বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
এসব কথা লিখতে গিয়ে ষোড়শ শতকের শুরুতেই নিমাই-এর বাবা জগন্নাথ মিশ্রের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। দুরন্ত নিমাইয়ের জ্বালাতনে শচী-জগন্নাথ তো দূরের কথা— পাড়া প্রতিবেশীরা অতিষ্ঠ। রেগেমেগে জগন্নাথ মিশ্র ছেলের টোলে পড়তে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। শচীমাতা হত্যে দিয়ে পড়লেন স্বামীর পায়ে— ওগো ছেলেটার পড়া বন্ধ করে দিও না। ও রোজগারপাতি না করতে পারলে ওর বিয়ে পর্যন্ত হবে না, কেউ বাউণ্ডুলের হাতে মেয়ে তুলে দেবেন না— তুমি ওর এত বড় সব্বনাশটি করোনি বাপু! শুনে জগন্নাথ হেসে জবাব দিয়েছিলেন, বিদ্যে থাকলেই যদি রোজগার হতো তাহলে আমার এই হতদশা হবে কেন? ঠাকুরদাসেরও প্রায় সেই অবস্থা। তবুও তো জগন্নাথের কনে জুটেছিল। জাহানাবাদ মহকুমার গোঘাটে গভীর জ্ঞানী আর সম্পত্তিওয়ালা রামকান্ত তর্কবাগীশ বাস করতেন। ইনি বিয়ে করেছিলেন পাতুলগ্রামের আর এক জ্ঞানী পণ্ডিত পঞ্চানন বিদ্যাবাগীশের বড় মেয়ে গঙ্গামণিকে। এই বিয়ের ফলে তার দুটি কন্যা লাভ হয়— লক্ষ্মী এবং ভগবতী। রামকান্ত আর রামজয়ের এক অদ্ভুত মিল— বিয়ে করে রামজয় সংসারে মন দেননি— রামকান্তও বিবাগী হয়ে করঞ্জী গ্রামে নিজের মামার বাড়িতে ডেরা পাতেন, প্রতি অমবস্যায় শ্মশানে নিরম্ব একা শবসাধনা করেন, শেষ বয়সে মৌনীবাবা হলেন। একটা মাত্র শব্দই ব্যবহার করতেন কাজে-অকাজে— ‘মঞ্জুর’।
জামাইয়ের কাণ্ডজ্ঞান দেখে পঞ্চানন বিদ্যাবাগীশের অবস্থা তো চিত্তির। তিনি মেয়ে-জামাইকে নিজে বাড়িতে এনে তুললেন— ফাউ হিসেবে ততদিনে তাঁদের যে দুটি কন্যা জন্ম নিয়েছিলেন—সেই দৌহিত্রী দুটিও এলেন। দায়িত্ব পালনের সামর্থ্য ছিল তাই আনলেন বটে, কিন্তু তাঁর আয়ু ফুরিয়েছিল— কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হল। বাবার দায়িত্ব বর্তাল এসে পঞ্চাননের বড় ছেলে— গঙ্গামণির ভাই অর্থাৎ ঈশ্বরচন্দ্রের মা ভগবতী দেবীর বড়মামা রাধামোহন বিদ্যাভূষণের ওপর। এই বড়মামা একজন জ্ঞানবান ব্যক্তি তো বটেই, তার ওপর ছিলেন খুবই দিলদরিয়া মেজাজের। দেখি পরে ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে মায়ের মামা সম্পর্কে ঠিক কী কথা লিখে গিয়েছিলেন:
‘এই সময়ে ঠাকুরদাসের বয়ঃক্রম তেইশ-চব্বিশ বৎসর হইয়াছিল। তাহার বিবাহ দেওয়া আবশ্যক বিবেচনা করিয়া তর্কভূষণ মহাশয় গোঘাট-নিবাসী রামকান্ত তর্কবাগীশের দ্বিতীয় কন্যা ভগবতী দেবীর সহিত, তাঁহার বিবাহ দিলেন। এই ভগবতী দেবীর গর্ভে আমি জন্মগ্রহণ করিয়াছি। ভগবতী দেবী শৈশবকালে মাতুলালয়ে প্রতিপালিত হইয়াছিলেন।’
এদিকে ঠাকুরদাসকে উপার্জনশীল দেখে ও তাঁকে বিবাহিত করে দিয়ে রামজয় আবার গৃহত্যাগ করলেন। অবশ্য ঈশ্বরচন্দ্রের জন্মের ঠিক আগে আগেই আবার সংসারে ফিরে আসেন। ভগবতীদেবীর সঙ্গে ঠাকুরদাসের বিয়েতে গোঘাট থেকে বীরসিংহায় একটা বিশেষ সংস্কৃতি বয়ে এল। ঈশ্বরচন্দ্রের মাতামহ এবং বড়মামার সুবাদে এখানে বয়ে এল একটা উদার আবহাওয়া— সে হাওয়া দিলে বইলে তা দরিয়া হয়ে যায়। মুক্তমনের একটা বাতাবরণ, দানে-ধ্যানে, অপরের দুঃখমোচনে একটা দরিদ্র পরিবার সহসা বিত্তের দিক থেকে না হলেও চিত্তের খোলা হাওয়ায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। ঈশ্বরচন্দ্র গর্ভে এলে ভগবতী দেবী উন্মাদরোগগ্রস্তা হয়ে পড়েন। নানা তুকতাক