কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। উকিল, মৃৎশিল্পীদের শুভ। সংক্রমণ থেকে শারীরিক অসুস্থতা হতে পারে। আর্থিক ... বিশদ
সাউথ হ্যাম্পটন শহরটা বড্ড একঘেয়ে। আটলান্টিকের ঠান্ডা হাওয়া, ইংলিশ চ্যানেলের পার থেকে প্রাণবন্ত ফ্রান্সের হাতছানি আর মেঘ-বৃষ্টির হুটোপুটি। একটানা অনেকদিন থাকলে ডিপ্রেস্ড লাগে। আর আমার তো বছর পাঁচেক হয়েই গেল। অফিস, বাড়ি আর মাঝে মধ্যে ছুটিতে সামনের সাধের আইল অফ হোয়াইট। বাড়িতে বাড়িতে টাইটানিকে ডুবে যাওয়া মৃতের গল্পে ভরা এই শহরে উচ্চমাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষায় ইংরেজি পড়ে যাওয়ার স্বপ্নও যেন বিলাসিতা। মনকে এভাবেই অনেকক্ষণ মানানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। তাহলে ভিডিওটা? মা কী...? সন্ধে থেকে বারবার মাকে ফোন করলেও, ফোনটা সুইচড অফ। মায়ের মুখটা এভাবে কোনওদিনও মনে পড়েনি। পড়বেই বা কী করে! সারাটা জীবন তো দৌড়েই গেলাম। সেই কবে গ্রীষ্মের দুপুরে ঘামে ভিজে যাওয়া শরীর নিয়ে বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, পালাব এই ঘামের দেশ ছেড়ে। তারপর থেকেই বাবার পান বিড়ির দোকানটাকে বুড়ো আঙুল দেখানোর প্ল্যান। বাবা যদিও বেশি কিছু বলার সুযোগ পায়নি, তবে মা পেয়েছে। কিন্তু মা আবার কোনওদিনও কিছু বললই না। আফশোসটা হুট করে রাগ হয়ে গেল। ‘কেন কিছু বলল না মা?’ বহুদিন পর আবার আবার সেই, মায়ের উপর রাগ।
আবারও ফোন করলাম। কিন্তু সেই এক। তাহলে কী মায়ের? মা বরাবর চুপচাপ। টাকা পাঠালে উদাস হয়ে বলে, ‘কী হবে টাকা নিয়ে?’ তবে শরীর খারাপ হলে আমি যখন তেড়েমেড়ে বলেছি, ‘একটু ভালো করে খাও! একাদশী-অমাবস্যা করলে কি আর বাবা ফিরে আসবে?’ তখন কিছুটা জোর গলায় বলেছে, ‘একার জন্য আর রাঁধতে ভালো লাগে না রে।’ মায়ের ভিতরটা হয়তো দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে শুধু আমাকে একবার বলতে যে, ‘বাবু, ফিরে আয়।’ কিন্তু বলেনি। আমিও সুযোগ যে খুব একটা কম পেয়েছি তা নয়! পঁচিশে ডিসেম্বরের লম্বা ছুটিতে কিংবা অ্যানুয়াল লিভে বছরে অন্তত একবার তো যেতেই পারতাম। কিন্তু বারবার সেই বিশাল অঙ্কের টিকিট অথবা ফিরলে একেবারেই ফিরে যাব, দড়ি বেঁধে আটকে দিয়েছে। ‘ছিঃ’ কে যেন কানের পাশে বলল। ভীষণ যেতে ইচ্ছে করছিল! কিন্তু আমার ইচ্ছেগুলো বরাবরই এইরকম। বেইমান।
বিগত এক মাস ধরে গোটা বিশ্বে লক-ডাউন। ভারতে তো বাড়ি থেকে পাড়ার দোকানে যেতেও হাজার বিধি নিষেধ। সেখানে এই ইংল্যান্ড থেকে জল, স্থল পার করে ভারতবর্ষ! ভিতরটা ভারহীন লাগছিল। মোবাইলে আবার দেখলাম ভিডিওটা। একটা জেসিবি, প্যাকেটে মোড়া দেহটাকে পুঁতে দিচ্ছে একটা মাঠে। খুব ভালো করে দেখলাম। জায়গাটা ভীষণ চেনা। গ্রামের স্কুল-বাড়ির পিছনের ধু-ধু প্রান্তরটাই। দূরের সারি সারি গাছের জঙ্গলটাও বেশ স্পষ্ট। মুখাগ্নি করার মাঠ। গ্রামে সেভাবে কেউ চেনে না আমাকে। বাবা মারা যাবার পরপরই মফস্সলের বাড়িটা বেচে গ্রামেই বাড়ি তৈরি করেছে মা। বড্ড জেদ। বলে, ‘তোর বাবাও নেই, তোকে পড়ানোর ভালো স্কুলেরও আর দরকার নেই। কেন থাকব বলত?’ আমিও কতবার বলেছি আসতে। কিন্তু আসেনি। কিছু করতে না পারার রাগটা আস্তে আস্তে মাথায় উঠছিল। আবার ফোন করলাম। কিন্তু কোনও লাভ হল না। অবশেষে, সুমনকে কল করলাম। সুমন গ্রামেরই ছেলে। মুদির দোকান আছে। গ্রামের মোটামুটি সবাইকেই চেনে। কিন্তু সুমনও তুলল না। ভিতরটা হালকা হয়ে আসছিল। ভিডিওটাতে আমি স্পষ্ট শুনেছি, ‘একাকী মহিলার মৃত্যু ঘিরে চাঞ্চল্য। করোনা সন্দেহে প্রশাসনের তৎপরতায় জেসিবি করে দেহ কবর দিল গ্রামবাসী।’ ‘মরার সময় মুখে জল দিবি তো?’ ভাবতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। আমি আরও আরও নেট ঘাঁটলাম কিন্তু শুধু ওইটুকুই। আর কোনও খবরই নেই। তাহলে কী? রু
মের জানলাটা তুলে দিলাম। গরমটা আর সহ্য হচ্ছিল না। এর থেকে আমার ভারতের ভর দুপুর অনেক অনেক স্বস্তির। পাগলের মতো মায়ের মোবাইল নম্বরটার নীচের সবুজ বটনটাকে টিপেই গেলাম। কিন্তু সেই এক! মোবাইলটা বিছানায় ছুঁড়ে মুখটা বের করে দিলাম জানলার বাইরে। একটা স্থির ঠান্ডা গলাটাকে আস্তে আস্তে চেপে ধরছিল। শ্বাস নিতে কষ্ট হলেও আমার বেশ লাগছিল। আর ঠিক তক্ষুনি বেজে উঠল ফোনটা। মায়ের নম্বর! ওয়েব কল করাটা মাকে বেশ ভালোই শিখিয়ে দিয়েছে সুমন। সেই সঙ্গে জিএমটি আর ডে-লাইট সেভিংস এর ফান্ডাটাও। আমি ব্যস্ততার সঙ্গে ফোনটা ধরলেও কিছু শুনতেই পেলাম না। পকেটে থাকা মোবাইল থেকে ভুল করে কল চলে গেলে যেমনটা হয়, ঠিক তেমনটা। হুট করে চোখ গেল ঘড়িতে, ভোর পাঁচটা। এখানকার সময়ের হিসাব মা বেশ ভালোই জানে। তাছাড়া এই অসময়ে কখনও ফোনও করেনি মা! তাহলে কী গ্রামের কেউ? ফিরতি পথে? অস্থিরতায় দরদর করে ঘেমে গেল গোটা শরীর। আবার পাগলের মতো মায়ের মোবাইল নম্বরের নীচের সবুজ বটন। কিন্তু সে-ই এক! আধ-খোলা জানলায় মুখটা বের করে দাঁড়ালাম আবার। ভোরের সূর্য তখন প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। একটা লালচে আলো চারিপাশটাকে ঘিরে ধরছে। সেই সঙ্গে আমাকেও যেন ঘিরে ধরছে একটা ভয়। ঘামে ভিজে যাওয়ার ভয়। ঠিক তক্ষুনি আবার বেজে উঠল ফোনটা। আমি আর নম্বরও দেখিনি। উন্মাদের মতো বলে উঠেছিলাম , ‘মা’। ওপার থেকে শুধু একটাই কথা, ‘কিরে বাবু! ঘুম আসছে না?’ আমি কী শুনেছিলাম জানি না, তবে রাগে তখন আমার মেজাজ তুঙ্গে।
‘একটা ফোনও করতে পারো না?’
‘করলাম তো কালকেই! কী হয়েছে বাবু?’
‘তোমার ফোন লাগছিল না কেন?’
‘চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল ফোনের। কারেন্ট নাই, কাল থেকে। এই এল।’
‘মা খুব গরম, কষ্ট হচ্ছে।’ কথাগুলো নিজে থেকেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। ‘ঘেমে গেছিস নাকি? কারেন্ট নাই?’ মায়ের পরের কথাগুলো আমাকে নিজে থেকেই বলিয়ে নিল,‘মা বাড়ি যাব।’ আর বাড়ির কথা বলতেই মা যেন প্রাণ ফিরে পেল।
‘চলে আয়! কতদিন তোকে সামনে থেকে দেখিনি। পাঁজরের হাড়গুলো বেরিয়ে গেছে এতদিনে!’
‘কিন্তু এখন তো সব বন্ধ। লকডাউন,’ বলতে বলতেই, ঘামে ভিজে একসার আমি। এই ঘামের থেকেই তো পালিয়ে বাঁচতে এসেছিলাম! নিজের উপর ভীষণ হাসি পাচ্ছিল। তারপর থেকে যতদিন লকডাউন চলেছে, যতদিন দেশে ফিরতে পারিনি, ততদিন আমি রোজ শ্বাস-প্রশ্বাস গুনেছি। যাতে আর ঘামতে না হয়।
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল