বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হল। ভানু রাজি হলেন। তখন রাম চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘ইচ্ছে করলে কিন্তু আমি তোমাকে তুলে নিয়ে যেতে পারতাম।’ কথাটা কানে যেতেই ভানু ফের স্বমূর্তিতে। বললেন, ‘অতই সহজ। আমারে পাইতা কই। একছুটে আমি ছাদে গিয়া উঠতাম। রাম চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘তাহলেই রেহাই পেতে ভেবেছ।’ ভানু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘পাইতাম, পাইতাম। তোমার মাথায় তো আর মাসল নাই। উপর থিকা একখান আধলা ইট ঝাড়তাম তোমার মাথায়, তখন যাইতা কই।’ একথা শুনে রাম চট্টোপাধ্যায় আর না হেসে পারেন!
আর একবার কালীঘাটের নেলো মস্তান এসে ভানুকে বলল, ‘তোমাকে যেতেই হবে, মনে রেখো আমি কালীঘাটের নেলো।’ ভানু বললেন, ‘কিছুতেই যামু না, তুমিও মনে রাইখ আমি ঢাকার ভুলো।’ একবার এক ভদ্রলোক এসে বিনা পয়সায় ফাংশন করার জন্য আস্তিন গুটিয়ে বললে, ‘আমি নর্থ ক্যালকাটার ছানা।’ ভানুও চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘আমি সাউথ ক্যালকাটার মাখন।’ আসলে ভয়ডর বলে সত্যিই কিছু ছিল না তাঁর। অথচ কেউ যদি এসে বলত, ‘খুব বিপদ, দয়া করে উদ্ধার করে দিন’ তাহলে আনন্দ সহকারে কাজ করে দিতেন।
তবে ছোট থেকেই সাহসী বোহেমিয়ান টাইপ লোকেরা ছিল তাঁর বিশেষ পছন্দের। কার থেকে পেয়েছিলেন এসব! অভিনয়টা ছিল তাঁর রক্তে। বাবা জিতেন্দ্রনাথ ছিলেন ঢাকার নবাব এস্টেটের মোক্তার। মা সুনীতিদেবী, সরকারি শিক্ষা বিভাগের চাকুরে। সরোজিনী নাইডুর আত্মীয়া। এঁদেরই পুত্র সাম্যময়। ডাকনাম ভানু। ‘তবে ডাকাবুকো স্বভাবটা বোধহয় ঠাকুমার থেকেই পেয়েছিল বাবা’, বলছিলেন ভানু-পুত্র গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়।
আসলে সুনীতিদেবী ছিলেন সেইসময় বেঙ্গল বোর্ডের প্রথম ভারতীয় ইনস্পেক্টর অব স্কুলস। একবার যাচ্ছিলেন দার্জিলিং। তাড়াহুড়োয় উনি ইংলিশ লেডিদের কামরায় উঠে পড়েন। এক মেমসাহেব তখনই তাঁকে নেমে যাওয়ার জন্য জোর করতে থাকেন। তখন উনি হাতজোড় করে বলেন, ‘তাড়াতাড়িতে উঠে পড়েছি। পরের স্টেশনেই নেমে যাব।’ মেমসাহেব তো কোনও কথা শুনতে নারাজ। জোর করে তাঁর বাক্স-প্যাঁটরা চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিল। ব্যস, আর যায় কোথায়। চুলের মুঠি ধরে সেই মেমসাহেবকে উত্তম মধ্যম দেন। মারের চোটে মেমসাহেব অজ্ঞান। ট্রেনের গার্ড সুনীতিদেবীকে অ্যারেস্ট করবেই। শেষে তাঁর জাঠতুতো ভাই ও জেলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আইসিএস পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায় ত্রাতা হয়ে দেখা দেন। ১৯০৫ সালের সেই ঘটনা তখনকার দিনে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল।
বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন ভানু। পুরো ঢাকা ইউনিভার্সিটি তাঁকে ‘স্যার’ বলতেন। শুধু ভানুর কাছে তিনি ছিলেন ‘সত্যেনদা’। ১৯৪১ সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ওঁর জন্মদিন প্রথম উদযাপন করেছিলেন ভানুই। তা এই সত্যেন বসুর সঙ্গেও ভানুর আলাপের সূত্রপাত এইরকমই একরোখা স্বভাবের কারণে। কলেজের হোস্টেলে সরস্বতী পুজো। সেখানে ভানুও নিমন্ত্রিত। খুব ঘটা করে পুজো, এলাহি খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। কোথা থেকে একজন পঙ্গু মুসলমান ভিখারি কাঁদো কাঁদো মুখে দু’মুঠো খাবার চাইতে এলেন। একদল ছাত্র তাঁকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও ব্যাপারটা চোখ এড়াল না ভানুর। একটু পরেই আমোদ-আহ্লাদ তুঙ্গে উঠল। খাবার নিয়ে ছোঁড়াছুঁড়িও শুরু হল। আর থাকতে না পেরে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে টান মেরে সব খাবার মাটিতে ফেলে দিলেন। রাগে গজগজ করতে করতে বললেন, ‘আমিও খামু না, কাউরে খাইতেও দিমু না।’
বাধা দিতে এল কয়েকজন। কয়েকটাকে বেধড়ক ঠ্যাঙালেন। বাকিরা এগনোর সাহস পেল না। কিন্তু ঘটনার জল বহুদূর গড়াল। প্রায় সবাই ভানু ওরফে সাম্যময়ের বিরুদ্ধে। তখন পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অধ্যাপক সত্যেন বসু। সেই শুরু। তারপর থেকে ছাত্র ভানুর ঢাকাই কুট্টিদের নকশায় মজে গিয়েছিলেন জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানীও। একবার এক যাত্রা সম্মিলনী সত্যেন বসুকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার আর্জি নিয়ে এল। তাদের বললেন, ‘আরে আমাকে কেন, ভানুকে নিয়ে যাও।’ তাতেও তারা শুনলেন না। শেষে তাদের রসগোল্লা খাইয়ে বিদায় দেওয়ার সময় বললেন, ‘আরে আমার কাছে শুধু গোল্লা পেলে, ভানুর কাছে গেলে রসটা পাবে।’ এই সম্পর্ক সত্যেন বসু মারা যাওয়া পর্যন্ত অটুট ছিল। জন্মদিনের দিন শত ব্যস্ততা থাকলেও মাস্টারমাশাইয়ের বাড়িতে সেদিন তিনি যেতেনই।
হাতিবাগান থিয়েটার পাড়াতেও ভানুর এরকম সাহসের একটা গল্প চালু আছে। গাড়ি নিয়ে স্টার থিয়েটারে ‘পরিণীতা’র শো করতে যাচ্ছেন। পথে একটি ঘটনা দেখে থমকে দাঁড়ালেন। একদল চ্যাংড়া ছেলে অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীকে ঘিরে ধরে তাঁর ফতুয়া, ধুতির কোঁচা ধরে টানছে। মাথায় রক্ত উঠে গেল ভানুর। গাড়ি থেকে সটান নেমে গিয়ে বাছাধনদের এলোপাথাড়ি কিল, চড়, ঘুষি লাগিয়ে দিলেন। নিমেষে সকলে হাওয়া। কিন্তু অবাক করলেন তুলসী চক্রবর্তী নিজেই। বললেন, ‘আহা অত রাগিস কেন, একটু মজা করে যদি ওরা আনন্দ পায়, পাক না।’
এই একরোখা মানুষটি আবার নিজের জীবনে মজা করার সুযোগ পেলেও ছাড়তেন না। ইস্টবেঙ্গলের খেলা থাকলে যে তাঁকে ঘরে রাখা যেত না সে তো আগেই বলেছি। আর ইস্টবেঙ্গলের খেলোয়াড়দের সঙ্গেও তাঁর দারুণ হৃদ্যতা ছিল।
সালে, আপ্পারাও, বেঙ্কটেশ, ধনরাজ আর আমেদ খান। ইস্টবেঙ্গলের পঞ্চপাণ্ডব তখন ময়দান কাঁপাচ্ছে। সালে একদিন ভানুকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমহারা নাম কেয়া হ্যায়? নাম ‘ভানু’ শুনে সালে তাঁকে বলেন, ‘তুম যিতনা দুবলা হ্যায়, তুমহারা নাম ভি ওয়সা হ্যায়। দেখো হামারা নাম কিতনা বড়া হ্যায়। পুথম পরমাভিল বাবখান আবদুল রদ্দার সালে।’
একথা শুনেই ভানু বলে ওঠেন, ‘ইয়ে আসলে এটা আমার ডাকনাম। মেরা আসলি নাম হ্যায় অ-এ অজগর আসছে তেড়ে, আ-য় আমটি আমি খাব পেড়ে, ই-তে ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে...।’ ভানু লিখেছেন, ‘এরকমভাবে ৯-কার যেন ডিগবাজি খায় পর্যন্ত বলে শেষে আমি ভানু ব্যানার্জি বললাম। সালে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল বাপরে ইতনা বড়া নাম!
(ক্রমশ)
অনুচিত্রণ:ভাস্কর মুখোপাধ্যায়
অলংকরণ: চন্দন পাল