বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
এই একঘেয়েমি কাটাতে দুই বুড়ো-বুড়ি মাঝেমধ্যে ছেলে মেয়েদের কাছে যায়। কখনও মেয়ের কাছে কিছুদিন থাকে আবার কখনও ছেলের কাছে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে বার্নপুরে আর ছেলে চাকরিসূত্রে থাকে বেলঘরিয়ায়।
অখিলেশ এখন ছেলের কাছেই আছে। ছেলে-বউমা তার ভালো। মা-বাবাকে কখনও বোঝা বলে মনে করে না। অখিলেশ নিজের মুখেই বলে, বাজার-হাটটা অন্তত করতে দাও বউমা। শরীরটা একটু নাড়াচাড়া হয়। বসে থেকে থেকে হাঁটুমাটু সব জমে গেল। বউমা বলে, জীবনে তো বাজারহাট অনেক করেছেন এবার খাওয়া-দাওয়া করুন আর ঘুরুন-ফিরুন। হাঁটাহাঁটি করলে দেখবেন শরীর ভালো থাকবে।
বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে যায় ওই স্টেশনের ধার দিয়ে। স্টেশনের একধারে এক চিলতে ঘাস জায়গায় বয়স্কদের একটা আড্ডা বসে। সেই আড্ডাতে এখন যায় অখিলেশ। নানা বিষয় নিয়ে চলে আলোচনা। ঘোষবাবু বলে, আজ প্রেশারটা চেক করালাম বুঝলে হে রাখু। ঠিকই আছে। ডাক্তার বলল, নুনটা একটু কম খাবেন তাহলেই হবে। তবে ওষুধ চলবে। মিত্রি বলে, কপালভাতি করে ঘাড়ের ব্যথাটা কিছুটা কমেছে কিন্তু হাঁটুর ব্যথায় কাহিল হয়ে গেলাম।
চলে নানা আলোচনা। পাশ দিয়ে ট্রেনগুলো চলে যায় তার নিজস্ব সময় মেনে।
আজ পথে আসতে আসতে দেখা বিমলবাবুর সঙ্গে। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী পূর্ণিমা। এই পূর্ণিমাকে দেখার পর থেকে অখিলেশের মনে একটা খটকা লাগে। পরিচয় জানতে মনটা উসখুস করে। মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়ে পূর্ণিমা সম্পর্কে জানতে মনে সংকোচও জাগে। পাছে অন্য কিছু ভেবে বসে। তাও আবার এই বয়সে।
এমনই একজন পূর্ণিমার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেছিল। তখন তার বয়স ছিল ওই তেইশ কি চব্বিশ। সেই পূর্ণিমার বাড়ি ছিল বোধাইবাটি। একটা প্রত্যন্ত গ্রাম। সেই পূর্ণিমার সঙ্গে এই পূর্ণিমার কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বছর বদলেছে, কালের পলি পড়েছে শরীরে। চেনায় ভাটার টান। তবে সেই পূর্ণিমাও এই পূর্ণিমার মতো কলকল করে হাসত, কথা বলত। কোনও জড়তা ছিল না। প্রাঞ্জল ব্যবহার।
পূর্ণিমাদের বাড়ি প্রত্যন্ত গ্রামে হলেও অখিলেশদের বাড়ির সঙ্গে একটা পারিবারিক যোগাযোগ ছিল। পূর্ণিমার বাবা সৃষ্টিধর মাঝেমধ্যে আসতেন। সেই সুবাদে পূর্ণিমাকে চিনত অখিলেশ।
সেবারে পূর্ণিমা ছিল উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী। ওর পরীক্ষার সেন্টার পড়েছিল রাজ হাইস্কুলে। রাজ হাইস্কুল আবার অখিলেশদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। তাই পূর্ণিমার বাবা ঠিক করেছিলেন পূর্ণিমা অখিলেশদের বাড়ি থেকেই পরীক্ষা দেবে। এমন প্রস্তাবে কেউ অরাজি হয়নি। পরিচিতিদের মধ্যে থাকার জায়গা যখন একটা আছে, তখন অন্য জায়গায় থাকবেটাই বা কেন। তাছাড়া পরীক্ষা বলে কথা। নিরাপত্তারও একটা দিক আছে।
অখিলেশের দায়িত্ব পড়েছিল পূর্ণিমাকে স্কুলে দিয়ে আসা এবং নিয়ে আসা। কারণ পূর্ণিমা এখানকার পথঘাট তেমন কিছু চেনে না বা জানে না। ওর একার পক্ষে অসুবিধে হতে পারে।
পরীক্ষার প্রথম দিনে স্কুলে যাবার আগে পূর্ণিমা ঠাকুর, দেবদেবীকে প্রণাম করে অখিলেশকে ডেকে বলল, এই অখিল শোন। স্কুলে আমাকে যেন ফড়িং বলে ডাকবি না। কেমন।
—কেন রে?
