কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। উকিল, মৃৎশিল্পীদের শুভ। সংক্রমণ থেকে শারীরিক অসুস্থতা হতে পারে। আর্থিক ... বিশদ
বাঁশবাদির আটপৌরে আর কাহাররা সেই কোন আমলে ছিল পালকিবাহক। সাহেবদের সেইসব দিন ক্রমে অস্ত যাওয়ার পথে। তারও বহু আগে বাঁশবাদির মানুষদের পালকিবাহকের জীবিকা শেষ হয়ে যায়। আখ্যানের কাহাররা সাহেবদের আমলে তৈরি হওয়া সামন্ততন্ত্রের প্রতীক চৌধুরী, ঘোষ, মণ্ডলদের জমি চাষ করে, ফাইফরমাইশ খাটে। আখ্যান বদলে যায় পৃথিবীর চেনা পরিচিত ভৃত্য ও বাবুদের শোষণ ও শাসনের বৃত্ত থেকে অনেকটাই। কারণ, সেই বৃত্তে যুগপরম্পরায় বাসা বেঁধেছে কাহারদের ধর্মবিশ্বাস। যে ধর্মবিশ্বাসের মূলে কাহার পাড়ার বটবৃক্ষে বসবাসকারী তাদের দেবতা কত্তাবাবা, তার বাহন, কালারুদ্র।
ধর্মবিশ্বাসের কারণেই কাহার পাড়ার মাতব্বর বনওয়ারি নিজের প্রাপ্য কেরাচিনি, ম্যালেরিয়ার ওষুধ কুইনাইন বাবুদের কাছ থেকে না পেলেও এই না পাওয়াকেই কত্তাবাবার বিধান মনে করে। কাহার পাড়ায় সমস্ত পুরনো ধ্যানধারণা ও নিয়মের বিরুদ্ধে মানুষের অধিকারে বাঁচার দাবিতেই যেন জন্ম নিয়েছিল নতুন যুগের কাহারসন্তান করালী।
হাঁসুলি বাঁকের এই জীবন আলেখ্য কেবল করালী আর বনওয়ারির দ্বন্দ্ব নয়, এর সীমানা বাঁশবাদির মাটি আর কোপাইয়ের ধারে চন্ননপুরের রেলইস্টিশানের কারখানাও নয়। এ যেন রূপকথার মধ্যে দিয়ে ক্রমে বিলুপ্তির দিকে যাওয়া এক উপকথা। যেখানে বনওয়ারি বাবুদের অন্যায় অন্যায্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখ না খুলে আধপেটা খেয়ে অথবা না খেয়েও বাবুদের জমিতে চাষের কাজ ছেড়ে কারখানায় কাজ করতে যাওয়ার বিরুদ্ধে বিধান দেয়। করালী এর উল্টোপথে হাঁটতে প্রলুব্ধ করে অর্ধভুক্ত, অভুক্ত, সাপের কামড়ে অথবা ম্যালেরিয়ায় ওষুধবিহীন অকালমৃত্যুর কবলে আক্রান্ত কাহারদের।
চাষ বনাম শিল্পের দ্বন্দ্ব ফুটে ওঠে সমস্ত আখ্যান জুড়ে। বিশ্বযুদ্ধে ও তার প্রভাবে বাংলায় ধানের অস্বাভাবিক হারে মূল্যবৃদ্ধি, সমস্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জোগান কমে আসা এবং কেবল এক শ্রেণির একতরফা ধন সঞ্চয়— এই সমস্তই উপকথার ভেতরে গ্রথিত।
মার্কসীয় দার্শনিক গ্রামসি বলেছিলেন, ‘শোষণের বাস্তবতা বুঝতে গেলে গ্রামদেশের অন্ত্যজ মানুষের কথা জানতে হবে।’ তারাশঙ্কর সেই পথেই হেঁটেছেন। তাঁর নিজের স্মৃতিকথা ‘আমার কালের কথা’-তে তিনি লিখেছেন, ‘এমনি দ্বন্দ্বের সমারোহে সমৃদ্ধ লাভপুরের মৃত্তিকায় আমি জন্মেছি। সামন্ততন্ত্র বা জমিদারতন্ত্রের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দ্বন্দ্ব আমি দু’চোখ ভরে দেখেছি। সে দ্বন্দ্বের ধাক্কা খেয়েছি। আমরাও ছিলাম ক্ষুদ্র জমিদার। সে দ্বন্দ্বে আমাদেরও অংশ ছিল।’
মনে পড়ে যায় ‘জলসাঘর’ গল্পে ঝাড়বাতির প্রায় নিভে যাওয়া আলোয় অধুনাবিত্তহীন জমিদার বিশ্বম্ভর রায়, তাঁর পূর্বপুরুষদের প্রমোদ বিলাসে মত্ত প্রতিকৃতির দিকে তাকিয়ে নিজের প্রতিবিম্বই দেখতে পায় ও সেই মোহের প্রতিকৃতি দেখতে দেখতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
তবে, কেবল শোষণ আর দারিদ্র্যের আখ্যান বললেই তাঁর মহাসৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করা যায় না। দারিদ্র্যের মধ্যেও জীবনের যে অনিবার্য জটিল অথচ অদ্ভুত সুন্দর এক রস রয়েছে, সেই রসের ভিয়েন যেন তাঁর প্রতিটা লেখায়। প্রেম, ভালোবাসা, ঈর্ষা, স্নেহ, মায়া এইসব প্রবৃত্তিই এক অদ্ভুত দক্ষতায় জুড়েছেন তাঁর প্রতিটা কাহিনির ছত্রে ছত্রে। এই সমস্ত প্রবৃত্তিকেই যেন মনে হয় মানুষের জীবনের এক অমোঘ নিয়তি।
তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্প সংকলনের ভূমিকায় অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘তারাশঙ্করের আরাধ্যা জীবনের বিভীষণা নগ্নিকা কালিকামূর্তি।’ জীবনের নানা বাঁকে ‘নগ্নিকা কালিকামূর্তি’র মতো একদিকে যেমন ভয়, বীভৎসতা, আরেকদিকে এক অদ্ভুত প্রশান্তি বিরাজ করে চলেছে। এই দুই রসের অপরূপ মেলবন্ধন তাঁর উপন্যাসে ও ছোটগল্পে সুনিপুণভাবে বিস্তৃত।
‘ডাকহরকরা’ গল্পে ডাকহরকরার জীবনে কখনও পোস্ট অফিসে পৌঁছতে দেরি হয়নি, কেবল যেবার ওর ছেলে সমস্ত ডাকের টাকাপয়সা ডাকাতি করতে এল সেবারই ছেলের হাতে আহত হয়ে ওর দেরি হয়ে গেল। জীবন তবুও একইরকমভাবে বয়ে যাচ্ছিল ডাকহরকরার। সে চলা যদিও গল্পে থামেনি, কেবল পাঠককে স্তব্ধ করে দিয়েছে তার ছেলের মৃত্যু সংবাদ যখন সে নিজেই নিজের জন্য ডাকে বহন করে নিয়ে আসল।
‘বেদেনী’ ও ‘ডাইনী’ এই দুই গল্পে কুসংস্কার আর সেই সংস্কারের জাঁতায় নারীমনের চিরযন্ত্রণা লিপিবদ্ধ। ‘বেদেনী’ বরং নিজের স্বাধীনসত্তার বিকাশ ঘটাতে অনেক বেশি সক্ষম। যদিও তার পরিণতি ভয়ঙ্কর। ‘ডাইনি’ তার যুগসংস্কারকে অভিশাপের মতো আঁকড়ে ধরে থেকেও কেবলই মুক্তি চাইত এই ডাইনি জীবন থেকে। অথচ মানুষ হওয়ার পথে বাধা তার নিজেরই সংস্কার। আবার ‘তারিণী মাঝি’ গল্পেও এক করুণ অমোঘ নিয়তি। সুখী তারিণীকে আঁকড়ে ধরে বাঁচত। তাই জলে ডুবে যাওয়ার সময় মরণকালেও তারিণীকেই আঁকড়ে রইল। তারিণীও সমস্ত গল্প জুড়ে একা। কেবল স্ত্রী সুখীকে জড়িয়েই তার বেঁচে থাকা। জলে ডুবে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে সুখীর সেই জড়ানো বাহুবন্ধন থেকে ও মুক্ত হতে চেষ্টা করে। ভুলে যায়, ক্ষণিক আগে সে নিজেই সুখীকে আশ্বাস দিয়েছিল, ওকে শক্ত করে ধরে থাকলে ওরা দু’জনেই এই নদী পারাপার করতে পারবে। বেঁচে থাকার তাগিদেই কি তারিণী সুখীকে গলা টিপে হত্যা করে? আর এই যে বীভৎসতা এর মধ্যেও কি বেঁচে থাকার রসদ নেই? সেই রসদের সন্ধানও তো পাই তাঁর লেখাতেই।
‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’-তে সেই সুন্দর অথচ ভয়ঙ্কর এক যন্ত্রণার আখ্যান ছড়িয়ে হিজল বিলের সাঁওতালি পাড়ায়। যেখানে চাঁদসদাগরের আমলের বিষবৈদ্যরা চাঁদের অভিশাপে বিষবেদেতে পরিণত হয় আর সেই মিথ সংস্কারকে জড়িয়ে শবলা, পিঙলা-র মতো নাগিনীকন্যার উপাখ্যান রচিত হয়। এ তো সেই দ্বন্দ্ব, সংস্কার আর জীবনের আশ্চর্য মেলবন্ধন!
জীবনের সর্বত্রই কোথাও না কোথাও আদিম মহাপ্রকৃতি সমস্ত আধুনিকতার মধ্যে, সমস্ত একমুখী ভাবনাকে বহুমুখী করতে নানা বৈপরীত্যে বিচিত্রতায় বারেবারে মানুষের সামনে এসে দাঁড়ায়। সে কথাই যেন তাঁর ‘রাধা’ উপন্যাসে মহাকালীর ধ্যানমন্ত্রে পাই। ‘বিপরীত রতাতুরং সুখ প্রসন্ন বদনাং স্মেরানন স্মরারুহাং’ অনার্য সংস্কৃতির সংস্কার ও লোককথাকে তিনি কুসংস্কার বলেননি। বরং তাঁর দৃপ্ত ঘোষণা, আর্যদের আখ্যান যেমন পুরাণ ও মহাকাব্যে স্থান পেয়েছে, অনার্যদের লোককাহিনিও তেমনি এক মহাকাব্যই। ‘গণদেবতা’, ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘আরোগ্যনিকেতন’, ‘বিষপাথর’, ‘কালিন্দী’ ইত্যাদি নানা রচনায় সেই আখ্যানেরই সাক্ষাৎ পাই। তারাশঙ্করের লেখা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, প্রতিটা লোককথাই পারে মহাকাব্যের জন্ম দিতে। অমর কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতপক্ষেই এক মেধাবী লোকসংস্কৃতি গবেষক।
ছবি: জ্ঞানপীঠ পাওয়ার পর তারাশঙ্কর।