কর্মে ও ব্যবসায়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য। কৃষিপন্ন বিক্রেতা ও ডাক্তারদের অর্থকড়ি প্রাপ্তি হবে সর্বাধিক। বন্ধুকে টাকা ... বিশদ
সোভিয়েত অঙ্গরাজ্যগুলির মধ্যে লিথুয়ানিয়া প্রথমে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এবং সেটা ১৯৯০ সালেই। ১৯৯১-এর জানুয়ারিতে লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির বিশেষ কম্যান্ডো পাঠানো হয়। সেখানকার টেলিভিশন টাওয়ারে কেজিবির অভিযানে ১৪ জন মানুষ প্রাণ হারান। তা সত্ত্বেও লিথুয়ানিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ফেরানো যায়নি। সোভিয়েতের পতন অবশ্যই একটি যুগের অন্ত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগনের কথায়, ‘ইভিল এম্পায়ার’ (শয়তানের সাম্রাজ্য)-এর পতন, সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলেন।
রেগনের কাছে সোভিয়েত মানেই ছিল ‘শয়তানের সাম্রাজ্য’। কমিউনিস্টদের ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি ছিল ‘দেতঁত’, অর্থাৎ প্রতিপক্ষের সঙ্গে চলনসই সম্পর্ক। রেগন বলেছিলেন, ‘রোলব্যাক’ অর্থাৎ প্রতিপক্ষের উপর প্রবল চাপসৃষ্টি। লাভ হয়েছিল। ‘স্ট্র্যাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভ’ সম্পর্কে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট গর্বাচভের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জেরাসিমভের মন্তব্য, ‘খুব সফল ব্ল্যাকমেল। এমন প্রতিযোগিতায় দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল না সোভিয়েত অর্থনীতির।’
গত শতাব্দীর আটের দশকের কথা।
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ সম্পর্কে ঠাট্টা চালু ছিল, ‘ইউ ডাই উই ফ্লাই’। রোনাল্ড রেগনের সহকারী হিসেবে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্যে হাজির থাকতেন বুশ। ওই সময়ে তিন সোভিয়েত নেতার মৃত্যুর পর রাশিয়া পৌঁছন তিনি। নেহাতই আনুষ্ঠানিক। তবে ভিত গড়ার কাজ শুরু সেখানেই। ‘শত্রু’ সোভিয়েত শিবিরে ধস নামল যখন, বুশ সেই সময়ে নিজেই প্রেসিডেন্ট। ভেঙে পড়ল বার্লিন প্রাচীর, পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত সাধারণতন্ত্র, অবশেষে আস্ত ইউনিয়নটাই। এই পর্বে শেষ সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচভের সঙ্গে বুশের বন্ধুত্বের ভূমিকাটি জরুরি।
১৯৮৯-এর ডিসেম্বর মাসে সোভিয়েত ক্রুজ ‘ম্যাক্সিম গোর্কি’-তে মুখোমুখি হয়েছিলেন বুশ-গর্বাচভ। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রেন্ট স্কোক্রফ্টের মত ছিল না বৈঠকে। তিনি বলেছিলেন ‘প্রিম্যাচিয়োর’। তবু ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরঁ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার ও মার্কিন কংগ্রেসের কিছু সদস্যের কথায় গর্বাচভের সঙ্গে দেখা করলেন বুশ। চুক্তি সই হল না, কিন্তু গর্বাচভ জানিয়ে দিলেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আমি আশ্বাস দিয়েছি, সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের বিরুদ্ধে আর উষ্ণ যুদ্ধ শুরু করবে না।’ এই আশ্বাসকে সঙ্গী করেই শেষ হয়ে যায় ঠান্ডা যুদ্ধ। ‘অর্ধশতকের অবিশ্বাস মুছে ফেলতে এই পদক্ষেপ দরকার ছিল,’ বলেছিলেন বুশ।
