গুরুজনের চিকিৎসায় বহু ব্যয়। ক্রোধ দমন করা উচিত। নানাভাবে অর্থ আগমনের সুযোগ। সহকর্মীদের সঙ্গে ঝগড়ায় ... বিশদ
লোকসভা ভোটে তৃণমূলের বিপর্যয়ের কারণগুলির মধ্যে তিনটি বিষয়কে টিম পিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সংশোধনের পরামর্শ দিয়েছে। প্রথমত, পঞ্চায়েত ভোটে জুলুমবাজি, যা সাধারণ ভোটারদের তো বটেই, তৃণমূল সমর্থকদেরও বিরূপ করেছে। দ্বিতীয়ত, সরকারি প্রকল্প ঘিরে স্থানীয় স্তরে নেতাদের দুর্নীতি, অর্থাৎ কাটমানি। কাটমানির নেশায় বুঁদ নেতাদের জন্যই তৃণমূলের ঘরের লোক পর হয়েছে। তৃতীয়ত, নেতাদের আস্ফালন। তাতে সাধারণ মানুষ তো ক্ষুণ্ণ হয়েছেই, আত্মসম্মান নিয়ে চলা কর্মীরা হয় বসে গিয়েছেন, অথবা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন।
ক্ষত মেরামতের জন্য নেওয়া কৌশলগুলি মানুষ গ্রহণ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য উপনির্বাচন ছিল ‘অ্যাসিড টেস্ট’। নিজের ভোট নিজে দেওয়ার সুযোগ পেলে মানুষ কাকে বেছে নেয়, তা দেখতে চেয়েছিল। সেই জন্য অধিকাংশ বুথে পুলিস প্রহরায় ভোট হওয়া সত্ত্বেও শাসক দল পঞ্চায়েতের মতো ভোট করানোর রাস্তায় হাঁটেনি। ভোটারকে ভোট দিতে দিয়েছে। জুলুমের ভোটের রাস্তা পরিহার করে উপনির্বাচনে সাফল্য পাওয়ায় পুরসভা ভোটেও শাসক দল একই রাস্তায় হাঁটতে চাইছে। কারণ টিম পিকে অনুসন্ধান করে বুঝেছে, তৃণমূলের শেষের শুরু এখনও হয়নি।
টিম পিকে মনে করছে, বিজেপির ভোট মেরুকরণের রাজনীতি মোকাবিলার একমাত্র হাতিয়ার সামাজিক প্রকল্পে বেনিফিসিয়ারির সংখ্যা বাড়ানো। সে কথা মাথায় রেখে রাজ্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্পে বেনিফিসিয়ারির সংখ্যা এক ধাক্কায় অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে দ্বিগুণ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচির ফিডব্যাক বলছে, বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা এবং বাংলা আবাস যোজনায় ঘরের চাহিদা প্রচুর। বহু জায়গায় দুঃস্থদের চেয়ে নেতাদের আত্মীয়, ছেলেমেয়ে সেই সুযোগ পেয়েছে। তাই প্রকৃত গরিবের হাতে প্রকল্পের সুযোগ পৌঁছনো সুনিশ্চিত করায় জোর দিয়েছে।
ঘর পোড়া গোরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়। তাই এবার আগাম বাঁধনের ব্যবস্থাটা করেছে। কারণ পুরুলিয়া ও ঝাড়গ্রামের পঞ্চায়েত ভোট ও লোকসভা ভোট বুঝিয়ে দিয়েছে, উন্নয়ন আর সামাজিক প্রকল্পের হাত ধরেই শাসক দলে বাসা বেঁধেছে দুর্নীতি। তাই সরকারি সুযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি জোরদার করা হয়েছে নজরদারি ব্যবস্থা। তবে, সে কাজে দলীয় নেতৃত্বের উপর তৃণমূল নেত্রী ভরসা করেননি। কারণ তিনি দেখেছেন, লাভের গুড় তাঁর দলের পিঁপড়েই