কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। উকিল, মৃৎশিল্পীদের শুভ। সংক্রমণ থেকে শারীরিক অসুস্থতা হতে পারে। আর্থিক ... বিশদ
স্বামীহীন শ্বশুরবাড়িতে থেকে যাওয়ার চল তো নেই। অতএব কী করবেন প্রফুল্লমুখী? ফিরে এলেন পিত্রালয়ে। আধুনিক এবং তেজস্বী যোগেন্দ্রনাথ চাইলেন মেয়ের পুনরায় বিবাহ দিতে। বিধবাবিবাহ। কিন্তু প্রফুল্ল আর রাজি নন। তিনি বললেন, এভাবেই তিনি কাটিয়ে দিতে চান বাবা-মায়ের সঙ্গে। জোরাজুরি করলেন না বাবা-মা। কেটে গেল তিনটি বছর। সময় সবই ভাসিয়ে নিয়ে যায়। শোকতাপও হয় স্তিমিত। এই হল জগৎসংসারের নিয়ম। আর সময় একই খাতে বয়ে চলে না। এটাও যেন জীবনের এক আশ্চর্য অঘোষিত নিয়ম। ঠিক তিন বছর পর প্রফুল্লমুখীর গতে বাঁধা জীবনে যেন দোলা লাগল। দেখা হল শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের চালিকাশক্তির সঙ্গে। মা সারদা দেবী। প্রফুল্লমুখীর তৃষিত প্রাণে যেন শান্তির পরশ লাগল। একটি আলো প্রবেশ করল যেন অন্তরে। আলোটি নিয়ে এল কয়েকটি বাক্য। মা সারদা দেবী প্রফুল্লকে দেখেই কাছে টেনে বললেন, ‘অত নিরাশ কেন মা! তুমি তো তুচ্ছ নও, ঠাকুর তোমাকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নেবেন।’ অতটা সত্যদ্রষ্টা ছিলেন জননী সারদা দেবী!
ঠিক ৫ বছরের মধ্যেই প্রফুল্লমুখীকে দেখা গেল ঢাকায় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সভায় যোগ দিতে। চরকা ও খদ্দরের প্রচারে ক্রমেই হয়ে উঠলেন অন্যতম প্রধান মুখ। মুন্সিগঞ্জে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে করলেন আইন অমান্য। হলেন গ্রেপ্তার। ৬ ঘণ্টা ধরে তাঁকে আটকে রাখা হল থানায়। আর এই ৬ ঘণ্টা তাঁকে পাল্টে দিল। মুক্তি পেয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লেন স্বাধীনতার যুদ্ধে। কখনও কুমিল্লা, কখনও চাঁদপুর, কখনও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। তাঁর কথা শুনতে মানুষ এবং নারীসমাজ আকুল। বিপদটা টের পেল ব্রিটিশ প্রশাসন। ১৯৩১ সালের ডিসেম্বর মাসে অর্ডিন্যান্স আইনে একমাস তাঁকে জেলে আটকে রাখা হল। আন্দোলন আর জেলযাত্রা যেন জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠল প্রফুল্লমুখীর। তাঁর একটাই শক্তি। মা সারদা দেবীর আশীর্বাদ। হিজলি থেকে বহরমপুর জেলে জেলে ঘোরানো হল এই অগ্নিকন্যাকে। এহেন বীরাঙ্গনা শেষ পর্যন্ত কী করলেন? নারীশক্তির জাগরণ, জনসেবা এবং ত্রাণকার্যে নিয়োজিত হওয়ার লক্ষ্যে একটি সংগঠন তৈরি করলেন। কী সেই সংগঠনের নাম? কুমিল্লার সেই সংগঠনের নাম ছিল, ‘সারদা দেবী মহিলা সমিতি’! বাংলার বরিশাল জেলার এক গ্রামে জন্ম নেওয়া সাধারণ কন্যার দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ প্রশাসনের ঘুম ছুটিয়ে দেওয়া তেজস্বিনী প্রফুল্লমুখী দেবীতে পরিণত হওয়ার চালিকাশক্তি ছিলেন মা সারদা দেবী।