ইতিহাস সাক্ষী, ১৯৮৫ সালের মার্চে মিখাইল গর্বাচভ যখন দায়িত্ব নেন, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিতরে, বা বাইরে কেউ কল্পনা করতে পারেননি যে, ছ’বছরের মধ্যেই বিশাল রাষ্ট্র বিলুপ্ত হবে। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ধীরে ধীরে বাড়ছিল। এতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতি অপ্রত্যাশিতভাবে চাঙা হয়ে ওঠে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের বৈদেশিক মুদ্রার ৮০ শতাংশ আয় হয় তেল রপ্তানি থেকে। তেলের দাম বাড়ার ফলে তেল রপ্তানিকারক আরব দেশগুলোর প্রচুর লাভ হয়, সেই লাভের টাকায় তারা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কেনা বাড়িয়ে দেয়। এই সুবাদে সোভিয়েত ইউনিয়নও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আমেরিকার সমকক্ষ হয়ে ওঠে। গর্বাচভের দুর্ভাগ্য, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর তেলের দাম আবার কমতে শুরু করে। ১৯৮৬ সালে কমে যায় ৬৯ শতাংশ। তেল কেনাবেচার মুদ্রা মার্কিন ডলারের দামও পড়ে যায়। এর মধ্যে ওই বছরই ঘটে চেরনোবিল দুর্ঘটনা, যার অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বিপুল।
অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের শিল্পকারখানাগুলো সেকেলে ও জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। বিশেষত বিশালাকার যেসব শিল্প তিনের দশকে গড়ে তোলা হয়েছিল। ফলে সেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ভীষণভাবে কমে গিয়েছিল। এ রকম অবস্থায় গর্বাচভ দেখলেন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাওয়ার মতো অর্থনৈতিক সাধ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের আর নেই। এবার থামাতে হবে। তাঁর বিদেশনীতির গোড়ার কথা ছিল এটাই। এ জন্য তাঁকে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নিতে হয়েছে। সেটা আন্তরিকভাবে করতে গিয়ে তিনি যে, শেষ পর্যন্ত ধোঁকা খেয়েছেন, তা সেই সময় বুঝতে পারেননি। বুঝেছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার অনেক বছর পর। এখন তিনি বলেন, ‘আনি আবমানুলি নাস’। যার অর্থ, ‘ওরা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।’
গর্বাচভ জমানায় যে কমিউনিস্ট পার্টি কার্যত সবকিছু চালাত, তার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিল এককেন্দ্রিক। পার্টির ভিতরে গণতান্ত্রিক চর্চা ছিল না। ব্যাপক ও বিস্তৃত দুর্নীতি পার্টির জন্য হয়ে উঠেছিল একটা দুরারোগ্য ব্যাধি। পার্টির নেতাদের অধিকাংশই জনগণ থেকে একদম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। সেই অবস্থার সঙ্গে আমাদের এ রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারের অন্তিম লগ্নের অনেকটাই মিল খুঁজে পাবেন।
