সোহম কর: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অপরাজিত’ উপন্যাসে শেষ পর্যন্ত অপু ও তাঁর বছর ছ’য়েকের ছেলে কাজলের কী হয়েছিল? কোন দিকে গিয়েছিল বাবা-ছেলের সম্পর্ক? সেই নিয়েই পরিচালক শুভ্রজিত্ মিত্র তৈরি করেছেন ‘অভিযাত্রিক’। গোটা ছবিটাই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। ২৬তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে এই ছবিটি দেখানো হয়। দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন ‘অপু’ অর্জুন চক্রবর্তী। নিঃসন্দেহে তাঁর অভিনয়ের তারিফ করতে হয়। আর তারিফ করতে হয় শুভ্রজিতের সাহসের। কথা প্রসঙ্গে পরিচালক সাংবাদিক সম্মেলনে বলছিলেন, তিনি অনেকবার ভেবেছেন বিভূতিভূষণের এই উপন্যাসের শেষ ১০০-১৫০ পাতা নিয়ে তো সত্যজিত্ রায় ছবি তৈরি করেননি। তাহলে এই অংশটি নিয়ে এখনও বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কিংবা গৌতম ঘোষের মতো পরিচালকরা ছবি তৈরি করলেন না কেন! বর্ষীয়ান পরিচালকরা করেননি বলেই হয়তো এই তরুণ বাঙালি ‘অভিযাত্রিক’ তৈরি করার সাহস পেলেন। 
সত্যজিত্ রায় ‘পথের পাঁচালি’ ও ‘অপরাজিত’ উপন্যাস নিয়ে অপু ট্রিলজি তৈরি করে গিয়েছেন, সেই চরিত্রগুলোকে নিয়ে কাজ করলে আবেগপ্রবণ বাঙালি তো প্রথমে একটু হলেও চোখ বড় করবেনই। কিন্তু ‘অভিযাত্রিক’ ছবিটি অনেকটা নরম কাশফুলের উপর হাত বোলানোর মতো আরাম দেয়। সিনেমাটোগ্রাফি থেকে সংলাপ সব কিছুর মধ্যেই শীতের দুপুরের হালকা রোদের আমেজ। তেমনই কিছু দৃশ্য দেখে মনে হয় উত্তরের দমকা হাওয়া গায়ে কাঁটা দিয়ে গেল। ছবিতে বিমলেন্দুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন শুভ্র এস দাস। স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এই চরিত্রে শুভ্র চমত্কার অভিনয় করেছেন। তাঁর দুই চোখের মধ্যেই গভীর বিপ্লবের আগুন রয়েছে। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, অসুস্থ অপু বাড়ির বাইরে বের হতে পারছে না। ছোট্ট কাজল হাতে দুধের ক্যান নিয়ে দুধ আনতে গিয়েছে। ঠিক সেই সময় স্বদেশীদের উপর ব্রিটিশ পুলিস গুলি চালায়। ধাক্কাধাক্কির মধ্যে কাজলকে উদ্ধার করে বিমলেন্দু এবং অসুস্থ অপুর হাতে তুলে দিয়ে শীতল কণ্ঠে বলে ওঠে ‘বন্দেমাতরম’। এই দৃশ্য গায়ে কাঁটা দেয়। নব্য জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় শুভ্রজিতের ছবির এই দৃশ্য। 
কিছু কিছু দৃশ্য আবার চোখের কোণে জলের সঞ্চার ঘটায়। অপুর ছোটবেলার বন্ধু লীলার সঙ্গে হঠাত্ই ট্রেনের কামরায় দেখা হয়ে যায়। পুরনো স্মৃতি হাতরে বেড়ায় চারটে চোখ। লীলার চরিত্রে অভিনয় করেছেন অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়। যখন ট্রেনের এক কামরায় অপু ও লীলা স্মৃতিভেলায় ভেসে বেড়াচ্ছে, তখন পাশের কামরায়  ঘুমন্ত কাজলকে নিয়ে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন বুনছে বিমলেন্দু। শেষ পর্যন্ত অজানাকে জানার, নতুন দেশ দেখার অদম্য উত্সাহে অপুর অনন্ত যাত্রা নিশ্চিন্দিপুর থেকেই শুরু হয়। 
অপর্ণার চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিতিপ্রিয়া রায়। গোটা ছবিতে তাঁর মুখে কোনও সংলাপ নেই। তরুণী এই অভিনেত্রী তাঁর অভিব্যাক্তি দিয়ে চরিত্রটি বেশ ভালো ফুটিয়েছেন। কাজলের চরিত্রে আয়ুষ্মান মুখোপাধ্যায়কে আরও একটু গ্রুমিং করলে ভালো হত। শেখানো কবিতার মতো সে যেন সংলাপ বলে গিয়েছে। বিক্রম ঘোষের মিউজিক নিঃসন্দেহে এই ছবিতে অন্য মাত্রা যোগ করেছে। পণ্ডিত রবি শঙ্করকে ট্রিবিউট জানিয়ে তাঁর কন্যা অনুষ্কা শঙ্কর ছবির একটি অংশে সেতার বাজিয়েছেন। প্রসঙ্গত, ছবিটি গোয়া আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে ইন্ডিয়ান প্যানোরামা বিভাগে প্রতিযোগিতায় মনোনীত হয়েছে।