একাধিক সূত্রে অর্থপ্রাপ্তি ও ঋণশোধে মানসিক ভাব মুক্তি। নিজ বুদ্ধি ও দক্ষতায় কর্মোন্নতি ও সুনাম। ... বিশদ
—বাহ ব্রেকফাস্টের ফলার বুঝি? আর্য বলল।
—আরে না না। ফেসপ্যাক তৈরি হচ্ছে। ছুটির দিন না। ছেলেকে ওষুধ খাইয়ে কিছুটা চাঙ্গা করলাম। ওদিকে আবার...।
বিনীত থমকে পড়ে শুনছিল। এ কৈফিয়ত জানে তাকেই দেওয়া। শার্টের বোতাম খুলে সোফায় এলিয়েছে সৌর। রিল্যাক্স মুডের মৃদু হাসি দেখে বোঝা যায়, অন্তত আজ সে ‘নো প্রবলেম’-এ। বউ আউটিংয়ে।
সুতীর্থ বিনীতের দিকে চোখ ফেরাল, ‘সারাবছর এদিনটার অপেক্ষায় থাকি, অথচ কার্যকালে ঠিক একটা...।’
বিনীত বলল, ‘প্রবলেম অ্যারাইজ করবেই, এই তো? আসলে আমরা বছরভর এতবেশি মাটিতে পোঁতা থাকি, এতবেশি ম্যানগ্রোভের মতো শেকড় ছড়ানো এদিকে ওদিকে যে, একবার উঠতে হলে দু’চারটে ছিঁড়েখুঁড়েই বেরতে হয়।’
‘রাইট’, সৌর সেটা দোহারের ধুয়োর মতো ধরে নিয়ে বলল, ‘তোকে একটা কনগ্র্যাটস এই দিনটা আয়োজন করার জন্য। আমাদের কবেকার সেই এইটটি এইটের ব্যাচ, কে কোথায় ছিটকে পড়ে কোন রুজিতে মুখ গুঁজেছে। অনেকে পছন্দের চাকরি বাড়ি গাড়ি নারী সব পাওয়ার পরেও কেমন একটা... আই মিন, কেমন একটা...।’
বিনীত জুগিয়ে দিল, ‘হেদিয়ে পড়া। হায় চিল— হায় চিল করে ভিজে মেঘের দুপুরে সোনালি ডানা খুঁজে মরা।’
—অনেকটা অপজিটে তুই একটা পরিসর এনে দিলি এই অ্যারেঞ্জমেন্টটায়। —গতবার বাইরে ছিলাম মিস করেছি। এবার কল পেয়ে দু’বার ভাবিনি।
সত্যকাম সার্ভে পার্ক থেকে এসেছে কিছুক্ষণ আগে। দু’টো চেয়ার টপকে এসে বসে পড়ে বলল, ‘শুনলাম দেবতোষ সেবার খুব আপসেট হয়ে পড়েছিল ফ্যামিলি ম্যাটার্স নিয়ে। তোরা নাকি রুমাল সাপ্লাই করেছিলি।’
নীলাংশু ওয়ার্নিং দিল, ‘চুপ চুপ দেবতোষ এসে পড়বে।’
ফিরোজ কফির মগ নামিয়ে বলল, ‘ওর আসতে অনেক দেরি।’
সান-ডের স্পেশাল ব্যাচটা স্থগিত দিয়ে অন্বেষ এসেছে বৈদ্যবাটি থেকে। একদিনের উত্তেজনায় সুগার প্রেশারে মাত্রা চড়ে গিয়ে কালকের স্কুলিং-টা না অফ যায়।
কনককান্তি সেন একপ্লেট লুচি আলুরদম নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। একটু আগে সল্টলেক থেকে এসেছে। একটা সার্জারি কেসের ডেট পিছিয়ে সময় বের করতে হয়েছে। এতবড় হলঘরের বিস্তর চেয়ারের একটাতে বসাই যায়। কিন্তু একটু কাছাকাছি ছাড়া বন্ধুত্বের উষ্ণতা আসে না।
শাক্যই ওকে ডেকে নিল দরাজ জানলার ধারে, ‘এদিকে আয় কনক। গতবার কি এসেছিলি?’