যুগান্তর বিপ্লবী দলের তিন স্বাধীনতা সংগ্রামীর সন্ধান চলছে। তাঁরা পলাতক। কলকাতা পুলিস গোপন সূত্রে জেনে গেল, তিলজলা রেলওয়ে কেবিনের কর্মী দেবেন ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী সিন্ধুবালা দেবীর রেলওয়ে কোয়ার্টার্সে লুকিয়ে রয়েছেন এই তিন বিপ্লবী। অর্থাৎ, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা এই তিন ওয়ান্টেডকে জেনে শুনেই তবে দেবেনবাবু আর তাঁর স্ত্রী আশ্রয় দিয়েছেন? তিন বিপ্লবীর নাম অমর চট্টোপাধ্যায়, কুন্তল চক্রবর্তী ও ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত। ১৯১৭ সাল। গোপন সোর্স মারফত খবর পেলেও পুলিস শেষ পর্যন্ত যখন অভিযানে গেল ততক্ষণে তিনজনই আবার পালিয়েছেন।
পুলিস দেবেন ঘোষকে গ্রেপ্তার করল। দোষী তো তাঁর স্ত্রীও। কিন্তু তিনি কলকাতায় নেই। চলে গিয়েছেন বাঁকুড়ার ইন্দাসে। গ্রামের নাম যূথবিহার। খবর পাঠানো হল বাঁকুড়া পুলিসে যে, এই মহিলাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। পুলিস সুপার ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায় বিরাট ফোর্স নিয়ে অভিযানে গেলেন এক নারীকে গ্রেপ্তার করতে। সমস্যা হল, একজন নয়। দু’জন সিন্ধুবালা আছেন পাশাপাশি গ্রামে। একজন দেবেনবাবুর স্ত্রী এবং অন্যজন আবার তাঁরই বোন। কাকে গ্রেপ্তার করা হবে? কেউ মুখ খুলছে না কে কোনজন! অতএব দুজনকেই গ্রেপ্তার করা হল। একজনকে সাবাজপুর থেকে। অন্যজনকে যূথবিহার থেকে। শুধু গ্রেপ্তার নয়। সঙ্গে জিপ থাকা সত্ত্বেও দুই নারীকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে পুলিস স্টেশন পর্যন্ত আনা হয়। তারপর বাঁকুড়া জেলে বন্দি। গোটা ঘটনাটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, সিন্ধুবালা দেবী ছিলেন গর্ভবতী। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার জন্যই তিনি এসেছিলেন বাপের বাড়ি (ভিন্ন তথ্য অনুযায়ী স্ত্রী নয়, বোন ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা)। এরকম অবস্থায় সেই দুই নারীকে এভাবে হাঁটিয়ে নিয়ে আসায় বিপুল প্রতিবাদ হল।
এই সংবাদ যখন লোকমুখে প্রচারিত হয়ে জয়রামবাটিতেও পৌঁছয়, মা সারদা দেবী ঘটনাটি শুনে নিমেষের মধ্যে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়েন। সংবাদবাহককে তিনি বলেন, ‘বলো কী? এটা কি কোম্পানির আদেশ? না পুলিস সাহেবের কেরামতি? নিরপরাধ স্ত্রী লোকের উপর এত অত্যাচার মহারানি ভিক্টোরিয়ার সময় তো কই শুনিনি?’ সারদা মায়ের ক্রোধের সংবরণ হচ্ছে না। তাঁর নিজের শরীর তেমন সুস্থ নেই সেই সময়। তা সত্ত্বেও তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন এই দমন পীড়ন। আরও বললেন, ‘এই যদি কোম্পানির আদেশ হয়, তো, আর বেশি দিন নয়। এমন কোনও বেটাছেলে কি সেখানে ছিল না, যে দু’চড় দিয়ে মেয়ে দু’টিকে ছাড়িয়ে আনতে পারে?’ কিছু পরে যখন আবার সংবাদ এল যে, মহিলারা মুক্তি পেয়েছেন, তখন সারদা দেবী যেন স্বস্তি পেলেন। তিনি শান্ত হলেন। বললেন, ‘এই খবর যদি না পেতুম, তবে আজ আর ঘুমুতে পারতুম না।’
মাউজার কোম্পানির মাত্র ৫০টি পিস্তল বাংলার শক্তিশালী ব্রিটিশ প্রশাসনকে তটস্থ করে তুলেছিল। এতটাই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে ব্রিটিশ পুলিস যে, মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্টে পৃথক একটি ফাইল খোলা হয় শুধু সেই মাউজার পিস্তলের সাপ্লাই লাইন নিয়ে। এই অস্ত্র জোগানে অন্যতম ভূমিকা কে নিয়েছিলেন? যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁর স্বপ্ন ছিল বার্লিন থেকে বাটাভিয়া হয়ে কলকাতা পর্যন্ত একটি সংগঠনের নেটওয়ার্ক তৈরি হবে। যতীন্দ্রনাথের সহযোগী সঙ্গী ছিলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, অতুল ঘোষ, ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়, যদুগোপাল মুখোপাধ্যায়। জার্মান সহযোগিতায় ব্রিটিশদের হারাতে হবে। এই ছিল প্ল্যান। জার্মান প্রতিনিধিদের সঙ্গে গোপন আলোচনার জন্য ব্যাংকক গেলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। অবশ্য ছদ্মবেশে। এবং ছদ্মনামে। তাঁর নাম হল সি মার্টিন। প্ল্যান হল, মেভারিক নামের একটি জাহাজে রাইফেল, কার্তুজ আর ২ লক্ষ টাকা আসবে সুন্দরবনের রায়মঙ্গলে। তবে একটি স্থানে নয়। ভিন্ন ভিন্ন লোকেশনে নামানো হবে ওই বিপুল সাপ্লাই। তিনটি স্থান হবে নোয়াখালি, কলকাতা ও বালেশ্বর। যতীন্দ্রনাথের পরিকল্পনা নিখুঁত।
কিন্তু কলকাতা পুলিস জেনে যায় সেই প্ল্যান। সেটা যতীন্দ্রনাথ জানতে পারেননি। তিনি জানেন, বিক্ষিপ্তভাবে আক্রমণ করে শুধু ব্রিটিশকে হারানো যাবে না। তাই তিনি করেছিলেন এক বৃহত্তর প্ল্যান। সরাসরি গেরিলা যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া। অসম সাহসী যতীন্দ্রনাথ, চিত্তপ্রিয় রায়, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, নীরেন্দ্র দাশগুপ্ত ও জ্যোতিষ পাল অপেক্ষা করছেন বালেশ্বরে বুড়িবালাম নদীর কাছে একটা ক্যানাল তৈরি করে। অনেকটা ট্রেঞ্চের মতো। অপেক্ষা জাহাজ আসার। কিন্তু জাহাজ নয়। এলেন ব্রিটিশ পুলিস অফিসার চার্লস টেগার্ট। সঙ্গে বাহিনী। ১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বর। শুরু হল এক মরণপণ যুদ্ধ। প্রাণপণ যুদ্ধের পর যতীন্দ্রনাথ প্রাণ দিয়েছিলেন। বাঘা যতীন। সঙ্গীদের কারও ফাঁসি হল। কেউ গেলেন যাবজ্জীবন কারাবাসে। সেই বীরগাথা আমাদের জানা।
কিন্তু এই কাহিনির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আর একটি উজ্জ্বল মুহূর্ত। কলকাতা পুলিস যাঁকে বহুদিন ধরে খুঁজছে, সেই পলাতক যতীন্দ্রনাথ ১৯১৫ সালেরই কোনও একটি সময় যখন বালেশ্বর যাচ্ছিলেন, ট্রেনের কামরায় নিজেকে আত্মগোপন রাখা অবস্থাতেই হঠাৎ জানতে পারলেন, এই ট্রেনেই রয়েছেন সঙ্ঘজননী মাতাঠাকুরানি। শ্রীমা সারদা দেবী। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় ত্যাগ করে, বিপদের সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করে শুধু একবার দর্শনের জন্য বাঘা যতীন বাগনান স্টেশনে ছুটে গেলেন নির্দিষ্ট কামরার দিকে এবং দেখা করে আশীর্বাদ নিলেন সারদা দেবীর। সেই সামান্য সাক্ষাৎ সম্পর্কে এক ভক্ত জানতে চাইলেন, কী কথা হল? কেমন দেখলেন? সারদা মা শুধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘যেন দেখলুম, আগুন!’ সারদা দেবীর আগুন চিনতে কখনও ভুল হয়নি। জানা যায়, বাঘা যতীনের কাছে শ্রীমা সারদা দেবীর আশীর্বাদ ছিল অন্যতম এক অনুপ্রেরণা।
শ্রীরামকৃষ্ণ একবার সারদা দেবীকে প্রশ্ন করেন, ‘তুমি কি কিছুই করবে না? সব কি এই করবে (নিজেকে দেখিয়ে)।’ উত্তরে সারদা মা বলেছিলেন, ‘আমি মেয়ে মানুষ, আমি কী করব?’ কিন্তু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সেকথা মেনে নেননি। বলেছিলেন, ‘তোমাকে ঢের বেশি করতে হবে...শুধু কি আমারই দায়? তোমারও দায়...।’ রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠান হওয়ার পর তাই স্বামীজি গুরুভ্রাতাদের বলেছিলেন, ‘শ্রীশ্রী মাকে কি রামকৃষ্ণদেবের সহধর্মিণী বলে আমাদের গুরুপত্নী হিসাবে মনে করো? তিনি শুধু তা নয় ভাই, আমাদের এই যে সঙ্ঘ হতে চলেছে, তিনি তার রক্ষাকর্ত্রী, পালনকারিণী, তিনি আমাদের সঙ্ঘজননী।’
রামকৃষ্ণ মিশন যে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের একটি ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে সেটা নিয়ে ব্রিটিশ প্রশাসনের কোনও সন্দেহ নেই। লর্ড কারমাইকেল তাঁর দরবার ভাষণে সরাসরি এই অভিযোগ করে বলেছিলেন, এই সঙ্ঘের কার্যকলাপের দিকে আমাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। এসব তাদের ছাড়তে হবে। হঠাৎ কারমাইকেলের এই ক্রোধের কারণ কী? কারণ হল, রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সন্ন্যাসীদের একাংশ পূর্বজীবনে সরাসরি যুক্ত ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। স্বাভাবিকভাবেই একটা সময় এল গৃহী ভক্তরা নিজেদের সঙ্গে সঙ্ঘের দূরত্ব বজায় রাখতে চাইলেন। তাঁদের দাবি, এভাবে আমাদের উপরও রাজরোষ নেমে আসবে। তার থেকে যে সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারীবৃন্দ বিপ্লবাত্মক কাজে যুক্ত ছিলেন কিংবা এখনও গোপনে আছেন, তাঁদের সঙ্ঘ থেকে বহিষ্কার করা হোক। স্বামী সারদানন্দ এই দাবির কথা এসে শোনালেন শ্রীমা সারদা দেবীকে। তিনি মায়ের মতামত জানতে চান। সারদা দেবী কথাটা শুনেই বললেন, ‘ওমা, এ সব কি কথা! ঠাকুর সত্যস্বরূপ! যেসব ছেলে তাঁকে আশ্রয় করে, তাঁর ভাব নিয়ে সংসার ত্যাগ করে গেরুয়া পরে সন্ন্যাসী হয়েছে, দেশের দশের আর্তের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছে, সংসাদের ভোগসুখ জলাঞ্জলি দিয়েছে, তারা মিথ্যা ভান কেন করবে বাবা? তুমি একবার লাটসাহেবের সঙ্গে দেখা করো, তিনি রাজপ্রতিনিধি, তোমাদের সমস্ত কার্যধারা তাঁকে বুঝিয়ে বললে তিনি নিশ্চয়ই শুনবেন।’ সারদা দেবী এরপর দৃপ্ত কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন, ‘ঠাকুরের নামে যারা সন্ন্যাসী, তারা মঠে থাকবে, নয়তো কেউ থাকবে না। আমার ছেলেরা গাছতলায় আশ্রয় নেবে, তবু সত্যভঙ্গ করবে না।’ শ্রীমায়ের এই অবস্থান ও পরামর্শ জেনে স্বামী সারদানন্দ গেলেন লর্ড কারমাইকেলের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁকে দীর্ঘক্ষণ ধরে বোঝালেন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের লক্ষ্য, নীতি, আদর্শ। শেষ পর্যন্ত স্বয়ং সেই লর্ড কারমাইকেল নিজের ভুল স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করেন।
সেবাকার্য থেকে নিরস্ত থাকলে চলবে না। স্বদেশি করার অর্থ এই নয় যে, ঠাকুরের প্রদর্শিত পথ, লোকশিক্ষা, আর্ত জনতার সেবা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে শুধুই স্বদেশির নেশায় নিজেকে জড়িয়ে রাখলাম। শ্রীমা কোয়ালপাড়া আশ্রমে লক্ষ করলেন জপ তপ ধ্যান পুজো, পাঠ, মানুষের সেবাকার্যের তুলনায় যেন স্বদেশি নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে। বেশি আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে। সারদা মা আশ্রমের অধ্যক্ষ স্বামী কেশবানন্দজিকে বললেন, ‘শুধু স্বদেশি করে কী হবে? আমাদের যা কিছু, সবের মূলে ঠাকুর, তিনিই আদর্শ। যা কিছু কর না কেন, তাঁকে ধরে থাকলে কোনও বেচাল হবে না।’ স্বামী কেশবানন্দ একটু ভয়ে ভয়েই শ্রীমাকে বললেন, ‘স্বামীজি তো দেশের কাজ করতে খুব বলেছেন এবং দেশের যুবকদের উৎসাহিত করে নিষ্কাম কর্মের পত্তন করেছেন। তিনি আজ বেঁচে থাকলে কত কাজই না হতো।’ ব্যস! এই একটি মানুষের নাম উচ্চারিত হলে শ্রীমায়ের অন্তঃকরণ ভেসে যায় স্নেহ ও ভালোবাসায়। তিনি তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, ‘ও বাবা, নরেন আমার আজ থাকলে কোম্পানি কি তাকে ছেড়ে দিত? জেলে পুরে রাখত। আমি তা দেখতে পারতুম না। নরেন যেন খাপখোলা তরোয়াল।’