—না, মানে স্কুলের সবাই আমাকে পূর্ণিমা বলে চেনে।
—ডাকনাম জানলে ক্ষতিটাই বা কী? ফড়িং নামটা খারাপই বা কোথায়?
—ভালো-মন্দ বুঝি না। আমার ডাকনাম অন্য কেউ জানুক সেটা আমি চাই না। আমার এটাই সাফ কথা।
—বেশ তুই যখন চাস না তখন ফড়িং বলে ডাকব না।
—এই তো আবার ফড়িং বললি।
—আরে বাবা! এখানে বললাম বলে তোর বন্ধু-বান্ধবদের সামনে না বললেই তো হল?
—পূর্ণিমা বলাটা অভ্যেস কর। চারবার বল।
—আমার মনে থাকবে। তোকে অত সাবধান করাতে হবে না।
—দেখিস যেন, মুখ ফসকে বেরিয়ে না পড়ে। তাহলে আমি কিন্তু লজ্জা পাব।
—তুই যাতে লজ্জায় না পরিস সে বিষয়ে আমি সতর্ক থাকব। পরীক্ষা যাতে ভালো হয় এখন সেই বিষয়ে ভাব। পরীক্ষা শেষে ফড়িংকে আনতে গিয়ে অখিলেশ দেখে ফড়িং ওর বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে চুটিয়ে গল্প করছে। খুব হাসি-খুশি মুখ-চোখ। বোঝা গেল পরীক্ষা ভালোই হয়েছে। গল্প করেই যাচ্ছে। যদি না ডাকে তাহলে গল্প করেই যাবে। ওই ফাঁকে অখিলেশ ডেকে বসে, ফড়িং।
এক ডাকে শুনতে পেয়ে ফড়িং অখিলেশের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার কটমট করে তাকাল। অখিলেশের অসাবধানতার কথা ভেবে ফড়িং বোধহয় রেগে গিয়েছে। এত করে বলা সত্ত্বেও সেই ফড়িং। বদমাস কোথাকার।
কথা বলা শেষ হলে ফড়িং গটমট করে কাছে এসে বলল, তোকে বারবার করে বললাম না আমাকে কখ্খনও ফড়িং বলে ডাকবি না।
—ওরা বুঝতে পারেনি। তাছাড়া ওরা তো আমাকে চেনে না। কাকে না কাকে ফড়িং বলে ডেকেছি বুঝবে কী করে! তবে আমার মতে কী বলে জানিস তোর ডাকনামটা ওদের জানানো দরকার।
—কেন ওদের জানিয়ে কী হবে?
—নামটা তোর পছন্দ না হলেও এই নামটার একটা তাৎপর্য আছে। ফড়িং একটা ক্ষুদ্র প্রাণী হলেও ওর ভিন্ন অনুভবের চারটে ডানা আছে। যা অনেকের নেই। কেমন একটা ছান্দিক গতিতে ওড়ে। এই দিকটার কথাটা একবার ভাব।
এমন কথায় ফড়িং কী বুঝল জানি না অখিলেশের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল।
—কী দেখছিস অমন করে?
—তোকে।
—হঠাৎ আমার মধ্যে কী এমন দেখতে পেলি?
—ওই যে বললি আমার চারটে ভিন্ন অনুভবের ডানা আছে। অনুভবটা কী রে?