—বোধহয় না।
—কেমন চলছে প্র্যাকটিস?
—আর প্র্যাকটিস।
দু’খানা লুচি ফেলে রেখে ঢেকুর তুলে কনক বলল, ‘নিউজ দেখছিস না। ভুয়োর ভিড়ে পড়শি থেকে শ্বশুরবাড়ি সবাই বাঁকা চোখে দেখছে।’
শাক্য বলল, ‘এই মওকায় দে কষে ফিজ বাড়িয়ে। সেন্ট-পার্সেন্ট খাঁটির দাম তো আলাদা হবেই।’
—বাই দা বাই, তুই কেমন আছিস বল।
—ভেরি ফাইন।
সিগারেট ধরিয়ে অফার করল কনক। বলল, ‘সেটাই আশা করব, কিন্তু কী জানিস, আজকাল মানুষ খারাপ থাকলেও এই কথাটাই বলে, কেন রে?’
শাক্য বলল, ‘বোধহয় মন্দের অনেক এক্সপ্লানেশন লাগে।’
কনক ধোঁয়া ছাড়ল, ‘তাই? কিন্তু রিলিজড হতেও তো মানুষ লাগে। এই যেমন আজকের অ্যাসেম্বলি অব ফ্রেন্ডস। আমরা এটাকে সেভাবেই অ্যাকসেপ্ট করতে পারি। বল। ফ্রেন্ড এক অর্থে আমাদের মিরর নয় কী।’
‘অবশ্যই।’ শাক্য নজর করল বন্ধুদের মশগুল জটলাটা একটু ফাঁকা ফাঁকা। সামনে ছড়ানো বাগানে বেরিয়ে গিয়েছে অনেকেই। হঠাৎ-ই কনকের দিকে চোখ ফিরিয়ে শাক্য বলল, ‘মলির কী খবর রে?’ বলেই ভাবল ঠিক হল কি না। কেন না, কনকও দ্রুত একবার ‘কে মলি?’ বলেই চুপ মেরে গিয়েছে। তবুও মলি প্রসঙ্গ সামনে এল। ততক্ষণে কফি এসেছে। আরামে চুমুক দিচ্ছে কনক।
শাক্য বলল, ‘মলিকে একদিন দেখলাম, বাইপাসের ধারে ক্যাব থেকে নামছে। সঙ্গে মেয়ে। এই তোর মেয়ের নাম তো তিথি, তাই না?’
—আমার কোনও মেয়ে নেই। ছেলের নাম অর্ঘ্য।
শাক্য কপাল কুঁচকে শুধরে নিল, ‘ও ও।’ কফির মগে আলতো চুমুক দিয়ে বলল, ‘একটা ফ্ল্যাটের কাছাকাছি গাড়িটাকে সাইড নিতে দেখে আমি বাইক থামালাম। হঠাৎ তো। খুব অবাক হল। তোর কথা জিজ্ঞাসা করলাম। কিছু বলল না। হাসল শুধু। হাসিটা সেই একরকম আছে। তুই বলতিস মোনালিসার হাসি।’
কনক এতক্ষণে বলল, ‘তুই মালবিকার কথা বলছিস। আমি ভাবলাম, উত্তরপাড়ার মলির কথা। বি কে স্যারের মেয়ে।’
শাক্য বলল, ‘ওই মলি আবার মনে রাখার মতো কবে হল। ব্যাচমেট হিসেবে যতটুকু।’
কথা কেড়ে নিয়ে হাসছে কনক, ‘ওইটুকুতেই দু’জনের মধ্যে তোলপাড় তুলেছিল চাঁদু। ভুলে গেলে? আমি জানতাম, মলি তোকে প্রেফার করে তাই ব্যাচ ছেড়ে দিয়েছিলাম।’
—আসলে তুমি তখন সোমকের বোন অঙ্কিতার পিছু নিয়েছ।
—ধুসস ওর তো ছিল অংশুমান। আমার কাছে ম্যাথ-টার হেলপ নিত।
শাক্য বলল, ‘ছাড় তো। কবেকার কথা। গোঁফে তখনও ব্লেড পড়েনি। সে তুলনায় মালবিকা অনেকটা অনতি অতীত।’