স্বদেশি হোক অথবা জনসেবা। শ্রীমা চাইতেন, যে আদর্শই সামনে রেখে অগ্রসর হবে সেটার মধ্যে যেন প্রকৃত কাজ মিশে থাকে। শুধুই যেন অন্তঃসারশূন্য আলোচনা নয়। তাই তিনি মঠের সন্ন্যাসী ও ভক্তদের বলেছিলেন, ‘দেখো, তোমরা বন্দেমাতরম করে হুজুগ করে বেড়িও না। তাঁত করো, কাপড় তৈরি করো। আমার ইচ্ছা হয়, আমি একটা চরকা পেলে সুতো কাটি। তোমরা কাজ করো।’
রাসবিহারী মহারাজের কাছে আম দিয়েছেন স্বামী সারদানন্দ। শ্রীমায়ের কাছে পৌঁছে দিতে। কোয়ালপাড়ায়। ভক্ত প্রবোধবাবু শ্রীমাকে প্রণাম করতে এলেন। তাঁর সঙ্গে কুশল প্রশ্নাদির পর, মা জানতে চাইলেন, ‘হ্যাঁ গো যুদ্ধের কী খবর? (তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল)। কী লোকক্ষয়টাই না হল! কী মানুষমারা কলই না বের করেছে। আজকাল কতরকম যন্ত্রপাতি। টেলিগ্রাফ ইত্যাদি। এই দেখ না রাসবিহারী কাল কলকাতা থেকে রওনা হয়ে আজ এখানে পৌঁছে গেল। আমরা তখন কত হেঁটে, কত কষ্ট করে দক্ষিণেশ্বর গেছি।’ প্রবোধবাবু বললেন, ‘ইংরেজ সরকার আমাদের দেশের অনেক সুখস্বাচ্ছন্দ্য বাড়িয়েছে।’ শ্রীমা সারদা দেবী প্রাথমিকভাবে সায় দিয়েও বললেন, ‘কিন্তু বাবা, ওই সব সুবিধা হলেও আমাদের দেশে অন্নবস্ত্রের অভাব বড় বেড়েছে। আগে এত অন্নকষ্ট ছিল না।’ স্পষ্টভাবেই সারদা মা ব্রিটিশ শাসনকালের প্রজাদের নিত্যদিনের জীবনযাপনের সঙ্কট নিয়ে যে ক্ষুব্ধ ছিলেন, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন বারংবার।
কোয়ালপাড়া আশ্রমে এক তরুণ এসে হাজির হঠাৎ। সে দীক্ষা নেবে। কিন্তু আশ্রমের কয়েকজন ভক্ত জানাল, তরুণটি সম্ভবত বিপ্লবাত্মক কাজে যুক্ত। কারণ খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, তার উপর পুলিসের নজর আছে। এদিকে কোয়ালপাড়া আশ্রমে শ্রীমায়ের কাছে যে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়া যুবকদের আনাগোনা আছে এটাও স্থানীয় পুলিস জানে। এমনকী একজন গোয়েন্দা পুলিসকে দায়িত্ব দেওয়া আছে, শুধুই শ্রীমায়ের উপস্থিতিতে কারা আসা-যাওয়া করছে, সেটা যেন ২৪ ঘণ্টাই সে নজরে রাখে। এমতাবস্থায় এই তরুণকে কীভাবে প্রবেশাধিকার দেওয়া যায়? সকলেই চিন্তিত এবং শ্রীমায়ের অনুমতির অপেক্ষায়। সারদা মা বললেন, ‘আহা, ছেলেটি কত কষ্ট পেয়ে ব্যাকুল হয়ে এসেছে।’ আশ্রমের সন্ন্যাসীকে বললেন, ‘তুমি যদি আজ রাত্রিটা গ্রামের কোনও লোকের বাড়িতে তাকে রাখবার ব্যবস্থা করতে পার, তবে কাল সকালে আমি ওকে দীক্ষা দিয়ে চলে যেতে বলব।’ বোঝা গেল, শ্রীমা তরুণকে কোনও একটা নিরাপদ স্থানে আজকের রাতটা গোপনে লুকিয়ে রাখতে বলছেন। পরদিন সকালে একটি পুকুরের থেকে জল নিয়ে দ্রুত সব ব্যবস্থা করতে বললেন। আসন পাওয়া যাচ্ছে না। মা বললেন, ‘দুটো খড় দাও। আমরা সেখানে বসি।’ সেভাবেই হল দীক্ষা!
