অজ্ঞানের আবরণ ও বিক্ষেপ নামক দুইটি শক্তি আছে। আবরণ শক্তি সত্যবস্তুকে আবৃত করে এবং বিক্ষেপ শক্তি সত্যবস্তুকে অসত্য বা মিথ্যা বস্তুরূপে দেখায়। যেমন অজ্ঞান দ্বারা আবৃত রজ্জু কেবল মাত্র রজ্জুবিষয়ক ভ্রম উৎপন্ন করে না, পরন্তু রজ্জুতে সর্পরূপ সৃষ্টি করে, সেইরূপ অজ্ঞানশক্তি দ্বারা আবৃত আত্মায় কর্তৃত্ব ভোক্তৃত্ব সুখিত্ব দুঃখিত্বাদি দৃষ্ট হয় এবং ইহার ফলে অজ্ঞান ব্যক্তি নিত্যমুক্ত আত্মাকে বদ্ধ বলিয়া মনে করে। একই ঈশ্বর জগতের উপাদান ও নিমিত্ত কারণ উভয়ই। মাকড়সা যেমন শরীররূপে ইহার জালের উপাদান-কারণ এবং চৈতন্য (প্রাণশক্তি) রূপে জালের নিমিত্ত-কারণ, সেইরূপ একই ঈশ্বর তাঁহার মায়া-শরীররূপে জগতের উপাদান-কারণ এবং চৈতন্যরূপে নিমিত্ত-কারণ। এইরূপে ব্যষ্টিজীবও তাহার উপাধি অজ্ঞানরূপে স্বকীয় স্থূল-সূক্ষ্ম শরীরের উপাদান-কারণ এবং চৈতন্যরূপে নিমিত্ত-কারণ। জীবের পূর্ব পূর্ব জন্মের কর্মানুসারে ফলদানের জন্য ঈশ্বর জগৎ-সৃষ্টির ইচ্ছা করায় জগৎ সৃষ্ট হইয়াছে। জীবকর্মানুরোধে জীবের ভোগ-সম্পাদনের জন্য ঈশ্বরের এরূপ ইচ্ছা হয়। সৃষ্টির মূলে ঈশ্বরের নিজের কোন প্রয়োজন নাই। তিনি সকল বিষয়ে সদাপূর্ণ; তাঁহার অপ্রাপ্ত কিছু থাকিতে পারে না। গীতার মতে “তিনি সর্বভূতে সম বলিয়া তাঁহার দ্বেষ্য ও প্রিয় কোন জীব বা বস্তু নাই।” জীবের কর্মফল-প্রদানে জীব-কর্মানুরোধে ঈশ্বর যখন উদাসীন থাকেন তখন প্রলয় উপস্থিত হইয়া থাকে। প্রলয়ে কার্যবস্তুসমূহ ইহাদের নিজ নিজ কারণে বিলীন হয় এবং জীবের কর্ম মায়াতে সূক্ষ্মরূপে অবস্থান করে। পুনরায় জীব-কর্মানুরোধে ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেন। সৃষ্টির সত্তাংশ চৈতন্যের এবং মিথ্যাংশ মায়ার কার্য। চৈতন্য সকল ভূতেরই সত্তা। প্রশ্ন উঠে—সর্বপ্রথম সৃষ্টিতে জীবের কর্মানুসারে জন্ম এবং ফলভোগ কিরূপে হইয়াছিল? উত্তরে বৈদান্তিকগণ বলেন, ঈশ্বর জীব ও সৃষ্টি এই তিনই অনাদি বলিয়া এই প্রশ্ন উঠিতে পারে না। এই হেতু জীবের উৎকৃষ্ট ও অপকৃষ্ট ভোগের জন্য ঈশ্বরে পক্ষপাতিত্ব-দোষ ঘটে, কিন্তু সেই দোষের আরোপ করা অযৌক্তিক। পক্ষান্তরে ঈশ্বর জীব ও সৃষ্টি ব্যবহারিক দৃষ্টিতে সত্য হইলেও পারমার্থিক দৃষ্টিতে মায়ার খেলামাত্র। জ্ঞানীর দৃষ্টিতে জীবত্ব ঈশ্বরত্ব ও বিশ্বপ্রপঞ্চ অজ্ঞান-কল্পিত, একমাত্র ব্রহ্মই সত্য। বেদান্তমতে অজ্ঞানের বিক্ষেপশক্তি-প্রভাবেই সত্যস্বরূপ ব্রহ্ম ব্রহ্মরূপে প্রতীত না হইয়া মিথ্যা নাম-রূপময় জগৎরূপে প্রতীত হইতেছেন। অজ্ঞান সমূলে বিনষ্ট হইলে ‘আমি জীব’ বোধ এবং জগদ্দর্শন আর হয় না। যত দিন প্রারব্ধরূপ শরীর থাকে ততদিন ‘আমি জীব’ বোধ এবং জগদ্দর্শন হইলেও ইহা মিথ্যা বলিয়া নিশ্চয় হয়, ইহাতে আর সত্যতা বোধ থাকে না।
অধ্যারোপ
ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মভাবে আরূঢ় হইয়া বলিয়াছেন, “আমি সকল ভূতের বীজ।” উপনিষদে আছে, “ব্রহ্ম জগৎ সৃষ্টি করিয়া তন্মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া আছেন।” “ব্রহ্ম হইতে প্রাণ মন ও সর্বেন্দ্রিয়” এবং “আত্মা হইতে আকাশ সম্ভূত হইয়াছে।”
স্বামী সুন্দরানন্দের ‘যোগচতুষ্টয়’ থেকে