ঘুরেফিরে আবারও মালবিকা। কনক আর এড়াতে না পেরে বলল, ‘তো।’
শাক্য ততক্ষণে নিজের মনেই শুরু করেছে, সুবীরদা তখন লিলুয়ার ওয়ার্কশপে। কী দাপট ইউনিয়ন লিডার হিসেবে। মালবিকা তখন বউদি। আশ্চর্যরকম চুপচাপ থাকত মলি। কী সহিষ্ণুতায় যে সুবীরদার রুগ্ন ফ্যামিলিটাকে টানত। মলি একটা প্রাইভেট কনসার্নে চাকরিও করত। কিন্তু সবদিক কভার হতো কি না কে জানে। তারপর তো কলকাতায় রাসবিহারীর দিকে চলে আসতে হল সবশুদ্ধ। সুবীরদা অসুস্থ হয়ে পড়ল। সে আর এক পর্ব।
কনক বলল, ‘হয়তো জানিস না যেটা, সুবীর চৌধুরীর অসুখে আমাকে যে ট্রিটমেন্ট করতে হয়েছিল, তার পুরো চার্জটা চেপেছিল আমারই ঘাড়ে। তুই তখন তিস্তার সঙ্গে সেটেলড হচ্ছিস। খেয়াল রাখিসনি।’
মুখের দিকে চেয়ে আছে শাক্য। তার হাতেও কাটগ্লাস। ব্যবস্থাপনায় কোনও ফাঁক রাখেনি বিনীত।
কনক বলল, ‘বলতে পারিস ভুলটা আমার। না হলে মালবিকার আশ্চর্য রূপকে যথেষ্ট না ভেবে, ওর অদ্ভুত স্বামী নিষ্ঠা আমাকে মুগ্ধ করবে কেন। আমার মনে হয়েছিল, এ এক দুর্লভ চিত্তের নারী। যে পায় সে ভাগ্যবান। তাই যখন ও আমার পা ধরে সমস্ত চিকিৎসার খরচ মিটিয়ে দেবার জন্য সময় চাইল, আমি সব অর্থেই মলিকে মাথায় তুলে নিয়ে মকুব করলাম।’
সপ্রশ্ন সরু চোখে তাকিয়ে রইল শাক্য। ততক্ষণে বন্ধুদের দলটা অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়েছে।
শাক্য গলা নামিয়ে বলল, ‘চুপ কর কনক।’
থামল না কনক বলল, ‘আজ আমার ছেলেটা বড় হচ্ছে দ্বিতীয় বউয়ের করুণায়। মালবিকা নির্দ্ধিধায় সুবীরের মেয়েকে নিয়ে সরে পড়ল।’
হ্যাললো-ও-ও, বলে এগিয়ে এল দীপাঞ্জন। এসেই দুম করে গান জুড়ল— ‘আমরা একঝাঁক বন্ধু আজ তোয়াক্কাহীন তরুণতুর্কি...’
অনুপম বলল, ‘তোর তরুণতুর্কি কথাটায় এত ইম্প্রেসড হচ্ছি, বিয়াল্লিশের ভুঁড়িটা বাগড়া না দিলে একটু নাচতাম। সেই টু থাউজ্যান্ড ফাইভে একবার অঞ্জনার ছোট বউদি বেবির কোমর ধরে নাচতে গিয়ে সে কি নাস্তানাবুদ। রাতে বিছানায় বউ লাথি কষিয়ে বলে বেরিয়ে যাও লম্পট কোথাকার।’
সত্যকাম ঝিমোচ্ছিল। তুরন্ত মাথা তুলে বলল, ‘দেখছিস, এখানেও স্বস্তি নেই। মনে হ’ল, কে যেন ঠেলা দিয়ে বলছে, এটিএম থেকে টাকা তুলে আনার কথা ছিল যে।’
দেবদত্ত পাশ থেকে চুক চুক করে বলল, ‘হ্যালুসিনেশন... বেচারা!’