গর্বাচভ অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়নের উপযোগী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অভাব দূর করতে চেয়েছিলেন রাজনৈতিক সংস্কারের (পেরেস্ত্রোইকা) মাধ্যমে। সে জন্য তিনি এসে বললেন, পার্টির মধ্যে গণতন্ত্র দরকার। গণতন্ত্রের চর্চা হলেই সমাজতন্ত্র আরও বিকশিত হবে। তাঁর পেরেস্ত্রোইকার প্রথম স্লোগান ছিল, ‘আরও গণতন্ত্র, আরও সমাজতন্ত্র’। তিনি পেরেস্ত্রোইকার আগে শুরু করেন ‘গ্লাসনস্ত’ (কথা বলার স্বাধীনতা)। সোভিয়েত ইউনিয়নের জনসাধারণ গ্লাসনস্তের জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল। তারা মুক্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যেন বিশাল এক বাঁধ ভেঙে গেল। সোভিয়েত সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন এমন প্রাণবন্ত হয়ে উঠল, যেমনটা এর আগে কখনও ঘটেনি। সবাই যখন নির্ভয়ে কথা বলার ও লেখার সুযোগ পেল, তখন যে বিষয়টা প্রকট হয়ে উঠল তা হল, অতীতের সমালোচনা। অতীতের অর্জনের চেয়ে বড় হয়ে উঠল ভুল ও ব্যর্থতাগুলো। ‘র্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটরা’ চূড়ান্তবাদী হয়ে উঠলেন, তাঁরা বলে উঠলেন, ভুল নয়, ব্যর্থতা নয়, সেগুলো ছিল ‘অপরাধ’। স্তালিনকে তাঁরা আখ্যায়িত করতে লাগলেন ‘প্রিস্তুপনিক’ (ক্রিমিনাল) বলে।
সংস্কারের ঠেলায় সোভিয়েত জনগণ পুঁজিবাদী দুনিয়ার খবর পেতে শুরু করল। টেলিভিশনের পর্দায় তারা দেখতে পেল ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ কত ভালো জীবনযাপন করছে। কী চাকচিক্যময় তাদের জীবন। টেলিভিশনে দেখায়, লন্ডনের দোকানগুলোতে ২২ থেকে ৪২ রকমের পাউরুটি বিক্রি হয়। এই সব দেখতে দেখতে সোভিয়েত জনগণ আবিষ্কার করল, তাদের নিজের দেশে দোকানগুলোর তাক ক্রমেই শূন্য হয়ে যাচ্ছে। মাংস, মাখন, পনির কেনার লাইনগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা তাঁদের জনগণকে সব সময় বলে এসেছেন, সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদের চেয়ে ভালো ব্যবস্থা। কিন্তু জনগণ দেখতে পেল, বাস্তবটা উল্টো। এ রকম পরিস্থিতিতে একটা সময় খোদ কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরেই এমন একটা গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিল, যারা গর্বাচভের সংস্কারের ‘ধীরগতি’তে সন্তুষ্ট থাকতে পারল না। এই গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন পলিটব্যুরোর অন্যতম সদস্য বরিস ইয়েলৎসিন।
গর্বাচভের প্রত্যাশা মিথ্যে হয়ে গেল। তিনি দেখলেন গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রোইকার ফলে আমলাতন্ত্রে ও কলকারখানায় ভীষণ বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ছে। ‘কো-অপারেটিভের’ নামে বিরাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের উৎসব, যার নেতৃত্বে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির দুর্নীতিবাজ নেতারা। একসময় জনগণ গর্বাচভের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল। ফলে ১৯৯০ সালের শেষ নাগাদ পেরেস্ত্রোইকা-গ্লাসনস্ত অকার্যকর হয়ে পড়ল। কমিউনিস্ট পার্টি, সেনাবাহিনী, কেজিবি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনেকে গর্বাচভের পাশ থেকে সরে গেলেন। তাঁদের মধ্যে লিগাচভ ও রিঝকভের মতো প্রভাবশালী নেতাও ছিলেন। গর্বাচভের বিরুদ্ধে এই পক্ষের লোকজনের অভিযোগ ছিল, তিনি কমিউনিস্ট পার্টি ধ্বংস করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাধারণতন্ত্রগুলোকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে জনমত গড়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছেন। পূর্ব ইউরোপকে বিসর্জন দিয়েছেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিলোপ ঘটিয়েছেন। সাঝি উমালাতোভা নামে এক নেতা কংগ্রেসের অধিবেশনে বলেন, ‘মিখাইল গর্বাচভ সোভিয়েত ইউনিয়নের ধ্বংস ডেকে আনতে চলেছেন। পশ্চিমী দুনিয়ার হাততালি পেয়ে ভুলে গিয়েছেন, তিনি কাদের প্রেসিডেন্ট।’ প্রকাশ্য ফোরামে বলাবলি চলতে থাকে, গর্বাচভ যদি দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে না আনেন, তাহলে তাঁকে পদচ্যুত করা হবে। ১৯৯১ সালের প্রথম দিকে মস্কোসহ বিভিন্ন শহরে এমন গুঞ্জন শোনা যায় যে, অচিরেই একটা ‘পিরিভারোত’ (অভ্যুত্থান) হতে চলেছে।
অন্যদিকে ইয়েলৎসিনের জনপ্রিয়তা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়ে চলল। লোকজন ভাবতে শুরু করল, এই লোক তাদের ‘ত্রাণকর্তা’। ১৯৯১ সালের জুন মাসে রুশ সাধারণতন্ত্রের ভোটাররা ইয়েলৎসিনকে তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। ইয়েলৎসিন ইতিমধ্যে সমাজতন্ত্রের কথা বলা বন্ধ করেছেন, কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন পার্টির অনেক সদস্য। একটা সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে গণহারে পদত্যাগ শুরু হয়। এর পাশাপাশি প্রচুর সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষক ও অন্যান্য পেশার মানুষ ইয়েলৎসিনের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁরা সবাই অতি দ্রুত সোভিয়েত ব্যবস্থার ‘আমূল পরিবর্তন’ চাইছিলেন, কার্যত রাশিয়াকে পুঁজিবাদে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিলেন।
একদিকে দেশের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার নামে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার দাবি, অন্যদিকে আরও দ্রুত ও ব্যাপক সংস্কারের নামে বাজারব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়ার দাবি— এই দুইমুখী চাপে গর্বাচভ প্রায় দিশেহারা হয়ে গেলেন। তিনি প্রকাশ্যে কট্টর সংস্কারপন্থী নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করলেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে এমন রদবদল আনলেন, যাতে মনে হয়, ক্ষমতা সেই সব লোকের হাতে সংহত করা হল— যাঁরা সংস্কারের বিরোধী। কেউ কেউ বললেন, স্বৈরতান্ত্রিক কট্টরপন্থার দিকে গর্বাচভের ডিগবাজি। তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কমরেডদের একজন— বিদেশমন্ত্রী এদুয়ার্দ শেভার্দনাদজে রেগে গিয়ে পদত্যাগ করে বললেন, ‘স্বৈরতন্ত্র ফিরে আসছে।’ কিন্তু ততদিনে গর্বাচভের সূচিত সংস্কারের রেলগাড়িটা তাঁকে ছেড়ে এগিয়ে গিয়েছে অনেক দূর। সেই গাড়ির চালক তখন বরিস ইয়েলৎসিন।
১৯৯০ সালে রুশ সুপ্রিম সোভিয়েতের চেয়ারম্যান হন বরিস ইয়েলৎসিন। পরের বছর ‘রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক’-এর প্রেসিডেন্ট হন তিনি। কিছুদিনের মধ্যে ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। রুশ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র পরিণত হয় রাশিয়ান ফেডারেশনে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট থেকে যান প্রেসিডেন্টই। প্রশ্ন ওঠে, তবে ইয়েলৎসিনের অবস্থান কী? শাসকের চূড়ামণি!
