নিজস্ব প্রতিনিধি, নয়াদিল্লি: নির্বাচন কমিশন থেকে সরকার, যুগ যুগ ধরে দেশবাসী তাদের থেকে শুনে এসেছে, প্রত্যেকটা ভোট গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক ভারতবাসী তাঁর অধিকার দাবি করতে পারেন একমাত্র ভোটদানের মাধ্যমে। অর্থাৎ, এই দেশের ১৪০ কোটি নাগরিক সরকার নির্বাচন করেন পরের পাঁচ বছর সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের আশায়। তাঁরা বিশ্বাস করেন, এই সরকার তাঁদের জন্য কিছু করবে। কিন্তু তৃতীয় ইনিংসের লক্ষ্যে ছুটতে থাকা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কি এখন সেই ভাবনার উপরও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে চাইছেন? কারণ সোমবার তিনি সাফ বুঝিয়ে দিয়েছেন, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাপনে সরকারের ভূমিকা থাকারই নাকি প্রয়োজন নেই। তাঁর প্রশ্ন, গরিব মানুষ ছাড়া বাকিদের জন্য সরকারের প্রয়োজনটা কী? বিশেষ করে তাঁর নিশানায় মধ্যবিত্ত। দিল্লির ভারত মণ্ডপমে বস্ত্রশিল্প সংক্রান্ত এক প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মোদির দাবি, ‘আগামী পাঁচ বছরে আমি এমন ব্যবস্থা কার্যকর করব যে, দেশবাসীর জীবনে সরকারের ভূমিকাই কমে যাবে। বিশেষ করে মধ্যবিত্তের। মানুষ তো নিজেদের কাজ নিজেরা করতেই সমর্থ। সেটাই তারা করুক না! সমস্যায় পড়লে তখন সরকার সাহায্য করতে পারে। এর বেশি কিছু নয়।’
বিষয়টা পরিষ্কার। মধ্যবিত্তের দায় আর নিতে চান না মোদি। অথচ, এই মধ্যবিত্তই সবচেয়ে বেশি ভোগ্যপণ্য কিনে বাজার অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখে, আয়কর দেয়, মূল্যবৃদ্ধি-বেকারত্বের জ্বালায় ভোগে, আর তারপরও প্রধানমন্ত্রী তাদের দায় নিতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘বহুদিন ধরেই আমি এরকম ব্যবস্থার পক্ষপাতী। আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই এই ব্যবস্থা কার্যকর হবে। সরকারের ভূমিকা হবে শুধু অনুঘটকের।’ তাহলে তৃতীয়বার ক্ষমতায় এলে সরকারের কাজ কী হবে? ঠিক কেমন ব্যবস্থা কার্যকর করতে চাইছেন মোদি? প্রধানমন্ত্রীর দাবি, ‘সব দেশবাসীর জন্য এটা বলা হচ্ছে না। সরকার অবশ্যই গরিবদের সহায়তা দেবে। কিন্তু মধ্যবিত্তের সরকারকে দরকার নেই বলেই আমি মনে করি!’
মোদির এই অবস্থান নিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়েছে। তিনি অবশ্য সেই রহস্য খোলসা করেননি। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণের আগে এবং পরে মোদি বহু স্লোগান দিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি স্লোগান প্রথম পাঁচ বছর কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপি লাগাতার প্রচার করেছে—মিনিমাম গভর্নমেন্ট ম্যাক্সিমাম গভর্ন্যান্স। ১০ বছর পরও এই স্লোগানের প্রকৃত অর্থ দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট হয়নি। কারণ সরকার পরিচালনার চিরাচরিত কাঠামো ও প্রক্রিয়া আগে যা ছিল, এখনও তাই আছে। সেই স্লোগান ধোঁয়াশা হয়েই রয়ে গিয়েছে। এবার নতুন সমীকরণ। মানুষের জীবনে সরকারের ভূমিকা কোন অঙ্কে তিনি নগণ্য করে দিতে চাইছেন, সেটা স্পষ্ট নয়। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি মধ্যবিত্ত আর সরকারের থেকে সরাসরি কোনও আর্থিক সহায়তা পাবে না? নাকি মোদির মনে অন্য কোনও পরিকল্পনা রয়েছে? এদিনের ভাষণে মোদি বুঝিয়ে দিয়েছেন, সরকারের উপর যেন দেশবাসীর অতি নির্ভরতা না আসে। তাহলে সরকার কী করবে? স্পষ্ট করেননি তিনি।
তবে এ ব্যাপারে ধোঁয়াশা রাখলেও বাংলাকে অগ্রাধিকার না দেওয়ার প্রশ্নে তাঁর যে কোনও সংশয়ই নেই, তা চাপা থাকেনি। এদিন টেক্সটাইল প্রদর্শনীর উদ্বোধন করে তিনি বলেন, ‘ভারতের বস্ত্র বৈচিত্র্যের সম্ভার ঐক্য ও সমন্বয়ের উদাহরণ।’ তিনি কাশ্মীরের কানিশাল, উত্তরপ্রদেশের জারদৌসী, বেনারসী, তামিলনাড়ুর কাঞ্জীভরম, ওড়িশার সম্বলপুরী, গুজরাতের পটোলা এবং মহারাষ্ট্র সিল্কের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বাংলার কথা কিন্তু তাঁর মনে আসেনি। তসর থেকে ধনেখালি, মুর্শিদাবাদ সিল্ক থেকে বালুচরীর নাম স্থান পায়নি তাঁর ভাষণে। এদিন তিনি আরও ঘোষণা করেন, দেশে সাতটি পিএম মিত্র পার্ক হচ্ছে। এর মাধ্যমে ভারতের বস্ত্রশিল্প উন্নত হবে। বাংলা? এই তালিকাতেও নেই।