বেহালা থেকে সৌম্য এসেছে নিজেই ড্রাইভ করে। বলল, ‘এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। সুযোগ পেয়ে ম্যাডামদের এত খাটো করার কোনও মানেই হয় না।’ চার্টার্ড অ্যাকাউন্টান্ট প্রলয় সরখেল-এর কাছে সময়ের হিসেব টাকার মতোই জরুরি। অযথা টাইম পাস মানে লাঞ্চ টাইম গড়িয়ে দেওয়া। যা আদৌ ঠিক নয়।
কিন্তু খাবার। খাবার কই। তিনটে বেজে গেল। যারা সমবেত হয়ে সময় চেয়েছিল তারাই এখন সরব খিদের টানে।
অ্যাই বিনীত... কোথায় রে তুই? খাবার কই?
বিনীত উদ্যোক্তা হলেও এই ভোগ ব্যবস্থার বাইরে সে তো নয়। আবডাল খুঁজে বসেছে অন্যের নজর এড়াতে। নিজের নজরদারিটা অবশ্য ঠিকই আছে। একটু আগে তার সবাইকে নিয়ে বেদম নাচতে ইচ্ছা করছিল। এখন পা টলে যাবার ভয়।
আহ কত কিসিমের বন্ধু তার। কত দিকের যে পরিযায়ী। এই সম্মেলনের জন্য তাকে কী না করতে হয়। একদিনের একটা পরিসর পেতে ক’টা দরজায় যে ধর্না দেওয়া! এ বছরের চন্দননগরের পুরনো গঙ্গা-ফেসিং বাগিচাবাড়ি তো অন্যবার পূর্ত বিভাগের নির্মীয়মাণ বিল্ডিং। নানা ধরনের নানা জীবিকাসূত্রে ছিটকে-পড়া বন্ধুদের একত্র করা। কোন প্রান্ত থেকে কে না এসেছে। বৈদ্যবাটির অন্বেষ তো গড়িয়ার অনুপম। দুর্গাপুর-রৌরকেল্লা-আসানসোল। ভাইজাগ থেকে এবারে ফলকনামা এক্সপ্রেসে শ্রীবাস্তবও হাজির। উঠেছে গল্ফগ্রিনে বোনের বাড়িতে। ফিরে যাবে কাল ইস্টকোস্ট এক্সপ্রেসে। বিভিন্ন মাল্টিপ্লেক্স দেখার বিস্তর দৌড়ঝাঁপের চাকরি ওর। পরিবারে সময় দিতে পারে না। চূড়ান্ত মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে স্ত্রী তার কন্যা সহ সল্টলেক পিতৃভূমে।
—তুই কী এই ফাঁকে রাগ ভাঙতে এলি?
শ্রীবাস্তব মনমরা গলায় বিনীতকে বলেই ফেলল, ‘সিচ্যুয়েশনটা বোধহয় সে জায়গায় নেই। তবু চেষ্টা করব।’
‘ডোন্ট ওরি। বন্ধুত্বের মধ্যে দিনটা এনজয় কর। হয়তো সলিউশনের সূত্রটা পেয়ে যাবি।’
বিনীত যেটুকু বুঝেছে— জনারণ্যেও মানুষ কিন্তু একা। মানুষ এক একটা নির্জন খণ্ডদ্বীপ। মূল-ছুট মন কোনও একসময়ে নিজের শিকড়টা ছুঁতে চায়।
সেই চরাচরের সহচররা যার একটা সোপান। আর বিনীত নিজে। হায়। এসব নিয়েই তো বেলা গেল। দিন কেটে গেল বিয়ে না করা মণিকাকে নিয়ে। কেন? সেসব ভাবতে গেলে বাস্তবটা এমন দৈত্য হয়ে ওঠে যে, ভালোবাসা ভালোবাসা আলেয়াটা যায় হারিয়ে। নাহ বিনীত সেটা চায় না।
থাক না মণিকা নিজের মতো নিজের এনজিও নিয়ে। যা-ই করুক ছিটকে তো যায়নি এখনও বিনীত নামের কেন্দ্র-বিন্দুটি থেকে। তাই বা কম কী। চমকে তাকিয়ে দেখল, তেড়ে এসে ধেবড়ে বসেছে নীলাংশু।
—অ্যাই বিনীত, তুই ব্যাটা এখানে। খুঁজে মরছি, খাবার কই?
