বিদ্যার্থীদের ক্ষেত্রে ভাবনা-চিন্তা করে বিষয় নির্বাচন করলে ভালো হবে। প্রেম-প্রণয়ে বাধাবিঘ্ন থাকবে। কারও সঙ্গে মতবিরোধ ... বিশদ
কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রচুর ফলন পাওয়ার আশায় কৃষকদের অনেকেই দিনের পর দিন চাষের জমিতে যথেচ্ছ হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করে এসেছেন। এর ফলে মাটি তার স্বাস্থ্য হারাতে বসেছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মাটির স্বাভাবিক গঠন, জলধারণ ক্ষমতা। কমছে মাটিতে বসবাসকারি উপকারি জীবাণুর সংখ্যা। এভাবে চলতে থাকলে মাটি পুরোপুরি বন্ধ্যা হয়ে যাবে। এর থেকে বাঁচতে একমাত্র পথ জৈব কৃষি।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, জৈব কৃষির মূল কথা হল, রাসায়নিক সার, কীটনাশক বা রোগনাশক বা আগাছানাশক ব্যবহার না করা। স্থানীয় প্রযুক্তি ও সহজলভ্য উপকরণ ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন। মাটিতে বসবাসকারি উপকারি জীবাণুর সংখ্যা এবং মাটির মধ্যে জৈব বস্তুর পরিমাণ বৃদ্ধি করা। মাটির উর্বরতা ও ফসলের উৎপাদনশীলতা বজায় রাখা। শুধু চাষবাস নয়, মিশ্র খামার পদ্ধতি অর্থাৎ একইসঙ্গে কৃষি, প্রাণীপালন ও মাছচাষ প্রভৃতির সমন্বয় ঘটানো। কৃষি বিজ্ঞানীদের দাবি, গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে জৈব কৃষির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। জৈব পণ্য স্বাস্থ্য ও পরিবেশের পক্ষে নিরাপদ। জৈব ও জীবাণুসার প্রয়োগের ফলে মাটিতে বা ফসলে রাসায়নিক দূষণ ঘটে না।
জমিতে প্রয়োগ করা রাসায়নিক সারের অপচয় অনেক বেশি। তুলনায় জৈব ও জীবাণুসার কম পরিমাণে লাগে। পতিত জমিকে জৈব কৃষির আওতায় এনে চাষের এলাকা বাড়ানো যায়। জৈব কৃষির ফলে জীব বৈচিত্র রক্ষা পায়। মাটির উর্বরাশক্তি বজায় রেখে টেঁকসই কৃষি ব্যবস্থার জন্য জৈব কৃষিই একমাত্র বিকল্প পথ বলে মনে করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
অ্যাজোলা, ধইঞ্চা চাষ করে জমিতে মিশিয়ে দিতে পারলে মাটির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি পায়। জৈব কৃষিতে তরল সার প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গাছ সহজেই তরল সার গ্রহণ করতে পারে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কয়েকটি পরীক্ষিত ও সুপারিশকৃত জৈব তরল সার বলতে সঞ্জীবক, জীবাম্রুত, পঞ্চগব্য, সমৃদ্ধ পঞ্চগব্য প্রভৃতি। ২০ কেজি গোবর, ১০ লিটার গোমূত্র, ৫০০ গ্রাম ঝোলাগুড়, ৩০ লিটার জলে গুলে আবদ্ধ ড্রামে ১০দিন ধরে পচানো