দিশাহারা হয়ে গেলেন মৃণালিনী দেবী। কিছুদিন ধরেই পুলিস খুঁজছিল তাঁর স্বামীকে। এর আগেও একাধিকবার তাঁকে দেশদ্রোহিতার কারণে গ্রেপ্তারের চেষ্টা হয়েছে। এবার অভিযোগ গুরুতর। সরাসরি বোমা সাপ্লাই করা এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অপরাধ। ১৯০৮ সালের ২ মে গ্রেপ্তার করা হল মৃণালিনী দেবীর স্বামীকে। স্বামীর নাম অরবিন্দ ঘোষ। যদিও অরবিন্দ ঘোষের পক্ষে যে আইনজীবী আদালতে লড়াই করছেন তাঁর উপর সকলের ভরসা আছে। তাঁর বাগ্মিতায় এমনকী ব্রিটিশ সরকারের হয়ে শুনানি করা পাবলিক প্রসিকিউটর কিংবা বিচারপতিরাও মুগ্ধ। আশা করা যায়, এই আইনজীবী জয়ী হয়ে অরবিন্দ ঘোষকে মুক্ত করবেন। আইনজীবীর নাম চিত্তরঞ্জন দাশ। কিন্তু তা সত্ত্বেও মৃণালিনী দেবীর মন মানছে না। তিনি ভাবছেন, তাঁর সঙ্গছিন্ন হওয়া আমার মৃত্যুই একমাত্র পথ। অরবিন্দ ঘোষের সহকর্মী দেবব্রত বসুর বোন সুধীরা মৃণালিনী দেবীকে নিয়ে গেলেন বাগবাজারে। শ্রীমা সারদা দেবীর কাছে। শান্ত সমাহিত মূর্তির সারদা মায়ের কাছে গিয়েই যেন অনেকটা স্বস্তি হল। সারদা দেবী বললেন, ‘চঞ্চল হও না মা। চাঞ্চল্যে কোনও লাভ নেই। তোমার স্বামী শ্রী ভগবানের পূর্ণ আশ্রিত পুরুষ। ঠাকুরের আশীর্বাদে তিনি নিষ্পাপ প্রমাণে সত্বর মুক্ত হয়ে ফিরে আসবেন।’ মুক্তির পর বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ বাগবাজারে শ্রীমা সারদা দেবীর দর্শনে এলেন। প্রণাম করলেন যেন জগজ্জননীকে। শ্রীমা সারদা দেবীর শক্তির কথা পরবর্তীকালে একাধিকবার উল্লেখ করেছেন অধ্যাত্মপথে চলে যাওয়া শ্রীঅরবিন্দ। আর সারদা দেবী তাঁকে দেখে বলেছিলেন, ‘এইটুকু মানুষ, এঁকেই গভর্নমেন্টের এত ভয়? এ হল আমার বীর ছেলে!’ দেশে বস্ত্রাভাব। নারীরা সামান্য কটিবস্ত্রের অভাবে লজ্জা নিবারণ করতে পারছে না। আত্মহত্যার সংবাদ আসছে চতুর্দিক থেকে। একদিন এই মর্মান্তিক অবস্থা আর সহ্য করতে না পেরে শ্রীমা সারদা দেবী কেঁদে উঠলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘ওরা (ব্রিটিশ সরকার) কবে যাবে গো! ওরা কবে যাবে! তখন ঘরে ঘরে চরকা ছিল, ক্ষেতে কাপাস চাষ হতো, সকলেই সুতো কাটত, নিজেদের কাপড় নিজেরাই করিয়ে নিত, কাপড়ের অভাব ছিল না। কোম্পানি এসে সব নষ্ট করে দিল।’
দেশমাতৃকাকে স্বাধীনতা এনে দেওয়ার ব্রতী অসংখ্য বীর প্রাণ কেন বারংবার ছুটে এসেছেন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে, বাগবাজারে, কোয়ালপাড়ায়, জয়রামবাটিতে? মায়ের আশীর্বাদ নিতে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের আদর্শকে ধারণ করতে আর স্বামীজির কর্মযোগকে অন্তরে স্থাপন করতে। ঠাকুর আর স্বামীজি স্থূল শরীরে নেই। এই ত্রিশক্তির প্রতিনিধি হয়ে জ্ঞান ও চেতনার আলো অন্তরে ধারণ করে রয়েছেন শ্রীমা সারদা দেবী একমাত্র। তাই বিপ্লবীরা ছুটে আসতেন মায়ের কাছে।
স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন সত্যদ্রষ্টা! ১৮৯৪ সালে স্বামী শিবানন্দকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, ‘মা ঠাকরুন কি বস্তু বুঝতে পারনি, এখনও কেহই পার না, ক্রমে পারবে। ভায়া, শক্তি বিনা জগতের উদ্ধার হবে না।’
শ্রীমা সারদা দেবী— স্বামী গম্ভীরানন্দ
শ্রী শ্রী মায়ের কথা— উদ্বোধন কার্যালয়
জন্মজন্মান্তরের মা— সম্পাদনা, প্রব্রাজিকা বেদান্তপ্রাণা
স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী— কমলা দাশগুপ্ত