কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। উকিল, মৃৎশিল্পীদের শুভ। সংক্রমণ থেকে শারীরিক অসুস্থতা হতে পারে। আর্থিক ... বিশদ
সহজ আর বর্ণিনী যখন এল তখন ক্যাপ্টেন নেই। সহজের কাছে ফোন এসেছিল সকালে। ফোন করেছিল বঁড়শি— ‘এখন একবার আসতে পারবে, আমার খুব দরকার।’
‘এখনই।’
‘হ্যাঁ, এখন উনি বাড়ি নেই, তাই ফোন করলাম। তোমার কোনও ভয় নেই। জান থাকতে আমি তোমাকে বিপদে ফেলব না।’
সহজ হাসল। ‘ধুর বোকা! আমি তোমাকে ভয় পাব কেন? ঠিক আছে দেখছি।’
বর্ণিনী বলল, ‘আমি কি তোর সঙ্গে যাব?’
‘খুব দরকার বলছে। আমার মনে হয় তুই গেলে ভালো হতো।’
সহজ আর বর্ণিনী এসে দরজার কড়া নাড়ার আগেই দরজা খুলে দিল বঁড়শি। থমথমে মুখ। বলল, ‘ভেতরে এসো।’
‘উনি কখন বেরিয়েছেন?’
‘সকালেই বেরিয়ে গেলেন, কাল রাতেই বলেছিলেন, তারাপীঠ যাবেন।’
‘তোমাকে যেতে বলেনি?’
‘উনি জানেন, আমি যাব না, উনি বললেও যাব না। আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলি না। ওঁর কথায় বিষ। আমি তোমাকে ডেকেছিলাম তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।’
সহজ বলল, ‘তুমি নিশ্চিন্তে বলো। বনি আমার খুব ভালো বন্ধু। ওর সঙ্গে তোমার এখুনি আলাপ হল, কিন্তু মনে রেখো— বিপদে পড়লে বনে জলে জঙ্গলে সকলে ওরই খোঁজ করে। ও আমাদের চেনা অচেনা সবার দায় কানে শুনলেই কাঁধ পেতে নেয়।’
বর্ণিনী শান্ত গলায় বলল, ‘বাজে বকছিস কেন? বঁড়শি আমি থাকলে তোমার যদি অসুবিধে হয়, আমি বাইরে রকে বসে দুটো সিগারেট ফুঁকে আসতে পারি।’
বঁড়শি একটু থম মেরে বর্ণিনীর দিকে তাকিয়ে থাকল। বলল, ‘না, তোমাকে বিশ্বাস করতে আমার মন চাইছে। কত আর ঠকব, বিশ্বাস ছাড়া আমার আর কী আছে?’
বর্ণিনী নিজের বুকে হাত ঠেকিয়ে বলল, ‘তুমি আমাকে যে রেসপেক্টটা করলে, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তবু বলছি, তোমার যদি সামান্য দ্বিধা থাকে আমি বাইরে যেতে পারি। আসলে, আমি আগেই আসতে চেয়েছিলাম। আর এখন সহজের মনে হয়েছিল আমি এলে ভালো হয়, তাই এলাম।’
‘তুমি যার জন্য আসতে চেয়েছ সে তো আজ নেই।’ বঁড়শি বেশ ভেঙে ভেঙে কথাটা বলল।
‘আমি আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি না। আমি তোমার জন্য আসতে চেয়েছিলাম।’
‘আমার জন্য?’ ভ্রু কোঁচকাল বঁড়শি। ‘আমার জন্য কেন? আমি তো কাউকে কিছু বলিনি! সহজ কি তোমাকে কিছু বলেছে?’