হয়। তার পর ওই মিশ্রণ জলে মিশিয়ে ২০ গুণ বৃদ্ধি করে তৈরি হয় সঞ্জীবক তরল সার। জীবাম্রুত তৈরি করার পদ্ধতি, ১০ কেজি গোবর, ১০ লিটার গোমূত্র, ২ কেজি ঝোলাগুড়, ২ কেজি গমের আটা, ২ কেজি জৈব বস্তু সমৃদ্ধ মাটি ২০০ লিটার জলে ৫-৭ দিন পচানো হয়। পচানোর সময় দিনে তিনবার করে দ্রবণটিকে নাড়ানো হয়। সেচের জলের সঙ্গে মিশিয়ে এটি প্রয়োগ করা যেতে পারে। একটি ফসলে তিনবার এই মিশ্রণ প্রয়োগ করা যায়। প্রথমবার বীজ বোনার আগে, দ্বিতীয়বার বীজ বোনার ২০দিন পর, তৃতীয়বার ৪৫ দিন পর। পঞ্চগব্য তৈরির পদ্ধতি, ৪ কেজি গোবর গোলা, ১ কেজি টাটকা গোবর, ৩ লিটার গোমূত্র, ২ লিটার গোরুর দুধ, ২ লিটার দই, ১ কেজি মাখন তেল মিশিয়ে আবদ্ধ পাত্রে ৭দিন পচাতে হবে। প্রত্যেকদিন ২ বার করে মিশ্রণটি নাড়তে হয়। ২০ লিটার পঞ্চগব্য জলে গুলে ৬০০ লিটার মিশ্রণ তৈরি করে ১ একরে স্প্রে করা হয়। এটি দিয়ে বীজ শোধনও করা যেতে পারে। সমৃদ্ধ পঞ্চগব্য তৈরির পদ্ধতি হল, ১ কেজি টাটকা গোবর, ৩ লিটার গোমূত্র, ২ লিটার গোরুর দুধ, ২ লিটার দই, ১ কেজি দেশি ঘি, ৩ লিটার আখের রস, ৩ লিটার ডাবের জল, ১২টি পাকা কলা একসঙ্গে মিশিয়ে আবদ্ধ পাত্রে ৭দিন ধরে পচাতে হয়। ২০ লিটার এই মিশ্রণ ৬৫০ লিটার জলে গুলে এক একরে স্প্রে করতে হবে।
জমিতে গোবর সার, খামার সার, কম্পোস্ট সার, কেঁচোসার, নানা ধরনের খোল, হাড়ের গুঁড়ো প্রভৃতি প্রয়োগ করেও মাটির উর্বরাশক্তি বাড়ানো যেতে পারে। প্রতি একরে ১০ টন অ্যাজোলা মাটিতে মিশিয়ে দিলে ২৫ কেজি নাইট্রোজেন জমিতে যোগ হয়। জীবাণুসার প্রয়োগ করেও ২০-৩০ কেজি নাইট্রোজেন ও ১২-২০ কেজি ফসফরাস গাছের গ্রহণযোগ্য অবস্থায় এনে দেওয়া যায় বলে জানিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের দাবি, ধইঞ্চা চাষে প্রতি একরে ৭০ কুইন্টাল জৈব সার ও ২০-২৫ কেজি নাইট্রোজেন, শন চাষে সমপরিমাণ জৈবসার ও ১৪-১৫ কেজি নাইট্রোজেন যুক্ত হয়। জৈব কৃষিতে কচুরিপানা, খড়, তুষ প্রভৃতি জমির উপর জৈব আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন জমিতে আগাছা নিয়ন্ত্রণে থাকে, তেমনই সার, জলের অপচয় রোধ হয়। ফলে পরিচর্যা জনিত খরচ কমে। তাছাড়া জৈব আচ্ছাদন ধীরে ধীরে পচে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার ফলে মাটিতে জৈব পদার্থের জোগান বৃদ্ধি পায়। এবং ফসল সেই খাদ্যোপদান সংগ্রহ করতে পারে।