সাবাড় করেছে। উন্নয়নের সুফল দলের বদলে গিয়েছে নেতার পেটে। তাই এবার নজরদারির কাজে সরাসরি যুক্ত করেছে প্রশাসনকে। চালু করেছেন ‘গ্রামে চলো’। বিডিও সহ প্রশাসনের অন্যান্য কর্তারা গ্রামে গিয়ে রাত কাটাচ্ছেন। মানুষের অভাব অভিযোগ শুনছেন। তাঁদের সমস্যার কথা শোনার মধ্যেই জেনে নিচ্ছেন নেতাদের খুঁটিনাটি তথ্য। এসব দেখে অনেকেই বলছেন, ‘গ্রামে চলো’ আসলে সরকারি পর্যায়ে ‘দিদিকে বলো’। সরকারের পাশাপাশি শাসক দলের ভিত মজবুত করতেই নাকি এই জোড়া ‘ফিডব্যাকে’র ব্যবস্থা।
এখানেই শেষ নয়। কাটমানি খাওয়ার নেশা মাদকের নেশার চেয়েও ভয়ঙ্কর। এ নেশা সহজে ছাড়ানো যায় না। সেই উপলব্ধি থেকেই হয়েছে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা। প্রশাসন মাইকিং করে ঘোষণা করছে, সরকারি প্রকল্পে কেউ টাকা দাবি করলেই প্রশাসনকে জানান। অবাক করার বিষয় হলেও একথা সত্যি, কিছু কিছু এলাকায় এখনও কাটমানি চাওয়ার অভিযোগ জমা পড়ছে।
লোকসভা ভোটে ধাক্কা খাওয়ার জন্য নেতাদের আস্ফালনের বিষয়টিই সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। কারণ টিম পিকে মনে করছে, স্থানীয় নেতাদের দাম্ভিকতা, ফুলেফেঁপে ওঠার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে তৃণমূলের অনেকেই রাগে ভোট দিয়েছে বিজেপিকে। সেকথা মাথায় রেখেই পুরসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনের জন্য স্বচ্ছ প্রার্থীর অনুসন্ধান করছে টিম পিকে। তাই খোঁজ চলছে গ্রহণযোগ্য পাঁচটি করে মুখের।
সম্প্রতি কলকাতায় বিধায়ক এবং দলীয় নেতৃত্বকে নিয়ে এক আলোচনায় প্রশান্ত কিশোর এবং যুবনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, লবি করে বা দাদা-দিদি ধরে এবার টিকিট পাওয়া যাবে না। এটা যদি স্রেফ কথার কথা না হয়, তাহলে শাসক দলে প্রচুর নতুন মুখের টিকিট পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
তবে, তৃণমূল শেষ পর্যন্ত এই ঝুঁকি নিতে পারে কি না সেটাই দেখার। কারণ পুরসভা নির্বাচনে অল্প কিছু ভোট এধার ওধার হলেই জেতা আসন হাতছাড়া হয়ে যায়। তারপরেও তৃণমূল জনগণের অপছন্দের মুখগুলি ছেঁটে ফেলার সাহস দেখালে কয়েকটি পুরসভা হয়তো হাতছাড়া হবে, কিন্তু ভোট রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি সুফল ঘরে তুলবে। তাই অনেকেই মনে করছেন, পুরসভা ভোটে প্রার্থী নির্বাচন এবং ভোট পরিচালানার পদ্ধতির উপরেই নির্ভর করছে শাসক দলের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের বিষয়টি।