গুগলে সার্চ করুন রাশিয়ার কোটিপতিদের লিস্ট। বিলিওনিয়ার লিস্টের ৭০ শতাংশ সোভিয়েত আমলের আমলা অথবা কমিউনিস্ট পার্টির উঁচু নেতা। যেমন ধরুন, রাশিয়ার পঞ্চম ধনী ব্যক্তি ভাগিট আলেকপেরভ। উনি সোভিয়েত আমলে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন। এরপরে উনি সোভিয়েতের গ্যাস এবং পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। গেনাডি টিমোশেঙ্কো, সোভিয়েতে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানির ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন। অর্ডার অব ফাদারল্যান্ড পেয়েছিলেন। সুলেমান কেরিমোভ ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন আলতাব সংস্থার। এদের হাতেই পুঁজিবাদের ভার তুলে দিয়েছিলেন বরিস ইয়েলৎসিন, পুঁজি হিসেবে আসে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের অর্থ সাহায্য।
সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে রাষ্ট্রটি বিলুপ্ত হওয়ার আগে ওই দেশ থেকে বিদায় নিয়েছিল সমাজতন্ত্র। কার্যত এটা ঘটেছিল সংবাদমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা। গ্লাসনস্তের সুযোগে সমাজতন্ত্রবিরোধী প্রচার সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণের বৃহত্তর অংশকে ভীষণভাবে বদলে দিয়েছিল। তাই ১৯৯১ সালের আগস্ট মাসে গর্বাচভ ক্রিমিয়ায় অবকাশ যাপনের সময় কমিউনিস্ট পার্টির কট্টর নেতারা যখন তাঁকে ‘অসুস্থ ও দেশ চালাতে অক্ষম’ ঘোষণা করে অভ্যুত্থান ঘটাতে গেলেন, তখন জনগণ তার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এল। অভ্যুত্থানকারীদের সমর্থন জানাতে তাঁদের পক্ষের কেউ রাস্তায় নামেনি। আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন চেয়েছিল, মাঝামাঝি সংস্কারমূলক পদক্ষেপে তারা আর তুষ্ট থাকতে পারছিল না। ১৯১৭ সালেও তারা কেরেনস্কির বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে সন্তুষ্ট হতে পারেনি, বৈপ্লবিক পরিবর্তন চেয়েছিল। বলশেভিকদের অক্টোবর বিপ্লব ঘটেছিল সেই কারণেই। উভয় ঘটনায় জয় হয়েছে জনগণের চূড়ান্তবাদী প্রবণতার।
বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে এমন এক সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার মতন ঘটনা মানুষের ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। কিন্তু সেই ইতিহাসে ১৯৯১ সালে গৃহীত একখানা আস্ত গণভোটের কথা কোথায়? যেখানে পশ্চিমী মতেই মুক্ত ও অবাধ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন বজায় রাখার স্বপক্ষে ভোট দান করেছিলেন ৭৭.৮৫ শতাংশ মানুষ? যে জনমত অগ্রাহ্য করে সোভিয়েত ইউনিয়নকে জনতার নামে বিখণ্ডিত করেছিল ইয়েলৎসিনরা? কোথায় সোভিয়েতের পতনের পর অলিগার্কদের (ধনী) উত্থান, গলা-কাটা পুঁজিবাদ ও মাফিয়ারাজের সূচনার গল্প? কোথায় ১৯৯৩-এর ভোটে ‘কমিউনিস্টদের মুক্ত নির্বাচন’-এ বিপুল জয় ও তারপরে ট্যাঙ্ক নামিয়ে মার্কিন সহায়তায় ‘গণতন্ত্রের রক্ষক’ ‘রাশিয়ার মুক্তিদাতা’ ইয়েলৎসিনের ক্ষমতা ধরে রাখার কাহিনি? ইতিহাসের সেই অধ্যায় আলোচিত হয় না। ১৯৯১ পরবর্তী নব্য-উদারনীতির শক্তি সারা বিশ্বজুড়ে একটি শক্তপোক্ত জালে জড়ানো ভাষ্য রচনা করেছে। সেই ভাষ্যের স্বপক্ষে যা কিছু, তা ‘অথেন্টিক’ বলে গণ্য হয়েছে। আর সেই ভাষ্যের বিপক্ষে যা কিছু তাই ‘প্রোপাগান্ডা’ বলে গৃহীত হয়েছে। আমাদের দেশেও সোভিয়েতের পতনকে ঘিরে যারা উল্লাস করেন, তাঁদের যাবতীয় গল্পের ইতি ’৯১-এ।
বিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছিল রাশিয়াসহ পনেরোটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বেশির ভাগ নতুন দেশের শাসক হন সোভিয়েত আমলের নেতারাই। যেমন হাসান হাসানভ। ১৯৯০ সালে আজারবাইজান সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। বছর দেড়েক বাদে তৈরি হয় স্বাধীন আজারবাইজান সাধারণতন্ত্র। নতুন দেশে নতুন দলকে নিয়ে নতুন সরকার তৈরি করেন পুরনো হাসানভই! যেমন ইসলম কারিমভ। ১৯৯০ সালে উজবেক সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন তিনি। এর পর সমাজতন্ত্র ছেঁটে ফেলে তৈরি হয়েছে রিপাবলিক অব উজবেকিস্তান। কিন্তু কারিমভ পদে ছিলেন ২০১৬ সালে মৃত্যু পর্যন্ত। যেমন, আনাতোলিস গর্বুনভ্স। সোভিয়েত আমলে লাটভিয়ার সুপ্রিম সোভিয়েতের এই চেয়ারম্যান স্বাধীনতার পরেও হলেন সুপ্রিম কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। এককালে যাঁরা ছিলেন সর্বহারার নেতা, তাঁরাই ‘বাজারি’ রাষ্ট্রের প্রধান হন কী করে? আসলে ক্ষমতাই শেষ কথা।
একই অবস্থা বাংলার বামপন্থীদের। টানা ৩৪ বছরের বাম শাসনে ক্ষমতার মোহ, ঔদ্ধত্যের ব্যাধিতে ছিল পতনের সুর। পার্টি এক সময় বশ্যতা আর দক্ষতার তফাৎ করতে ভুলে গিয়েছিল। প্রয়াত অশোক মিত্রের কথায়: তাঁরা তো ধরে নিয়েছিলেন, ‘চিরকাল পশ্চিমবঙ্গে শাসন করে যাব।’ সোজা কথা, সাফল্যে তাঁদের মাথা ঘুরে গিয়েছিল এবং সেটাই মারাত্মক হয়ে দাঁড়াল। আটের দশকের মাঝামাঝি থেকেই দেখা যাচ্ছিল পার্টির মধ্যে নেতারা কেউ কেউ একটু অহঙ্কারে ভুগছেন, চাটুকারদের দ্বারা পরিবৃত হচ্ছেন, চাটুকাররা বাছা বাছা ক্ষমতার জায়গায় পৌঁছচ্ছেন, তাঁরা আবার তাঁদের চাটুকার তৈরি করছেন। এই ভাবে বৃত্তের মধ্যে বৃত্ত তৈরি হল, পুরো দলটায় ঘুণ ধরল। পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন স্তর নিছক বাঙালি জমিদারিতে পরিণত হয়েছিল। ফলে ঠিক যে ভাবে ঝোড়ো হাওয়ার মতো একদিন লেনিনের পার্টি ভেঙে পড়ল তাসের ঘরের মতো এবং ভেঙে পড়ার পর দেখা গেল, গোটা দেশের আমজনতা ওই ব্যবস্থাটা সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল। বাংলার বাম শাসনের পতনেও ছিল একই চিত্র।
একসময় সোভিয়েতে যে কমিউনিস্টরা নেতার আসন অলঙ্কৃত করতেন, তাঁরা আদৌ কমিউনিস্ট নন। তাঁরা ছিলেন শাসক। আর তাই নিজের বাসস্থান হিসেবে জারদের ক্রেমলিন প্রাসাদকেই বেছে নিয়েছিলেন লেনিন। পরে জার আমলের প্রাসাদচূড়ার সোনার ঈগল সরিয়ে উজ্জ্বল তারা বসিয়েছিলেন জোসেফ স্তালিন। জারদের প্রাসাদ ক্রেমলিনই নাকি ছিল সমাজতন্ত্রের ভরসাস্থল। ইতিহাস মানবে কেন?
১৯৯১ সালে মস্কোর সময় ২৫ ডিসেম্বর সন্ধে ৭টা ৩২ মিনিটে ক্রেমলিন ছাড়েন মিখাইল গর্বাচভ। প্রাসাদশীর্ষ থেকে নামানো হয় কাস্তে-হাতুড়ি মার্কা লাল পতাকা। ওড়ে জারের আমলের সেই ত্রিবর্ণ ঝান্ডা। আজ কাস্তে-হাতুড়ি চিহ্ন আর ‘সিসিসিপি’ লেখাও সরে বসেছে সেই জোড়া মুখো ঈগল। কী বলবেন একে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস