বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
খবরের কাগজের ওপর গড়াতে গড়াতে মেনির নজর পড়ল তার হুলো দাদার ওপর। সে লেজ তুলে বলল, ‘ম্যাও। গুড মর্নিং দাদা।’
হুলো বলল, ‘ম্যাও। গুড মর্নিং।’ বলেই হুলো ধমকের সুরে বলল, ‘এত বেলায় তোর মর্নিং হল? তা ওই খবরের কাগজটা নিয়ে কী করছিস? খবর পড়ছিস, না মাখামাখি করছিস?’
‘না গো দাদা খবরে আমার ইন্টারেস্ট নেই। আজ তো শনিবার, খবরের কাগজে রান্নার পেজে ইলিশ মাছের ছবি দিয়েছে। ইলিশ মাছ তো এ সিজিনে চেখেও দেখলাম না, চোখেও দেখলাম না। তাই একটু দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে খবরের কাগজে ইলিশের ছবির ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম।’
হুলো গম্ভীর মুখে বলল, ‘ছবির ইলিশ, ভালো! কী দিনকাল এল!’
মেনি ওখান থেকে বলল, ‘তোমার সঙ্গে একটা প্রাইভেট টক ছিল দাদা, একটু ওপরে যাব?’
সাত পাড়ায় ঘোরা মেনির স্বভাব। মুখে মাস্কের বালাই নেই। তবে কেউ জামা কাপড় কেচে ডিটারজেন্টের জল ফেললেই মেনি গিয়ে গা মাথা ভিজিয়ে স্যানিটাইজ করে নিচ্ছে। না মেনিকে কাছে আসতে দেওয়া উচিত নয়। হুলো বলল, ‘অত প্রাইভেট টকের কী আছে— যা বলার ওখান থেকে বল।’
মেনি বলল, ‘অত দূর থেকে কী সব কথা বলা যায়?’
হুলো ফোঁস করল, ‘এই হল তোদের জেনারেশনের প্রবলেম— সব কথা ফিসফিস করে বলতে হয়। কেন জোরে বলা যায় না, এত লুকোছাপার কী আছে রে!’
তবু লেজ নাড়তে নাড়তে ওপরে উঠে এল মেনি। বলল, ‘দাদা তুমি কি ব্রেকফাস্ট করেছ?’
‘কেন বলত, আমার ব্রেকফাস্ট নিয়ে তোর এত চিন্তা?’
‘তাহলে তোমায় একটা খবর দিতাম।’
‘কী খবর— ঝেড়ে কাশ।’
‘গণপতি এনক্লেভের থার্ড ফ্লোরের রাজা-রিংকিদের ফ্ল্যাটের সবাই সকালবেলা কালীঘাট গেছে—পুজো দিতে।’
‘তাতে তোর কী?’
‘ওদের ফ্ল্যাটের যে ছেলেটা দুধ দেয়, সে এক প্যাকেট দুধ গ্রিলের ফাঁকে রেখে গেছে। রোজকার যেমন রাখে।’
‘তুই কি সাবড়ে এসেছিস?’
‘না, পারলাম কই— তিন তিনবার অ্যাটেম নিয়েছিলাম, কিন্তু ওই কেয়ারটেকারটা এমন লাঠি ছুঁড়ে মারল, একটুর জন্য বেঁচে গেলাম।’
‘তাহলে আর কী?’
‘দুধটা খেতে পারলাম না।’
‘যা, আবার চেষ্টা কর।’
‘না, ওই কেয়ারটেকারের যেমন লাঠি, তেমন টিপ! ও নির্ঘাত আমাকে ঠ্যাং ভেঙে ল্যাংড়া করে দেবে। দাদা, তুমি বরং যাও। দুধের প্যাকেটটা যদি কোনওভাবে মুখে করে তুলে আনতে পারো—তবে দুর্দান্ত ব্রেকফাস্ট হয়ে যাবে।’
হুলো বলল, ‘না, একটু আগে মুন্নি আমাকে ছখানা বিস্কুট দিয়েছে—। আমার ব্রেকফাস্ট কমপ্লিট।’
মেনি ব্যাজার মুখে বলল, ‘আমি ট্রাই করলাম, পারলাম না। আর তুমিও গেলে না। এতে কিন্তু আমাদের বদনাম কম হল না। আমাদের যা বদনাম হওয়ার তা হবে।’
মেনির কথায় চোখ গোল গোল করল হুলো, ‘চুরি করলাম না, দুধ খেলাম না— তবু বদনাম? সেটা কী করে হবে?’
‘হ্যাঁ তাই। আগের দিন আমি নিজের চোখে দেখেছি— সেদিন গুপ্তাজিরা ঘরে ছিল না। ওদের দুধ রেখে গিয়েছিল গ্রিলের পাশে। কিন্তু ফার্স্ট ফ্লোরের ওই দামড়া বিশু মজুমদারটা এসে দুধের প্যাকেটটা খোঁচা মেরে ফাটিয়ে দিল। সব দুধ ঝরঝর করে পড়ে গেল। তাই দেখে আমি একটু এগিয়েছিলাম। ওই মজুমদারটা নিজেই হইচই বাধিয়ে কেয়ারটেকারকে ডেকে বলল— তুমি কিছুই দেখছ না, দুধের প্যাকেট বেড়াল এসে ফাটিয়ে খেয়ে যাচ্ছে দেখো, দেখো...।’
হুলো বলল, ‘কী মুশকিল— ওই মজুমদারটা দুধের প্যাকেটটা ফুটো করে দুধ ফেলে দিল।’
‘হ্যাঁ, উল্টে বলল, বেড়াল এসে ফাটিয়েছে। তারপর বলল—আগে জল ঢেলে পরিষ্কার কর।’
‘তোকে দুধটুকু খেতেও দিল না! কেমন মানুষ বোঝ!’
‘কেমন মানুষ তুমি বোঝো দাদা। ওই দামড়া বিশু মজুমদার লোকটা খুব বজ্জাত! এক ঢিলে দুই পাখি মারল। গুপ্তাজির সঙ্গে লোকটার একটু মনকষাকষি, তাই ওদের দুধ নষ্ট করে দিল। আর কেয়ারটেকারকেও বকাবকি করে জল ঢেলে পরিষ্কার করাল। ওকেও একটু টাইট দিল।’
কথাটা শুনে হুলো আরও গম্ভীর মুখে বলল, ‘সে আমি আর কী করব, ওরা মানুষ, বড় জাত!’
হুলোদাদার কথা শুনে ফ্যাঁচ করে নাক ঝাড়ল মেনি, বলল, ‘বড় জাত না ছাই—ওরা বজ্জাত!’
মেনির কথায় হুলো গম্ভীর মুখে বলল, ‘না রে ওরা ঈশ্বরের সেরা প্রোডাক্ট।’
মেনি বলল, ‘তাই কী হুলোদা? আমার কিন্তু তা মনে হয় না। আমার মনে হয়— ওরা ওটা বানিয়ে বানিয়ে বলে। মানুষই ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি— আমার কিন্তু কিছু প্রশ্ন আছে—।’
হুলো বলল, ‘বল কী প্রশ্ন?’
মেনি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘প্রথমে নিজেদের গোত্রের জীবদের কথাই বলি। বাঘ আর বিড়াল একই তো হল, না কী বলো দাদা? মানুষ যদি শ্রেষ্ঠ হবে তাহলে ওদের কেউ সাহসিকতা দেখালেই সবাই কেন বলে —ও বাঘের বাচ্চা! কী বলে তো?’
মেনির কথায় হুলো ঘাড় নাড়ে।
মেনি বলে, ‘কোনও মানুষ যদি বেশি জোরে দৌড়ায়, তাহলে তাকে চিতা কিংবা হরিণের সঙ্গে তুলনা করা হয়? হয় কি না বলো?’
এবারও হুলো তার ঘাড় নাড়ায়, ‘ঠিক ঠিক।’
ফিক করে হেসে মেনি বলে, ‘এমনকী বুদ্ধি বেশি হলে শেয়ালের সঙ্গে তুলনা করে। খারাপ মানুষকে সাপের সঙ্গে তুলনা করে। তাহলে ওরা কোথায় সেরা হল? সব কিছুই তো ধার করা!’