‘না, সহজ তেমন কিছু বলেনি। ও যেটুকু তোমাকে দেখেছে হয়তো সেটুকুই আমাকে বলেছে, কিন্তু কেন জানি না, আমার মনে হয়েছে, তুমি খুব বিপদে আছ।’
বঁড়শি একটু চুপ করে থাকে।
সহজ বলল, ‘আমি তোমার কথা কতখানি বলেছি জানি না, হয়তো সবটাই বলেছি। আবার হয়তো সেভাবে কিছুই বলিনি।’
‘আমার মন বলছিল তুমি বিপদে আছ। কী আশ্চর্য তোমার ফোন আমার ইনটিউশনকে মিলিয়ে দিল।’
বঁড়শি বলল, ‘তুমি নিশ্চয়ই হাত গুনতে জানো না, তবু বলব, আমি খুব বিপদে পড়েছি।’ সবাই চুপ করে আছে। বঁড়শি বলল, ‘তোমরা একটু বসো, আমি চা করে আনি।’ বঁড়শি চলে গেল। ঝাড়া মেরে চেয়ার ছেড়ে উঠল বর্ণিনী। ঘরের ভেতর হাঁটতে শুরু করল। বলল, ‘অদ্ভুত না জায়গাটা! ঠিক ঘর নয়, মনে হয় গোডাউন। একসঙ্গে চল্লিশ পঞ্চাশজন লোক আরামে বসতে পারে। এখানে পুজোআচ্চা হোমযজ্ঞ হয়। ওপর দিকটা দেখ— কালি পড়ে আছে।’ বর্ণিনী মাথার ওপর তাকিয়ে দেখাল। সহজ তাকাল, সে আগে কখনও ঘরের ওপর দিকটা লক্ষ করেনি। ‘এটা যজ্ঞের কালি। ওই ইটগুলো দিয়ে নির্ঘাত এখানে যজ্ঞের বেদী বানানো হয়। ওই যে বালিও রয়েছে।’ কথাটা বলে বর্ণিনী একটু থামল, সহজ দেখল, ওর নজর বালির ওপর রাখা করোটির দিকে।
ঠিক তখনই চার কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকল বঁড়শি। এসে ওদের দু’জনকে চা এগিয়ে দিল। সঙ্গে বিস্কুটের কৌটো। কৌটো খুলে বর্ণিনী নিজে বিস্কুট নিল, সহজ আর বঁড়শির দিকেও এগিয়ে দিল। সহজ নিল না। বর্ণিনী শব্দ করে চায়ের কাপে চুমুক দিল। বলল, ‘একটা সিগারেট ধরাব? তোমার অসুবিধা হবে?’
‘আশ্রমে আমার চারপাশে সবাই গাঁজা খেত, গাঁজার ধোঁয়ায় ওপর দিকে মেঘ হয়ে যেত, তাতেও আমার অসুবিধে হতো না, এ তো সিগারেট!’
বঁড়শির কথা শেষ হওয়ার আগেই বর্ণিনী সিগারেট বের করে ধরিয়ে ফেলল। বঁড়শি বলল, ‘আগে এখানে খুব হোমযজ্ঞ হতো, ওটা তার কালি। ওটাও কালি মেখে ভূত হয়ে আছে।’ বঁড়শি হাত তুলে করোটিটা দেখাল। যা সহজ এককথায় বুঝলেও বর্ণিনী বোঝেনি নির্ঘাত। ‘এখন হোমযজ্ঞ হয় না, আমি আসার পর বছরে শুধু দু’তিনটে করে কালী পুজো হয়।’
বর্ণিনী চা আর সিগারেটে একসঙ্গে মগ্ন হয়ে বলল, ‘এত বার? এরা কোন কালী?’
‘কালী পুজো রোজ করা যায়। কালী পুজোর দিন শ্যামাকালী পুজো হয়। এছাড়া রটন্তিকালী আছে, রক্ষেকালী আছে, ভাদ্রকালী, ফলহারিণী কালী আছে।’
বর্ণিনী বিস্মিত গলায় বলল, ‘ও!’ কিন্তু সেইসঙ্গে তার চোখ চলে গিয়েছে থালায় রাখা আর এক কাপ চায়ের দিকে। ও ভুল করে চার কাপ চা বানিয়েছে। সে বলল, ‘তোমার এক কাপ চা তো নষ্ট হল। তিনজনে একটু একটু নিয়ে নিই।’
‘না, না!’ বঁড়শি আঁতকে উঠল, ‘এই কাপের চা-টা ওর। কিন্তু আমি ওকে দেব না।’ বঁড়শি মুখের ইঙ্গিতে করোটির দিকে ইশারা করেছে, কিন্তু বর্ণিনী সেটা বুঝতে পারেনি। সে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘কার?’
‘ওই যে ওটা আছে আমার হাড় জ্বালাতে। ওই চায়ের কাপটা ওর।’ বঁড়শি এবার সোজাসুজি আঙুল তুলে করোটিটা দেখাল। কিন্তু বঁড়শির কথা ঠিকমতো হজম হল না বর্ণিনীর। সে একটু থমকে থেকে বলল, ‘ওর মানে! তুমি কার কথা বলছ?’
‘পিশাচ! পিশাচ!’ বঁড়শি চাপা গলায় বলল।
সহজ এবার বর্ণিনীকে করোটিটা দেখাল, বলল, ‘এই হল পিশাচ! বঁড়শির সঙ্গে এই পিশাচেরই বিয়ে হয়েছে।’
‘ও মাই গড!’ বর্ণিনীর হাতের চায়ের কাপটা কেঁপে উঠল।
সহজ বলল, ‘তুমি কেন ডেকেছ?’
বঁড়শির মাথা নিচু, চুপ করে থাকে। খুব আস্তে বলে, ‘আমি কিছু কথা বলার জন্য ডেকেছি— জানি না আমি ভুল করছি কি না। কিন্তু কথাগুলো আমাকে বলতেই হবে। কিছু কথা আমি আগেই জানতাম, শুনেছিলাম আমার মায়ের কাছ থেকে। তখন জানতাম না মানুষটা কে। পরশু জানলাম— তোমার ক্যাপ্টেন সেই মানুষ। তার মুখ থেকেই এবার আমি সেই কথাগুলোই শুনলাম পরশু। কাল সারাদিন ভেবেছি। তারপর একটার পর একটা মিলিয়েছি।’
‘কী কথা?’ সহজ বলল।
‘আমি মায়ের কাছে শুনেছিলাম। আমার বাবা একজন মহিলাকে চিনত, যে অনেকবার আমার বাবার গুরুদেবের কাছে এসেছিল। তার ছেলেটা ছিল চিররুগ্ন। ছেলেটার মাথাটা শরীরের থেকে বড়, কথা বলতে পারত না, হাঁটতে চলতেও পারত না। তাকে নিয়ে তার মা নানা ঠাকুরের দোর ধরত। নানা সাধু সন্ন্যাসীর কাছে যেত, যেমন আমার বাবার গুরুদেবের কাছেও এসেছিল। আমার বাবার গুরুদেব সেই ছেলেটাকে ভালো করতে পারেনি। তবু মহিলাটি আসত। এসে কান্নাকাটি করত। আমার বাবার তখন খুবই অল্প বয়স। গুরুর আশ্রমে থাকত।
এই সময়ে শ্মশানে এক সাধু আসে। সে নাকি পিশাচসিদ্ধ। খুব ভয়ঙ্কর প্রকৃতির তান্ত্রিক। আমার বাবা দু-চারদিন তার সেবাও করে এসেছে। ওই পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিকের কাছে বাবা গিয়েছে শুনে ওই আশ্রমের গুরুদেব বাবাকে খুব বকে। তিনদিন উপবাস করিয়ে রাখে। সে সব ভিন্ন কথা।
কিন্তু একদিন ওই মহিলা যখন আশ্রমে কান্নাকাটি করছিল, আমার বাবা মহিলাটিকে সেই শ্মশানের পিশাচসিদ্ধ সাধুর কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। বাবা শুনেছিল, ওই মহিলার স্বামী ভালো চাকরি করত। বাইরে থাকত। মা-ই বাচ্চাকে নিয়ে নানা জায়গায় ঘুরত। আমার বাবার কথামতো মহিলাটি সেই শ্মশানে যায়। পিশাচসিদ্ধ সাধুর পায়ে গিয়ে পড়ে। তাকে সাধু বলে— অমাবস্যার রাতে বাচ্চাকে নিয়ে শ্মশানে আসতে। মহিলাটি অমাবস্যার রাতে বাচ্চা নিয়ে শ্মশানে যায়। তারপর আর তাদের পাওয়া যায় না। কেউ বলে— সেই পিশাচসিদ্ধ সাধু নাকি সে রাতে শ্মশানে দু’জনকে বলি দিয়ে চলে যায়। কেউ বলে, ছেলেকে বলি দিয়েছিল। মা গিয়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছিল। আবার কেউ বলে, মাকে বলি দিয়ে সাধু ছেলেটাকে নিয়ে চলে যায়। কেন না তার কিছুদিন পরে গলাকাটা এক মহিলার লাশ পাওয়া গিয়েছিল কাশেমের চরে।
