গুরুজনের চিকিৎসায় বহু ব্যয়। ক্রোধ দমন করা উচিত। নানাভাবে অর্থ আগমনের সুযোগ। সহকর্মীদের সঙ্গে ঝগড়ায় ... বিশদ
সরিৎশেখর যখন অনিমেষকে কথাগুলো বলছিলেন, তার প্রেক্ষাপট এখন থেকে প্রায় চার যুগ আগের। সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ উপন্যাসের এই শব্দগুলো আজকের পরিস্থিতির সঙ্গেও বেশ প্রাসঙ্গিক মনে হয়। আজও সেই রাজনীতির আবর্তে আবদ্ধ রাজনৈতিক নেতা, আখের গোছানোই যেখানে এক এবং একমাত্র লক্ষ্য... আর তার সঙ্গে রাজনৈতিক দিশাহীন ছাত্র রাজনীতি। শনিবার ধর্মতলার ধর্না-বিক্ষোভ থেকে যখন শোনা যাচ্ছে, ‘নরেন্দ্র মোদিকে যেতে গেলে আমাদের ছাত্রদের বুকের উপর দিয়ে যেতে হবে’, সেটাও বেশ অদ্ভুত একটা অনুভূতি। সত্যিই কি তাহলে এই একটা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ইস্যু ছাত্রসমাজকে একটা উদ্দেশ্য দিল? প্রতিমা গড়নের সঙ্গে সঙ্গে ভক্তিও?
আপাতদৃষ্টিতে উত্তরটা হ্যাঁ। আবার দূরদৃষ্টির কথা বললে... এখনও বলার সময় আসেনি। নামজাদা বেসরকারি কোম্পানির এক উচ্চপদস্থ কর্তা বলছিলেন, ‘এদের কজন আইনের ড্রাফ্ট পুরোটা ঠিকমতো পড়েছে জিজ্ঞেস করবেন। বাজি রাখছি, ১০০ জনে দু’জন পাবেন কি না সন্দেহ।’ কথাটা হয়তো ঠিক। সবাই শুনেছে, চায়ের দোকানে তর্ক করেছে, ভাসা ভাসা জেনেছে, আর তারপরই শুরু হয়ে গিয়েছে আন্দোলন। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ লাগাতার বলে আসছেন, এটা নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার আইন নয়। নাগরিকত্ব প্রদানের আইন। বিরোধীদের দাবি এবং সাধারণ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের বিশ্লেষণ হল, এই আইন ধর্মীয় বিভাজক হয়ে দেখা দেবে। গত শুক্রবার রাতেই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন দেশে কার্যকর হয়ে গিয়েছে। এর প্রভাব, পরিণতি বা নেপথ্যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা চলছে-চলবে। প্রশ্ন হল, ছাত্র রাজনীতি এবং আন্দোলন কি এই ইস্যুতে সত্যিই একটা মাত্রা পাবে?
অনিমেষ যখন ছাত্র রাজনীতিতে এসেছিল, সেটা রাজ্য রাজনীতির ইতিহাসের অন্যতম টালমাটাল সময়। নকশালবাড়ি আন্দোলন বাংলার ছাত্রসমাজের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল আকাশছোঁয়া, কিন্তু পদ্ধতি ছিল ভুল। সেই ‘সশস্ত্র বিপ্লবে’র আগুনে পুড়ে গিয়েছিল বহু ভবিষ্যৎ। তারপর তারা আবিষ্কার করেছিল, দাহ্যবস্তুর সত্যিই কোনও সৃষ্টিশীল ক্ষমতা নেই। স্বাধীনতার পর খুব কম ইস্যু ছাত্রসমাজকে, ছাত্র রাজনীতিকে সঠিক কোনও দিশা দেখাতে পেরেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রসমাজ যে এগিয়ে এসেছিল, তার একটা নির্দিষ্ট চালিকাশক্তি ছিল। দেশ। স্বাধীনতা। ১৯৪৭ সালের পর যে উদ্দেশ্যটা শেষ হয়ে যায়। তখন নতুন এমন কোনও চালিকাশক্তি ছিল না, যা ছাত্রসমাজকে বা আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেল ছাত্র রাজনীতিকে একটা ইতিবাচক লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। রাজনৈতিক নেতারা ছিলেন নিজেদের কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। ছাত্ররাও তাই। জাতীয় রাজনীতিতে ছাত্রসমাজের ভূমিকা বলতে আর কিছুই ছিল না। সবটাই রাজ্যভিত্তিক। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসনির্ভর। হস্টেলের ফি বৃদ্ধি নিয়ে আন্দোলন রাস্তায় নেমে আসতে পারে, কিন্তু দেশের অর্থনীতি শুধরাতে সরকারের কী করা উচিত, সে ব্যাপারে নতুন প্রজন্মের কোনও নির্দিষ্ট পরামর্শ থাকবে না কেন? নকশালবাড়ি আন্দোলনের দিশা প্রশ্নাতীত নয়। কিন্তু জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলন? সেই স্রোত ইন্দিরা গান্ধী সরকারকে পর্যন্ত টালমাটাল করে দিয়েছিল। তবে প্রকাশ্যে না হলেও নেপথ্যে কোথাও না কোথাও রাজনৈতিক রং বা আদর্শ ছিলই। ওই যে কথাটা... নিজেকে ভারতীয় ভেবে গর্ব বোধ করে, ভারতের জন্য আন্দোলন... সেটা কি হয়েছিল? হয়তো হয়েছিল... হয়তো কোনও কোনও ছাত্র সত্যিই রাজনীতির ব্যানারের বাইরে থেকেও শুধু দেশের জন্যই আত্মত্যাগ করেছিলেন। ত্যাগ ছাড়া সমাজ বা দেশ, কোনওটাই সম্পূর্ণ হয় না। সবটাই দাঁড়িপাল্লার খেলা। কেউ কোথাও ত্যাগ করেছে বলেই উল্টোদিকের আর একজন গ্রহণ করতে পেরেছে। ব্যালান্স। এর উপরই দাঁড়িয়ে পৃথিবী, রাজনীতি, আন্দোলন।
জেএনইউয়ের হস্টেল ফি বৃদ্ধি নিয়ে আন্দোলন আজ জাতীয় রাজনীতির প্রধান চর্চা। আর তার জন্যও দায়ী রাজনীতি। জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে পুলিসের বিরুদ্ধে হামলা। শুরুটা এখান থেকেই। পুলিসের অভিযোগ ছিল, জামিয়ার পড়ুয়ারা দিল্লির রাস্তায় পুলিসের উপর চড়াও হয়েছে। তার পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে কিছু তো করতে হতো! কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কিন্তু পুলিস ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারে না! তারা সেটাই করেছিল। এমনকী সেদিন ভাঙচুর হয় লাইব্রেরি... যেখানে মিলেছিল কাঁদানে গ্যাসের শেলও। কোনও পড়ুয়ার চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কারও ভেঙেছে হাত। এই ঘটনা গোটা দেশের ছাত্রসমাজকে খেপিয়ে দিয়েছে। যে বিক্ষোভ কয়েকটা জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে হচ্ছিল, তা নেমে এসেছে রাস্তায়... দেশের নানা প্রান্তে। প্রায় সব বড় শহরে। ছাত্রসমাজের প্রতি কি এতটুকু সহিষ্ণুতা সরকার দেখাতে পারত না? এর নেপথ্যে তাহলে কী ছিল? শুধুই নিরাপত্তাহীনতা? ইন্দিরা গান্ধী না হয় ইমার্জেন্সি জারি করে হাত পুড়িয়েছিলেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির জমানায় পুলিস বা পুলিসকে চালানেওয়ালারা কেন এতটুকু সহিষ্ণু হবে না! আজকের যা পরিস্থিতি, তার নেপথ্য সম্ভাবনা অনেকগুলো হতে পারে... প্রথমত, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন সত্যিই ধর্মীয় বিভাজন আনছে। সেটা যাতে জনমানসে আগুনের মতো ছড়িয়ে না পড়ে, সেই কারণেই আগেভাগে দমন করে দেওয়া ভালো। দ্বিতীয়ত, সবটাই ধন্দ। এমন কিছুই হবে না। বিরোধী প্রচারে প্রভাবিত হয়েই ভারতের আগামী প্রজন্ম আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে কি তাদের বোঝানোটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না? যে পড়ুয়ারা আজ পথে নেমেছে, তারা তো শিক্ষিত! এঁটেল মাটির তালের মতো। যুক্তি দিয়ে বোঝালে তারা অবাধ্য হয় না। তা না করে নয়াদিল্লি বা উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে পাল্টা ধোলাই দেওয়ার রাস্তা নিয়েছিল পুলিস। আর বলা হয়েছে, মানতে না পারলে পাকিস্তানে চলে যাও। এটাই কি ভারতের মতো গণতন্ত্রের থেকে পাওনা? যুব সমাজ কিন্তু মানছে না। মানবেও না। দিন নেই, রাত নেই তারা কখনও ক্যাম্পাসে ধর্নায় বসছে, কখনও রাজপথে। তাদের লড়াই আজ নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন আগ্রাসী কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে। দেশের ছাত্রসমাজের স্লোগান আজ একটাই, সিএএ বাতিল করতে হবে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কেন্দ্র বিরোধী এই লড়াইয়ে তাদের প্রধান অস্ত্র। ক্যাম্পাসভিত্তিক, দলবিরোধী রাজনীতির প্রেক্ষাপট ছেড়ে বেরিয়ে এই আন্দোলন আজ হয়ে উঠেছে দেশের জন্য। যেখানে প্রতিমা আছে। আর ভক্তিও।
ঐশী ঘোষ কোন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করেন, তা বারবার প্রচারে আনছে বিজেপি। মানুষের কাছে কিন্তু তিনি জেএনইউয়ের এক পড়ুয়া। তাঁকে দিল্লি পুলিস অন্য মামলায় অভিযুক্ত করছে। অথচ যারা মাথা ফাটিয়ে ঐশীকে রক্তস্নাত করল, সেই মুখোশধারীদের হদিশ নেই। এই ছাত্রছাত্রীরা আজ গর্ববোধ করছেন নিজেদের ভারতীয় বলতে। শুধু কেরিয়ার নয়, মানুষের জন্য তাঁদের লড়াই। দেশের জন্য তাঁদের বিপ্লব। কোনও দলের জন্য নয়। নরেন্দ্র মোদি সরকারের যদি আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ থাকে, তাহলে তা ছাত্রসমাজ। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন মুলুকে প্রথম আওয়াজ তুলেছিলেন ছাত্ররা।
আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে সেই সময় ছাত্রসমাজের প্রশ্ন ছিল, ‘এত দূরের দেশে কেন আমেরিকা যুদ্ধ করবে? কেন ভিয়েতনামে গিয়ে আমাদের দেশের হাজার হাজার তরুণ প্রাণ দিয়ে আসবে?’ সেই আন্দোলনে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল মার্কিন সরকার। ভিয়েতনামে ধাক্কা তারা খেয়েইছিল, পাশাপাশি দেশেই ছাত্রসমাজের কাছে হার স্বীকার করতে হয়েছিল আমেরিকাকে। তেমন কিছু আজ হয়তো ভারতের সঙ্গে হতে চলেছে। সরকার যতই দাবি করুক, সব কিছু স্বাভাবিক রয়েছে... আদৌ কি তাই? বাড়তে থাকা অপরাধ প্রবণতা এই দাবির সবচেয়ে বড় অন্তরায়। নৃশংস ধর্ষণ, খুন, সমাজের আগ্রাসী হয়ে ওঠা কোনও রাষ্ট্রের জন্য ভালো বিজ্ঞাপন নয়! ধর্মীয় মেরুকরণ যে প্রবণতায় আরও বেশি অনুঘটকের কাজ করছে। একজন পড়ুয়াও চাইলে বিশ্বের স্বার্থান্বেষী ভাবনায় আঘাত হানতে পারে... গ্রেটা থুনবার্গ তার সবথেকে বড় প্রমাণ। দিনের পর দিন স্কুল কামাই করে পথে বসে থেকেছেন পরিবেশের জন্য। দূষণের ধারক-বাহক দেশগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, নতুন প্রজন্মের জন্য আপনারা ভাবতে বাধ্য। ছাত্র রাজনীতি থেকে যদি নেতা বা নেত্রী উঠে আসে, তাহলেই একটা দল বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে একটা দেশ এগিয়ে যায়। ভারতের ছাত্রসমাজও যদি আন্দোলনের প্রতি এই সততা বজায় রাখতে পারে, আজ না হয় কাল পরিস্থিতি বদলাবেই। এখান থেকেই ফের উঠে আসবে সত্যিকারের নেতা। যাদের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসবে আরও অনেকে। রাজনীতির জন্য। আর অবশ্যই, দেশের স্বার্থে।