বাম জমানার শেষদিকে সিপিএমও প্রায় একই রকম সমস্যার মুখে পড়েছিল। দলের একাংশের মাতব্বরি বামমনস্ক মানুষকেও সিপিএমের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল। মানুষের পালস বুঝতে পেরে আলিমুদ্দিনের ম্যানেজাররা ‘শুদ্ধিকরণে’র আওয়াজ তুলেছিলেন। কিন্তু, বাস্তবায়িত করার সাহস দেখাননি। কারণ জনবিচ্ছিন্ন সিপিএমের কাছে তখন ম্যাসলম্যান ও মাতব্বররাই হয়ে উঠেছিল দলের সম্পদ। তাদের সরিয়ে দেওয়া মানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া। সেই ভয়েই সিপিএম শুদ্ধিকরণ স্লোগানের বেড়া টপকাতে পারেনি। সেই কারণেই যে সমস্ত চিন্তাশীল মানুষের কাছে একদিন বামফ্রন্ট ছিল ‘চোখের মণি’, তাঁদের কাছেই সিপিএম হয়ে গিয়েছিল ‘চোখের বালি’। তার খেসারত গুনতে হয়েছিল ২০১১ সালে।
অনেকে মনে করছেন, লোকসভা ভোটে রাজ্যবাসী শাসক দলকে সেই সংশোধনের শিক্ষাই দিয়েছে। তৃণমূল তা থেকে শিক্ষা নিয়ে পুরসভা ও বিধানসভা ভোটে প্রার্থী বাছাইয়ে স্বচ্ছতাকে গুরুত্ব দিলে ক্ষত মেরামত কঠিন হবে না। সেক্ষেত্রে টিকিট থেকে বঞ্চিতদের অনেকেই বিজেপিতে গিয়ে ভিড়বে। তাতে সাময়িক হলেও বিজেপির লাভ হবে। এখন দেখার, তৃণমূল নেতৃত্ব টিম পিকের পরামর্শ মেনে ঝুঁকি নেয় কি না! মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি রাজ্য থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় বিজেপি এতদিন নাগালের বাইরে থাকা রাজ্য দখলের মরিয়া চেষ্টা চালাবে। সেক্ষেত্রে ভোট মেরুকরণই হবে লক্ষ্য। আর হাতিয়ার হবে নাগরিকত্ব আইন। সিএএ-র প্রতিবাদে এ রাজ্যে মুর্শিদাবাদ, মালদহ এবং বীরভূমে ঘটে যাওয়া তাণ্ডবলীলাকে সামনে এনে বিজেপি হিন্দু ভোট এককাট্টা করার মরিয়া চেষ্টা চালাবে। স্বয়ং দিলীপ ঘোষ ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন, এরাজ্যে আসা ৫০ লক্ষ মুসলিমকে চিহ্নিত করে তাঁদের ভোটাধিকার সহ অন্যান্য সুযোগসুবিধা কেড়ে নেওয়া হবে।
ঝাড়খণ্ডের ভোটে পর্যুদস্ত হওয়ার পর অমিত শাহ এনআরসিকে আপাতত ‘ঠান্ডাঘরে’ পাঠিয়ে দেওয়ার পরেও দিলীপবাবুর এই হুঙ্কার রাজনৈতিকভাবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অনেকেই মনে করছেন, অত্যন্ত সচেতনভাবেই দিলীপবাবু একথা বলেছেন। তিনি মনে করছেন, একমাত্র ধর্মীয় ভাবাবেগই পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বেনিফিসিয়ারিদের টলিয়ে দিতে। তার জন্য শুধু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদানই যথেষ্ট নয়, সপ্তমে চড়াতে হবে মুসলিম বিরোধী জেহাদ। আর সেই কাজটিই তিনি জেলায় জেলায় ঘুরে চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর বক্তব্যকে ঘিরে পদে পদে দানা বাঁধছে বিতর্ক। তবুও তিনি দমছেন না। কারণ তিনি বুঝে গিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকার ও নরেন্দ্র মোদিকে ভাঙিয়ে বাংলায় গেরুয়া ঝড় তুলতে গেলে ‘ঝাড়’ হয়ে যাবে। বিজেপির বঙ্গজয়ের একমাত্র ইউএসপি হতে পারে ভোট মেরুকরণ। তাই এবার অবশ্যম্ভাবীভাবেই বঙ্গের লড়াই ভোট মেরুকরণ বনাম সরকারি প্রকল্প।