আমার বাবা যে, ওই মহিলাকে বাচ্চা নিয়ে শ্মশানে পিশাচসিদ্ধ সাধুর কাছে যেতে বলেছিল, এটা আশ্রমের কেউ কেউ জানত। মহিলার গ্রামের লোকজনও জানত। তারা এসে আশ্রমে হুজ্জতি করে। তারা বাবাকে মেরেই ফেলত। গুরুদেব বাবাকে বাঁচায়, কিন্তু বাবাকে অভিশাপ দেয়— তোর মেয়ের বিয়ে হবে পিশাচের সঙ্গে। বাবা সে রাতেই আশ্রম ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরে নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে এক সর্পতান্ত্রিকের সঙ্গে বাবার দেখা হয়। বাবা তার শিষ্য হয়।
এসব কথাগুলো আমার মা শুনেছিল বাবার কাছ থেকে। মায়ের কাছ থেকে আমি শুনি।’
এতখানি কথা বলে বঁড়শি চুপ করে। শ্বাস নেয়।
সহজ বলে, ‘তুমি এক মহিলার মৃত্যু, এক পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিকের কথা বললে। এর সঙ্গে তোমার বা ক্যাপ্টেনের সম্পর্ক কী?’
‘ওই পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক কি তোমাদের ক্যাপ্টেন বা পিশাচ সাধু?’ বর্ণিনী সপাটে জিজ্ঞেস করল।
বঁড়শি মাথা নাড়ে, ‘না।’
‘তবে?’
‘ওই মহিলার স্বামী হল তোমাদের ক্যাপ্টেন বা পিশাচসাধু। উনি বাচ্চাটার বাপ। পরশুদিন আমি সেটা জেনেছি। তার আগে যোগীন বাবার আশ্রমে শুনেছিলাম, ওঁর বউ আর ছেলের শোকে মানুষটা সাধু হয়েছেন। পরশু জানলাম— কী হয়েছিল।’
‘স্যাড!’ বর্ণিনী বলল। ‘ইশ, মানুষটার জন্য খারাপ লাগছে।’
সহজ বলল, ‘তোমার বাবাকে তাঁর প্রথম গুরুদেব অভিশাপ দিয়েছিল— তোর মেয়ের বিয়ে হবে পিশাচের সঙ্গে। তাই তোমার সঙ্গে ক্যাপ্টেন যখন ওই মড়ার মাথার খুলিকে পিশাচ সাজিয়ে বিয়ের আয়োজন করে, তুমি আর আপত্তি করনি, তাই তো?’
বঁড়শি চুপ করে থাকে।
‘তুমি তোমার বাবার গুরুদেবের কথাকেই সম্মান করে ওই করোটিকে স্বামী ভাবছ, বাহ্! আমার একটা উত্তর মিলে গেল। তোমার মতো জেদি মেয়ে কেন এটা মেনে নিয়েছিল, আজ সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল।’ সহজ কথাগুলো বলতে বলতে উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসল।
বর্ণিনী বলল, ‘সে তুমি যা ভাবার ভেবে জীবন কাটাও, সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না, হঠাৎ তোমার কী এমন বিপদ হল?’
বঁড়শি বলল, ‘সেই বিপদের কথা বলতেই তোমাদের ডাকলাম। আমার খুব সন্দেহ ওই লোকটা মানে তোমাদের ক্যাপ্টেনকে নিয়ে। মানুষটা ভালো নয়— আমার খুব সন্দেহ। সন্দেহ নয়, সত্যি—’
‘কী সত্যি?’
‘ওই মানুষটা খুনি। উনি আমার বাবাকে খুন করেছেন, প্রতিশোধ নিয়েছেন। আমার বাবা যখন মারা যায় তখন সেখানে এই পিশাচসাধু ছিলেন। উনি আমার বাবাকে চিনতেন। সেটা এতদিন পরে জানলাম। সবার শেষে মারা যান যোগীন বাবা। উনি যখন মারা যান, সেদিন রাতে যোগীন বাবার সঙ্গে উনি বসেছিলেন। তারপর যোগীন বাবার মৃত্যু হয়।’
সহজ বলল, ‘বঁড়শি তোমার বাবা আর যোগীন বাবার মৃত্যুর সময় উনি হাজির ছিলেন বলেই উনি খুনি! না, না, এটা আমি মানতে পারলাম না।’
সহজের কথায় বঁড়শি হাঁসফাঁস করে, ‘না, না, আমি তোমাদের বোঝাতে পারছি না।’
বর্ণিনী বলল, ‘এটা কাকতালীয় ঘটনা। দু’টি মৃত্যুর জায়গায় উনি হাজির ছিলেন— কিন্তু এতে প্রমাণ হয় না উনিই খুন করেছেন।’
বঁড়শি চিৎকার করে ওঠে, ‘আমি প্রমাণ করে দেব। তোমরা এই নোটবইটা দেখ।’ বঁড়শি ছিটকে উঠে যায় ঘরের এক কোণে। ওদিকে বালির ওপরে করোটি, তার সামনে গুণিতক চিহ্নে দুটি লম্বা হাড় রাখা। তার পাশ থেকে বঁড়শি একটা বাঁধানো ছোট নোটবই তুলে নিয়ে আসে। ওর সারা শরীর কাঁপছে। দু’হাতে কাঁপন। ‘এই দেখ। খুলে দেখে নাও।’
বর্ণিনী হাত বাড়িয়ে নোটবইটা নেয়। পাতা ওল্টায়। এক দুই করে সাতজনের নাম লেখা। পাশে তারা কোন সম্প্রদায় লেখা আছে। তার পাশে ঠিকানা। আর একটা করে বাংলা তারিখ।
১. সুরজিতানন্দ ভৈরব (শ্মশান ভৈরব, চিতাসাধক, খেচরী সিদ্ধ)
বাস: পানিত্রাস শ্মশান, হুগলি।
২. তারানন্দ অবধূত (মারণ উচাটন সিদ্ধ, উলঙ্গ, ত্রিশূলধারী)
বাস: শ্মশানকালী তলা, খরুন, বীরভূম।
৩. শিবানন্দ অঘোরী (স্তম্ভন বিদ্যা সিদ্ধ, শিবা ভোগ ভক্ষণকারী, ছাই মাখেন)
বাস: কঙ্কালীতলা শ্মশান, বীরভূম
৪. নাগেশ্বর বাবা (সর্পতান্ত্রিক, অষ্টসিদ্ধি লাভ করা)
বাস: বরাকর নদীর ধারে, গৌর বাজার শ্মশান ঘাট, বীরভূম।
বঁড়শি তারিখের ওপর আঙুল দেয়, বলে —এটা আমার বাবার মৃত্যুদিন। তারিখ লেখা থাকবে কেন ওর নোটবুকে? সঙ্গে দেখো, নাম, ঠিকানা।
বর্ণিনী দেখে—
৫. মা উমেশ্বরী (যোগিনী সাধিকা, পাদুকা সিদ্ধ, জটাধারী)
বাস: রামনগর শ্মশান ঘাট চামুণ্ডা, কাটোয়া, বর্ধমান।
নামটির ওপর বঁড়শি আবার আঙুল দেয়। বলে, ‘আমি উমেশ্বরী মায়ের কথা শুনেছি। বিষম খেতে খেতে মরেছে। লোক বলে, কাউকে বাণ মারতে গিয়েছিল। সেই বাণ নিজের কণ্ঠাতেই আটকে যায়। শুনেছিলাম, তখন নেশা করছিল।
৬. মোহন খ্যাপা (তান্ত্রিক সাধক, সঙ্গী ভৈরবী, যুগল সাধক, চক্রে বসেন, ত্রাটক সিদ্ধ)
বাস: কোটি লিঙ্গ মন্দির, কামাখ্যা, নীলাচল।
৭. শ্রীকৃপানন্দ সরস্বতী স্বামী (অন্তর্যামী, বাকসিদ্ধ)
বাস: কালী কঙ্কালীতলা, বীরভূম।
বঁড়শি আঙুল রাখল কৃপানন্দের ওপর, বলল, ইনিই যোগীন বাবা। আমি এর কাছেই থাকতাম।
সহজ এগিয়ে এসে নোটবইয়ের পাতাগুলো দেখছে। তার চোখে মুখে তীব্র সন্দেহ।
বঁড়শির দু’চোখে বিপন্নতা, ‘তোমরা বুঝতে পারছ না। এই সাতজনের মধ্যে তিনজন অপঘাতে মরেছে। আমার বাবা—নাগেশ্বর বাবা, উমেশ্বরী মা, যোগীন বাবা। এরা কেউ কিন্তু জলে ডুবে মরেনি। কারও মাথায় গাছ ভেঙে পড়েনি, বজ্রাঘাত হয়নি। সবাই গাঁজা টানতে টানতে মরেছে। আমি এই তিনজনের কথা বললাম। তোমরা খোঁজ নাও, আমার বিশ্বাস নোটবইয়ের নাম ধাম লেখা সাতজনই বিষপ্রয়োগে মরেছে। তোমরা এই নোটবইটা নিয়ে যাও।’
বর্ণিনী বলল, ‘নোটবই নিয়ে যেতে হবে না। আমি ছবি তুলে নিচ্ছি।’
বর্ণিনী মোবাইল বের করে পর পর ছবি তুলে নেয়। বলে, ‘যাও খাতাটা যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই রেখে এসো। তুমি শান্ত থাক। ওকে কিচ্ছু বুঝতে দেবে না। আমার বাবা পুলিসে আছে। আমি দু একদিনের মধ্যে সব ইনফরমেশন পেয়ে যাব।’
বঁড়শি বলল, ‘আরও একটা প্রমাণ আছে আমার কাছে। এদিকে এসো।’ সে বর্ণিনীর হাত ধরে ঘরের কোণে নিয়ে গেল। ‘এই দেখ, এই হাড়ের গায়ে যে কাপড়গুলো জড়ানো, এই সব কাপড়গুলো গাঁজার কলকে সাজার কাপড়, সাফি। আমার বিশ্বাস এইসব কাপড়ে বিষ আছে। তোমরা ওই কাপড়গুলো সব নিয়ে যাও, পরীক্ষা করাও। দেখবে আমি ঠিক বলছি। ওখানে সাতটা সাফি আছে। ওই সাতটা সাফির মধ্যেই বিষ আছে।’
বর্ণিনী বলল, ‘সহজ একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট জোগাড় করে কাপড়গুলো নিয়ে নে, প্রমাণ হাতছাড়া করা যাবে না।’
বঁড়শি বলল, ‘উনি ওঁর ছেলে আর বউয়ের মরার প্রতিশোধ নিচ্ছেন। হয়তো উনি সেই হত্যাকারীকে খুঁজছেন, পাচ্ছেন না, কিন্তু যাকেই সন্দেহ হচ্ছে, তাকেই
মারছেন।’