হুলো অবাক হয়ে মেনির দিকে তাকিয়ে থাকে। কবে মেনির এত বুদ্ধি হল! বাপ্রে! তাও তো রোজ দুধ খায় না, মানে পায় না, পেলে কী না কী হতো, হয়তো সেজেগুজে কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ, হাতে মোবাইল নিয়ে অফিস যেত। হুলো বেশ সম্ভ্রমের চোখে মেনির দিকে তাকায়।
মেনি বলল, ‘আর বলব হুলোদাদা।’
‘না, না, আর দরকার নেই। তোর পেট খালি, তুই খালি পেটে যদি এত প্রশ্ন করতে পারিস, তাহলে ভরা পেটে— ওরে বাপ রে বাপ!’ হুলো জলের ট্যাঙ্কের ওপর থেবড়ে বসে পড়ল।
মেনি বলল, ‘তুমি বসে পড়লে দাদা!’
এমন সময় ঘন্টে জানলায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল—
হুলো গাল ফুলো/ হুলো রাঙা মুলো
মেনি বলল, ‘নাও তোমার ঘন্টে এসে গেছে। দাদা তুমি বড় মিইয়ে যাচ্ছ, একটু নড়ে বসলে বাঘের সম্মান পেতে। এই গাল ফুলো, কান কুলো, লেজ ঝুলো, রাঙা মুলো— শুনতে হতো না।’
ব্যাজার মুখে হুলো বলল, ‘যা যা তুই এবার যা, খালি পেটে এত বক বক করিস নে। যদি কেয়ার টেকার না থাকে দুধটা সাবাড় করে আয়।’
‘বলছ, দেখি তবে। গুরুজনের কথা আমি অমান্য করি না।’ কথাটা বলে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে মেনি চলে।
হুলো উঠে দাঁড়াল। স্কুলের ড্রেস পরে ঘন্টে জানলায় দাঁড়িয়ে। ঘন্টেদের এখন অনলাইনে ক্লাস। সেই ক্লাসটাও ঘন্টে ঠিক মতো করে না। ল্যাপটপের স্ক্রিনটা ঊর্ধ্বমুখে তুলে দিয়ে— নিজে ক্লাস ছেড়ে জানালায় দাঁড়িয়ে হুলো গাল ফুলো, রাঙা মুলো করছে। আর ইস্কুলের দিদিমণি ক্যামেরার ভেতর দিয়ে ঘরের সিলিং-এ ঘন্টেকে খুঁজছে। হায়! হায়!
হুলো বলল, মিঁয়াও মিঁয়াও ম্যাও। অ্যাই ঘন্টে তোর বাপকে গিয়ে বল— তোকে একটা রিকশ কিনে দিক, সারাদিন টং টং করে ঘণ্টা নাড়িয়ে ঘুরে বেড়াবি।
হুলো ঘন্টের চোখের থেকে একটু সরে এল। নইলে ঘণ্টটা অন লাইনের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে জানালাতেই দাঁড়িয়ে থাকবে।
এমন সময় মুখ চুন করে মেনি ফিরে এল।
‘কী হয়েছে রে মেনি?’
‘কী আবার হবে, যা বলেছি তাই। গিয়ে দেখি জল ঢেলে দুধ ধোয়া হচ্ছে, আমাকে দেখে সব হইহই করে উঠল, আমি নাকি দুধের প্যাকেট দেখলেই ফাটিয়ে দিচ্ছি। ভাগ্যিস ওদের কাছে বন্দুক নেই। থাকলে গুলি করত।’
হুলো বলল, ‘এ তো ডাহা মিথ্যে কথা।’
মুখ গোঁজ করে মেনি খবরের কাগজের ইলিশের ছবির পাশে থেবড়ে বসল। বলল, ‘ওই বিশু মজুমদার এখন নীচে কেয়ারটেকারকে দিয়ে জল ঢেলে ঢেলে পরিষ্কার করাচ্ছে, আর ফ্ল্যাটের সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে— বাজার থেকে ফিরে আসার সময়ই নাকি ও আমাকে দেখেছে। আমি নাকি ওর হাতের ব্যাগেও তাক করেছিলাম। ওর ব্যাগ ভরা ছিল ইলিশ মাছ। যদি আমি একবার ছুঁতাম, ওর দু হাজার টাকার মাছ ফেলে দিতে হতো।’
হুলো লাফিয়ে উঠল, ‘বিশু মজুমদার দু হাজার দিয়ে ইলিশ খাবে! এটা মিথ্যে কথা!’