—ওটা তুই নিজে থেকে উপলব্ধি করার চেষ্টা কর, ঠিক বুঝতে পারবি। কারও নিজস্ব ব্যাপারে অন্যের হস্তক্ষেপ করাটা উচিত নয়। তবে তোর ডাকনামটা আমার খুব ভালো লেগেছে। ফড়িং। কাড্ল নেম।
—আবার। তোকে বললাম না আমাকে এখানে ফড়িং বলে ডাকবি না। আমি চাই না আমার ডাকনামটা সবাই জেনে ফেলুক।
—বেশ, আর ডাকব না। এবার চল।
সেই পূর্ণিমা যার ডাকনাম ছিল ফড়িং সেই ফড়িংয়ের সঙ্গে অখিলেশের আর কখনও দেখা হয়নি। পূর্ণিমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কোথায় বিয়ে হয়েছে সেসব কিছু জানে না। প্রায় চল্লিশটা বছর আগেকার কথা। কে কোথায় আছে, কেমন আছে কে জানে।
আসার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে বিমলবাবু এবং পূর্ণিমার চোখে-মুখে কিছুটা খুশির ভাব। বিমলবাবু স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে গলগল করে কথা বলে চলেছে। কথায় কথায় বিমলবাবু এবং পূর্ণিমার আনন্দের কথাটা জানা গেল। বিমলবাবুর ছোট ছেলে চাকরিসূত্রে থাকে গুজরাতে। ছোট বউমার বাচ্চা হয়েছে। সেই খবরে এত উল্লাস। বিমলবাবুর দুই ছেলে, এক মেয়ে।
মেয়ের বিয়ে হয়েছে বারাসাতে। বড় ছেলে থাকে অন্ডালে। কথার পিঠে জানা গেল পূর্ণিমার কথা। কথাটা জানতেই অখিলেশের কপালে গুটিকয়েক ভাঁজের রেখা ফুটে উঠল। তাহলে এই পূর্ণিমাই কি সেই পূর্ণিমা। মিল খুঁজে পেতে সে আর আবেগ সংবরণ করতে না পেরে ডেকে ফেলল ‘ফড়িং’।
আচমকা এমন একটা ডাকে পূর্ণিমা কিছুক্ষণের জন্য অখিলেশের দিকে তাকিয়ে থাকল। স্মৃতির আড়াল থেকে নুড়িপাথরগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে কতকগুলো মুখ ভেসে ওঠে। কে এই মানুষটা। নিশিকান্ত! নাহ্! গোলকপতি। নাহ্! তারপর একসময় বলে ওঠে, অখিল।
অখিলেশ হেসে বলে, কী বলে ডাকব, তুই-তোকারি করে না তুমি আমি করে। এই বয়সে এসে তুই-তোকারি ডাক কেমন বেমানান দেখায়।
পূর্ণিমা বলল, উঃ, কত বছর পর দেখা হল তাই না। তা এখানে কী মনে করে?
—এখানে বড়ছেলের কাছেই আছি। ও এখন এখানেই থাকে। বছরখানেক হল বদলি হয়ে এসেছে।
— গিন্নি?
—গিন্নিও এসেছে।
বিমলবাবু বললেন, তাহলে তোমরা দেখছি পূর্ব পরিচিত।
পূর্ণিমা বলল, আমাদের যে একই গ্রামে বাড়ি ছিল। তারপর কাকু মানে অখিলেশের বাবা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসেন। আচ্ছা অখিল তুমি কি আমাদের গ্রামে এখনও যাও? কী সুন্দর গ্রাম ছিল আমাদের, তাই না? সেই মাঠের ধারে গ্রামে ঢুকতেই গাঙ্গুলি পুকুর। শাপলা, শালুক, জল পিপি, মাছরাঙা। পুকুরের উত্তর পাড়ে বিরাট একটা শিমুলগাছ। কত পাখি বাসা বাঁধত তাই না, সেই শিমুল গাছটা এখনও আছে?
অখিলেশ বলল, আমারও অনেকদিন গ্রামে যাওয়া হয়নি। বলতে গেলে আমাদের আর কেউ গ্রামে নেই। এক ভাইপো আছে সে-ই বাড়ি-ঘরগুলো দেখাশোনা করে।
নেপালবাবু অনেকক্ষণ ওদের কথাগুলো মন দিয়ে শুনে বললেন, এমনটা খুব কমই হয়। শেষ জীবনে এসে শৈশবের দিনগুলোকে কিছুক্ষণের জন্য ফিরে পাওয়া। স্মৃতি সততই সুন্দর হয়। শুনতে খুব ভালো লাগছে আমার।
অবনীবাবু বললেন, গল্প-উপন্যাসে এমন সব ঘটে থাকে।
—ধরে নাও এটাও ওদের জীবনে একটা গল্প। মানুষের জীবনকে জড়িয়েই তো গল্প উপন্যাস।
—তা অবশ্য ঠিক।
বিমলবাবু রসিক মানুষ। রসে-বশে থাকেন। বললেন, আজ আমি একটা নতুন জিনিস জানতে পারলাম। যেটা আমার কাছে এতদিন অজানাই ছিল।
নেপালবাবু বললেন, কী সেটা?
বিমলবাবু বললেন, আমার স্ত্রীর ডাকনাম ফড়িং।
পূর্ণিমা আক্ষেপ করে বলল, আমার ডাকনামটা আর গোপন থাকল না। আজ সবাই সেটা জেনে গেল!