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রাচীন ঐতিহ্যের শিক্ষাকে মিশ্রিত করে এই কোর্স করাবে বলে স্থির করেছে। জন্মগ্রহণের আগেই কীভাবে, কী কী পদ্ধতি পালন করা হলে অনাগত সন্তান মানসিকভাবে স্ট্রং হয়ে যায় সেটাই পড়ানো হবে। সন্তানবতী মা, তাঁর পরিবারের সদস্যরাও এই কোর্সে ভর্তি হতে পারবেন।
ঠিক এরকমভাবেই বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছে ‘ভূত বিদ্যা‘ সিলেবাস। সাইকোমেটিক ডিসঅর্ডার সাবজেক্টের আওতায় রাখা হচ্ছে ভূত বিদ্যাকে। আয়ুর্বেদ বিভাগের আওতায় এই কোর্স পড়ানো হবে। সাইকিয়াট্রির সঙ্গে ভূত প্রেতের সম্পর্ক কী? এই প্রশ্ন তুলে দাবি উঠেছে অবিলম্বে কোর্সের নামবদল করা হোক। আয়ুর্বেদিক সাইকিয়াট্রি নামকরণের দাবিও উঠেছে। কিন্তু এই সিলেবাসে কী পড়ানো হবে? এখনও সেটা জানা যায়নি।
ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস আয়োজিত হল পাঁচদিন ধরে। ১০৭ বছরের পুরনো এই বিজ্ঞান কংগ্রেসের নিয়ম হল নানাবিধ গবেষণা, বিজ্ঞানের পেপার, নতুন আবিষ্কার, উদ্ভাবনের আলোর সন্ধান, বিজ্ঞানীদের পারস্পরিক আলোচনা, সেমিনার, মনোজ্ঞ বক্তৃতা ইত্যাদির মাধ্যমে অগ্রসর হওয়া আরও বিজ্ঞানমনস্ক এক উন্নত সভ্যতার দিকে। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বেঙ্গালুরুতে সমাপ্ত হয়েছে এই বিজ্ঞান কংগ্রেস। সেখানে দুটি ইন্টারেস্টিং প্রোগ্রাম ছিল। সমাপ্তি অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য বিমা স্কিম আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প নিয়ে আলোচনা। এক প্রাক্তন ইসরোর বিজ্ঞানী ও দুজন ডাক্তার ভারতের বিজ্ঞান কংগ্রেসে সমাপ্তি অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন ভারত সরকারের স্বাস্থ্য বিমার উপকারিতা নিয়ে। তবে এবার ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে আর একটি অনুষ্ঠান আরও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। বিজ্ঞান সংক্রান্ত অধিবেশনে ছিল একটি বিশেষ প্রেজেন্টেশন। কেন্দ্রীয় সরকারের উজ্জ্বলা যোজনা প্রকল্প। গরিবদের রান্নার গ্যাস দেওয়ার প্রকল্প
নিয়ে ভাষণ দেওয়া এবং কতজন সেইসব সুবিধা পেলেন দেশজুড়ে, তার বিবরণ। তবে ভাষণ দিতে
যাঁর আসার কথা ছিল, সেই ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের কর্তা আসতে পারেননি।
সুতরাং নতুন ভারত শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট করছে। সেটা অত্যন্ত কাম্য। পরীক্ষা নিরীক্ষা হোক। পরিবর্তন হোক। কিন্তু সবটাই হোক দেশের স্বার্থে। শুধুই দল অথবা সরকারের অ্যাজেণ্ডা কিংবা নীতি আদর্শ চরিতার্থ করার জন্যই যেন না হয়। সেটা হলে শিক্ষার ক্ষতি যেমন হচ্ছে, তেমনই আমরা জানতে পারছি না যে, ভারতকে নিয়ে প্রবল হাসাহাসিও হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। ভারতের ঐতিহ্যশালী আধুনিক চিন্তাধারার শিক্ষাব্যবস্থা রক্ষা করা দরকার। কারণ আজ ভারতকে গোটা বিশ্বের দরবারে সবথেকে বেশি যে সেক্টরটি সম্মান এনে দিয়েছে, সেটি হল শিক্ষা। অসংখ্য স্কলার বিশ্বে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাঁরা এই চলমান শিক্ষাব্যবস্থারই মাধ্যমেই কিন্তু ওই উচ্চাসনে বসেছেন। আজ থেকে নয়, ভারতের উন্নত শিক্ষা, সেটা দর্শন হোক অথবা বিজ্ঞান, বিশ্ববাসীকে সমৃদ্ধ করেছে প্রথম সহস্রাব্দ থেকে। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন, কীভাবে কালিদাস, শুদ্রকের সময় থেকে ভারতের গণিতবিদ্যার বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। বস্তুত ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করা আর্যভট্টের হাত ধরে এক উন্নতির শিখরে ভারত বসেছিল বিশ্বের শিক্ষাচর্চায়। পাশাপাশি বরাহমিহির, ভাস্কর, ব্রহ্মগুপ্তের মাধ্যমে ভারতের গণিতবিদ্যা বিশ্বের বহু সভ্যতাকে আলো দিয়েছে। গ্রীস, রোম, ভারত পারস্পরিক জ্ঞানের আদানপ্রদানে শিক্ষার তুঙ্গে উঠেছিল। সেই ঐতিহ্য আজও বহমান। আর সেই বহমানতা বজায় রাখতে হলে শিক্ষার উন্নত কেন্দ্রগুলিকে যত্ন করে লালন করা দরকার। যে দলেরই হোক না কেন, শিক্ষাকে রাজনীতিমুক্ত করার জন্য না ঝাঁপালে সামগ্রিকভাবে দেশের ক্ষতি।
বিশ্বের কর্পোরেট বাজারে লক্ষ্য করা যাবে, ভারতের কোনও বিখ্যাত ব্র্যাণ্ড নেই। অর্থাৎ মোবাইল
অথবা টিভি কিংবা গাড়ি অথবা ক্যামেরা এসব
কোনও ইন্ডিয়ান ব্র্যাণ্ড বিশ্বের প্রথম সারিতে নেই। ভারতের একমাত্র সম্মানীয় ব্র্যাণ্ড হল এডুকেশন ও মেধা। সেই ব্র্যাণ্ডটারই লোকসান হয়ে যাবে এভাবে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিকে বেছে বেছে মধ্যমেধায় পরিণত করা হলে।
ছাত্রসমাজ ভবিষ্যৎ দেশনির্মাতা। তাঁদের মেরুদণ্ড যদি দুর্বল করা যায়, তাঁদের চিন্তনের চালিকাশক্তি যদি নিম্নমেধাসম্পন্ন করে দেওয়া যায়, তা হলে কার লাভ? রাজনীতি ও রাষ্ট্রশক্তির। কার ক্ষতি? দেশের।