মেজাজ বিগড়ে দেবার মতো কথা। সুষ্ঠু একটা ব্যবস্থার পরেও ছিদ্রান্বেষণ এদের স্বভাব। এটা কী বিনীতের মাতৃদায়। বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমি কি কিচেন পকেটে নিয়ে ঘুরছি। মনোহরদাকে একবার নক করলেই তো হয়।’
—তুই থাকতে?
—তো কী। সবার ব্যাপার এটা। প্রত্যেকের শেয়ার আছে। মার্কেটিংয়ে আমি একা নেই। কিচেন তদ্বিরে মনোহরদার সঙ্গে সৌরভ, দেবু... ওদেরই বলগে যা।
‘ওহ তোরা এখনও সেই এইটটি এইট-এর ব্যাচে পড়ে আছিস। কী ম্যানেজ হচ্ছে না, আমাকে বল।’ দক্ষিণ কলকাতার এক থ্রি-স্টার হোটেলের জিএম এখন কৌস্তুভ। এই চাকরির অন্যতম যে শর্ত ফুড অ্যান্ড বেভারেজ-এর ম্যানেজমেন্ট— বিনীত তাকে সেটা প্রয়োগের সুযোগ না দিয়ে বলল, ‘ম্যানেজ? কতগুলো কাপডিশ ভেঙে আর ক’খানা ঘর ঝাঁট দিয়ে ম্যানেজার হয়েছিস বাপ?’
কৌস্তুভ সামান্য আহত গলায় বলল, ‘তোর মতো আরামের সরকারি চাকরি আর কপালে জুটল কই। যাই হোক যদি বলিস, এখনই এক ব্যাচ লাঞ্চের ব্যবস্থা একাই সামলে দিতে পারি।’
হাত নাড়িয়ে থামিয়ে দিল বিনীত। বলল, ‘হয়েছে। রোজই তো হোটেলে হেঁশেল সামলাস। একদিন না হয়...।’
জানলার ওধার থেকে কে কী বলল, আর বিনীত উঠে দাঁড়াল কৌস্তুভকে ধরেই, বলল, ‘চলে যা কৌস্তুভ পরে স্পেস পাবি না।’
কৌস্তুভ বলল, ‘তুই?’
বিনীত তাকে জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে দিল।
না, ডাইনিং এখনও ভরেনি। ততটা এটিকেট মেনটেন-এর ব্যাপারটা আজ নেই বলেই বোধহয়। কেউ বসেছে। কেউ জুড়েছে গান। কারও বা শেষই হয় না। যেমন শাক্য আর কনককান্তির। সেই যে বসেছে মুখোমুখি, চলছেই...
‘সুবীরদা মারা গেলে, মলি তো অনিচ্ছায় তোর কাছে আসেনি।’
শাক্যর জবাবে কনক বলল, ‘মলি এল। কিন্তু আমি যতটা মলিকে চেয়েছিলাম, সেই চাওয়া কেন যেন বাউন্স করল। আমার আর্থিক দিক, সামাজিক মর্যাদা কিছুই নিজের ভাবতে পারল না মলি। এমনকী আমাদের সন্তান অর্ঘ্যকেও। অথচ সুবীরের মেয়েকে আমি আমার টাইটেলে অ্যাডপ্ট করে নিতে দু’বার ভাবিনি।’
শাক্য কিছুটা অবাক হয়ে বলল, ‘স্ট্রেঞ্জ। তোর কী মনে হয়?’