কৃষি বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, জৈব কৃষিতে একটি খামারে একক ফসলের গুরুত্ব নেই। প্লট ভাগ করে অন্তত ৭-৮ রকমের ফসল লাগানো উচিত। তার মধ্যে একটি অবশ্যই ডাল জাতীয় ফসল থাকতে হবে। উচ্চ খাদ্য চাহিদাযুক্ত ফসলের আগে ও পরে ডাল চাষ করতে পারলে ভালো। রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষতিকর দিকের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন উদ্ভিদজাত কীটনাশক ব্যবহারে জোর দেওয়া হচ্ছে জৈব কৃষিতে। নিম, তামাক, ধুতুরা, চন্দ্রমল্লিকা, করঞ্জা, থুজা, রসুন, জোয়ার প্রভৃতি গাছের নির্যাস থেকে কীটনাশক তৈরি হচ্ছে। ফসলের বিভিন্ন পর্যায়ে জৈব প্রযুক্তি প্রয়োগ করা যায়। যেমন, বীজ শোধনে ব্যবহার করা যেতে পারে বিজাম্রুত। ৫ কেজি গোবর, ৫ লিটার গোমূত্র, ৫০ গ্রাম বাগানের মাটি, অল্প পরিমাণ গোরুর দুধ, ৫০ গ্রাম কলিচুন এবং ১০ লিটার জল দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে পরে তা বীজের গায়ে মাখিয়ে দিতে হবে। ওই দ্রবণে চারার শিকড় আধঘণ্টা ডুবিয়ে রেখে তুলে ছায়ায় শুকিয়ে নিয়ে জমিতে লাগানো যেতে পারে। এতে বীজ ও চারা শোধন হয়ে যায়। হলুদ গুঁড়ো মেশানো গোমূত্র, পঞ্চগব্য নির্যাস, জীবাণুসার, ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি দিয়েও বীজ শোধন করা যায়। শস্যরক্ষায় ব্যবহার করা যেতে পারে দশপর্ণী। ৫ কেজি নিমপাতা, ২ কেজি নিশিন্দা পাতা, ২ কেজি ঈশ্বরীমূল পাতা, ২ কেজি পেঁপে পাতা, ২ কেজি গুলঞ্চ পাতা, ২ কেজি আতা পাতা, ২ কেজি করঞ্জা পাতা, ২ কেজি রেড়ি পাতা, ২ কেজি করবী পাতা, ২ কেজি মাদার পাতা, ২ কেজি কাঁচালঙ্কা, ২৫০ গ্রাম রসুন, ৩০ কেজি গোবর একসঙ্গে করে জলে মিশিয়ে আবদ্ধ পাত্রে ১০ দিন পচাতে হবে। প্রত্যেকদিন ৩বার করে ওই মিশ্রণ নেড়ে দিতে হবে। তার পর ছেঁকে ওই মিশ্রণ জলে মিশিয়ে ২০০ লিটার করতে হবে। ৬ মাস পর্যন্ত এই নির্যাস সংরক্ষণ করা যায়। ফসলে দয়ে পোকা, শোষক পোকা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োগ করা যেতে পারে নিমাস্ত্র। ৫ কেজি নিমপাতা, ২ লিটার গোবর, ৫ লিটার গোমূত্র একসঙ্গে মিশিয়ে আবদ্ধ পাত্রে পচাতে হবে। তার পর ওই মিশ্রণ ছেঁকে জল মিশিয়ে ১০০ লিটার করে জমিতে স্প্রে করা যেতে পারে। শোষক পোকা ও শুঁটি ছিদ্রকারি পোকা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা যেতে পারে ব্রহ্মাস্ত্র। ৩ কেজি নিমপাতা, ১০ লিটার গোমূত্র, ২ কেজি আতাপাতা, ২ কেজি পেঁপে পাতা, ২ কেজি ডালিম পাতা, ২ কেজি পেয়ারা পাতা থেঁতো করে এসঙ্গে মেশানো হয়। মিশ্রণটি ফুটিয়ে পরিমাণে অর্ধেক করা হয়। ওই নির্যাস আড়াই লিটার নিয়ে ১০০ লিটার জলে মিশিয়ে তা এক একর জমিতে প্রয়োগ করলে সুফল মিলবে বলে দাবি কৃষি বিশেষজ্ঞদের।