ঝাড়ফুঁক চলতে লাগল ন’ মাস ধরে। তারপরে কিমাশ্চর্যমতঃপরম— ঈশ্বরচন্দ্র প্রসব হলেন— ভগবতী দেবী সুস্থ হয়ে উঠলেন। লোকমুখে প্রচারিত হল, রামজয় কেদার পাহাড়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর বংশে এমন এক সুপুত্রের আবির্ভাব হতে চলেছে যিনি স্থিরকীর্তি হয়ে সংসারে দেশের কল্যাণে নিজের জীবনদান করবেন। জানি না বিদ্যাসাগর সেই স্বপ্নাদ্য সন্তান কি না। বিদ্যাসাগর মশায় অবশ্য এসব স্বপ্নটপ্নের কথা কোথাও লিখে যাননি। হয়তো বাঙালি এমন একটা স্বপ্ন দেখছিল যা সাকার হল বিদ্যাসাগরে। কত সুকৃতির একটা ফলের নাম যে ঈশ্বরচন্দ্র হয়— তা বাঙালি দুশো বছর ধরে চাক্ষুষ করে আসছে।
এক এক সময় মনে হয়, সেকালে মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার চল ছিল না। বলা হতো মেয়েরা পড়াশোনা করলে তাদের স্তনোদ্গম হবে না। তারা বিয়ে হবার পরে পরেই বিধবা হবে ইত্যাদি। যদি ভগবতী দেবী একটু পড়াশোনা জানতেন! আবার মনে হয় পড়াশোনা না জেনেই যা ভাবনা-চিন্তা করতেন তাতে তো হাজার পড়াজানা মেয়েদের কান কাটার অধিকার পেয়েছিলেন তিনি। গয়না পরার সাধের কথা ছেলেকে যে ভাষায় তিনি বলেছিলেন, তা তো হাজার লেখাপড়া মেয়েরা উচ্চারণ করতে পারতেন না। একটা অক্ষর না চিনেও তো সারদা মা এক কথায় দুর্গাপুজোতে বেলুড়মঠে বলিদান প্রথায় লক্ষ্মণরেখা কেটে দিয়েছিলেন। কথাটা হচ্ছে চিত্তের উদারতা নিয়ে জন্মানো। শুধু নিজে তার আচরণ না করে পরিবারে, সমাজে তাকে ছড়িয়ে দেওয়া— একটা উত্তরাধিকার সৃষ্টি করা— একটা ভগবতীই সেটা করে দেখালেন।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে Morning shows the day— সকালবেলাটা দেখেই দিনটা কেমন যাবে— তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। ভগবতী দেবীর ছোটবেলাটাই আর পাঁচজন থেকে আলাদা। যেখানে ছুঁৎমার্গ সমাজটাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল, সেখানে ভগবতী দেবী খেলা করতেন তাঁর যেসব সমবয়সিদের সঙ্গে তাঁরা সবাই ব্রাহ্মণ ছিলেন না। অনায়াসে তিনি ব্রাহ্মণেতর সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশতেন। যে সময় দক্ষিণ ভারতে (বোধকরি এখনও চলমান) পারিয়াদের গায়ের ছায়া তথাকথিত উচ্চবর্ণের গায়ে পড়ে— পারিয়ার জীবন সংশয় হয়, সে সময়ে ভগবতী দেবী কী প্রবল অসাম্প্রদায়িক। শুধু তাদের বাড়ি গিয়ে খেলা নয়, নিজের বাড়িতে তাদের ডেকে এনে খেলতেন। জানি না প্রতিবেশীরা তাঁদের বাড়ি উঠোন গঙ্গাজলে ধুয়ে দেবার পরামর্শ দিতেন কি না। শুধু কি তাই? বাড়ির মেয়েদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান-ব্রতকথার আসরে তাদের আমন্ত্রণ ছিল দরাজ। অন্য সময়ে সবাই এক জায়গায় জড়ো হলে সেই সব গল্প তাদের কাছে বুঝিয়ে বলতেন। আহা, নিবেদিতা বলছেন— Cradle Tales of Hinduism-এর গল্পগুলো বাংলা করে মেয়েদের!
ভগবতীর একটা কৌতূহল ছিল— অন্যদের দুঃখ-কষ্টের কথা জানার। তাঁরা কতটা কষ্টে আছেন জেনে কীভাবে তা লাঘব করা যায়, তার উপায় বের করা। বাগদির ছোটরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে—তখন ভগবতী ভাবতেন অসুখের কোনও জাত হয় না, তখন অসুখটাই জাত হয়ে ওঠে। ওই জাতের নিকুচি করাটাই তার একমাত্র কাজ হয়। মামাকে বলে, কখনও নিজে থেকেই টাকা-পয়সা, খাবার-পথ্য নিয়ে তিনি দাঁড়াতেন। পাড়ার লোকে দেখত— জীবন্ত ভগবতী দেবী।
(ক্রমশ)