মাথা নাড়ল কনক, ‘জানি না। বোধহয় ওর ধারণা এসব আমার দয়া, করুণা বা ফর শো। তুচ্ছ কারণে সিনক্রিয়েট করে চলে গেল একদিন। যে মেয়ে একদিন স্বামীর চিকিৎসার ঋণ মেটাতে আমার পা ধরতে এসেছিল, আজ আমিই তার পা ধরলাম একটু সান্নিধ্যের জন্য... একটু ভালোবাসার জন্য। কিন্তু...।’
কনক যেন কতকালের সঞ্চিত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘মালবিকা ডিভোর্স নিল। ছেলের দাবি করলাম। আপত্তি করল না।’
শাক্য নীরবে মাথা নামিয়ে রাখল কিছুক্ষণ। কাটল কয়েক মিনিট। বলল,
‘চল খেয়ে নিই।’
কৌস্তুভ কখন এসে দু’জনের পিঠে হাত রেখেছে। কনক চমকে ওঠে, ‘ও-ও-তুই।’
—চল খেয়ে নিই একসঙ্গে। প্রায় চারটে বাজে। এরপর যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হবে। আমার তো নাইট আছে। দুটো ব্যাঙ্কোয়েট প্যাকড আপ।
শাক্য গা-ঝাড়া দিয়ে উঠতেই চোখ বড় হল তার, ‘ও কী রে। ওখানে গুলমোহর গাছের নীচে ঋষি-অন্বেষ না? কী করছে ওরা। ঠিক দেখছি তো। অহি-নকুল জড়াজড়ি করে কাঁদছে নাকি।’
বন্ধুমহলে কথাটা চাউর আছে যে, দীর্ঘস্থায়ী মনোমালিন্যে বাক্যালাপহীন তারা। একসময়ের হরিহর আত্মায় যে চোট, সেটা যৌথ ব্যবসা-ঘটিত।
সেই মুড়নো নটেগাছের জুটি এখন গুলমোহর গাছের নীচে।
এতদিনের গেট টুগেদারে যা ছিল সযত্ন এড়ানো, হঠাৎ আজ মুখোমুখি পড়ে গিয়ে মুখ ফস্কে হাই হ্যালো বেরিয়ে এসেছে। নাকি গুলমোহরের মায়াবী ছায়ায় আর ধেয়ে আসা গঙ্গাবাতাসের আবহে থিতিয়ে গিয়েছে তিক্ত স্মৃতিরা। দু’জনেই থমকে, থতমত আবেগে পরস্পরকে জড়িয়ে না ধরে শান্তি পায়নি। — আসলে কি, হাইসুগার তো, চোখে ঠিকঠাক দেখি না... না’হলে...।
কথা থামিয়ে ঋষি বলে, ‘সেই সঙ্গে অমন ঢেউ খেলানো চুলের মাথাটা ব্রহ্মডাঙার মাঠ করে ছেড়েছিস।’
অন্বেষের চকচকে টাকের পাশে ঋষির কুচকুচে কালো চুল ওড়ে বাতাসে। অন্বেষ বলে, আর তোর যে ভাই এখন কালিমাখা কাশের বন।
দু’জনেই উচ্চকিত হাসিতে ফেটে পড়ে।
—তোর মনে আছে ঋষি, জগদ্ধাত্রীপুজোর সেই ফানুস ওড়ানো রাতটা?
—নেই আবার। ছাদে জ্যোৎস্না ছিল সেদিন। কিন্তু চাঁদের নয়। কিরে ঠিক কি না।
স্মৃতি থেকে তিক্ত কষা কটু দিনগুলি বাছতে বাছতে আপাত উষ্ণতাটুকুই খুঁটতে ব্যস্ত দু’জনেই। ঋষি বলল, মালাটা জ্যোৎস্না না দিল তোকে— না আমাকে।
—কী ঘোরেই না কেটেছিল দিনগুলো। এত তাড়াতাড়ি এতদূর চলে এলাম।... হায় সময়...।
ঋষি দু’হাতের মুদ্রায় বোঝাল, সময়কে যদি এইভাবে গামছায় গিট-মারা যেত। তাই না অন্বেষ?
তাহলে তা আর এ দৃশ্যটি তৈরি হতো না। যা দেখতে উৎসুক হয়েছে অনেকগুল চোখ। শাক্যর মতো যখন এমন ভাবনার সঙ্গে অনেকেই দৃশ্যটি দেখতে ব্যস্ত, কৌস্তভ সকলের মধ্যে এসে গলা নামিয়ে বলল, না না তোরা যা ভাবছিস— সবটাই অ্যালকোহলিক নয়।