‘বলছে তো চোদ্দোশো টাকা কিলো মাছ কিনেছে। ওজন নাকি পাক্কা দেড় কিলো। দাম দু হাজার। একশো টাকা কম নিয়েছে। যাও না গিয়ে শুনে এসো, ওজন- দাম- ডিসকাউন্ট, সব বলছে। কিনেছে, কিনেছে, নির্ঘাত পুজোর বোনাস পেয়েছে।’ মেনি ফোঁস ফোঁস করে বলল।
হুলো বলল, ‘আমি বিশ্বাস করি না, ওই দামড়াটা অত টাকা দিয়ে মাছ খাবার লোক নয়।’
‘না গো হুলোদাদা আমি ওর হাতে মাছের প্যাকেট দেখেছি। তখন বাজার থেকে ফিরছিল।’ মেনি বলল, ‘বিশ্বাস করো দাদা আমি যদি বিড়াল না হয়ে বাঘ হতাম তবে এক্ষুনি ওই দামড়া বিশুটার ঘাড় মটকাতাম।’
লাফিয়ে উঠল হুলো, বলল, ‘তুই বোস মেনি আমি ওর রান্নাঘরে একটু উঁকি মেরে আসি। কী মাছ, কত মাছ নিজের চোখে দেখে আসি।’ সত্যি সত্যিই হুলো চলে গেল, মেনি বসে। মেনি কাগজের ছবির ইলিশ মাছটার ওপর একবার নাক ঘষল, একবার জিব বোলাল। মিঁউ মিঁউ করে বলল, ‘ও ছবির ইলিশ— তুমি পদ্মার, না গঙ্গার?’
এমন সময় হুড়মুড় করে ফিরে এল হুলো, ওঁর মুখে একটা কালো প্লাস্টিকের প্যাকেট।
প্যাকেটটা দেখেই মেনির চেনা চেনা লাগল। এটা তো ওই বিশু মজুমদারের হাতের মাছের প্যাকেট। হুলো বলল, ‘বিশুর রান্নাঘর দেখতে গিয়ে দেখি জানলার সামনেই মাছের প্যাকেট— নিয়ে এলাম তুলে।’
মেনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, এক গাল হেসে বলল, ‘বলো কি গো হুলোদা, আজ কী কপাল! ইলিশ মাছ!’
নাক টেনে হুলো বলল, ‘তোর বুদ্ধি সুদ্ধি গেছে রে মেনি।’
‘কেন হুলোদাদা?’
‘তুই বেড়ালদের লজ্জা, গন্ধ পাচ্ছিস— এটা ইলিশ?’
মেনি তড়াক করে লাফিয়ে কালো প্লাস্টিকের প্যাকেটটা খোলে— ‘আরে এ যে তেলাপিয়া!’
হুলো গম্ভীর মুখে বলল, ‘কিনেছে তেলাপিয়া, ডায়লগ দিচ্ছে ইলিশের। মানুষগুলো পারে অহেতুক মিথ্যে কথা বলতে। নে, একপিস তেলাপিয়া দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নে।’
মেনি কালো প্যাকেট থেকে একপিস তেলাপিয়া বের করে সেই খবরের কাগজে ‘ইলিশ মাছের রকমারি’ রান্নার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ব্রেকফাস্ট শেষ করল।
হুলো বলল, ‘তোর হল?’
‘দাদা তুমিও বের করে সক্কাল সক্কাল দু চার পিস খেয়ে নাও।’
‘আমি সাতসকালে মাছ খাই না। তোর হলে বলিস।’
খাওয়া শেষ করে থাবায় মুখ মুছে মেনি বলল, ‘মিঁয়াও। হয়েছে। বলো।’
হুলো বলল, ‘কিছু শুনতে পাচ্ছিস—ওই বিশু নীচে এসে হেব্বি হইচই জুড়েছে। যা, প্রথমে ছাদে উঠে নীচে বিশুর পজিশন দেখে নিবি— তারপর মাছের প্যাকেটটা তাক করে ওর মাথায় ফেলবি? পারবি?’
‘খুব পারব দাদা।’ মেনি গা ঝাড়া দিয়ে রেডি হয়ে দাঁড়াল।
হুলো বলল, ‘এবার ইলিশ না তেলাপিয়া, দুধ না পানি, পরিষ্কার হয়ে যাবে। আর শোন, ওই খবরের কাগজটা ভাঁজ করে প্যাকেটে ঢুকিয়ে নে— আমাদের তরফ থেকে ছবির ইলিশ গিফট!’