হঠাৎ পাওয়া যোগাযোগের মাধ্যমে কর্ম জটিলতার অবসান ও মানসিক চিন্তামুক্তি। আয় ব্যয়ের ক্ষেত্র ঠিক থাকবে ... বিশদ
একুশের ভোটে দু’পক্ষই ভেবেছিল, তৃণমূলকে যা খুশি বলে দেগে দিলেই বুঝি পালাবদল নিশ্চিত। চ্যানেলে চ্যানেলে সান্ধ্য টক-শোতে গলার শির ফুলিয়ে ভাষণ দাও। জানা বিশেষণের ভাণ্ডার দাও উজাড় করে। দল ভাঙো। টাকা ছড়াও। কিন্তু এত কিছুতেই কাজ না-হওয়ায় এখন হতাশা দানা বাঁধছে। যাঁরা তোপ দাগছেন এবং যে ব্যানারের তলায় দাঁড়িয়ে আক্রমণ শানাচ্ছেন, দু’য়েরই বিশ্বাসযোগ্যতা এই বঙ্গে তলানিতে। তাঁরা নিজেরাও অভিজ্ঞতা থেকে বেশ বুঝতে পারছেন, স্টুডিওর কৃত্রিম যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশের বাইরে বেরলেই সব ইস্যু ফিকে, ধূসর! নিয়োগ দুর্নীতি থেকে সন্দেশখালি পেরিয়ে আর জি কর, সব ফ্লপ! এই রাজ্যের দুই প্রধান বিরোধী দলের গ্রহণযোগ্যতা শূন্যে উড়ে বেড়ানো দিশাহীন বেলুনের মতো! যতই লোপ্পা ক্যাচ উঠুক, ধরার মতো ফিল্ডার নেই।
সিপিএমের সম্মেলন আছে, দু’শো গালভরা কমিটির বাহার আছে, গঠনতন্ত্র আছে কিন্তু এগারোর পর শুরু হওয়া রক্তক্ষরণ থামানোর দাওয়াই নেই। উল্টে বিজেপি-তৃণমূল বাইনারি বামেদের ভিটেমাটি ছাড়া করেছে। দলের রিপোর্টই বলছে, ২৫ হাজার সদস্য কমেছে। যাঁরা আছেন, তাঁরাও কি সবাই সক্রিয়? বুথে বুথে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতা ধরেন? তাই একটা রাজ্য সম্মেলন কিংবা পার্টি কংগ্রেস দলের এই করুণ অবস্থা থেকে মুক্তির পথ বাতলাতে পারবে না। ৩৪ বছরের গর্বের অতীত ফেরাতে আরও ৬৮ বছরের ত্যাগ ও সংগ্রাম লাগবে, কমরেডরা প্রস্তুত তো?
পাশাপাশি উনিশ সালের লোকসভা কিংবা একুশের বিধানসভা ভোটের আগের তুলনায় বঙ্গে বিজেপির অবস্থাও আজ শোচনীয়। জেলায় জেলায় তৃণমূল ভেঙে গেরুয়াকে উজ্জীবিত করার পাঁচ বছর আগের ফর্মুলা ভোঁতা। এজেন্সি দিয়ে জেলে পোরার হুমকিতে আর কাজ হওয়ার নয়। ব্রহ্মাস্ত্র একবারই প্রয়োগ করা যায়। স্টেরয়েড রোজ দিতে নেই, কাজ হয় না। আসলে বিজেপি এ রাজ্যে সব তাস খেলে ফেলেছে। ছাব্বিশে আর এক দফা মহা সংগ্রামের আগে তাই নতুন আর কোনও চমক হাতে নেই। সবাই জানে আবার মোদি, অমিত শাহের ডেলি প্যাসেঞ্জারি শুরু হবে। হাওয়াই জাহাজের চক্কর সকাল থেকেই কাঁপাবে রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ। দু’লক্ষ কোটি টাকা বকেয়া রেখে এই নাটকে বাংলা ও বাঙালির লাভ?
বরং তৃণমূলকে বুঝে নেওয়ার চেয়ে ঝগড়া থামানোই বঙ্গ বিজেপির পাখির চোখ। নির্বাচনের পর নির্বাচনে নেতৃত্বের চূড়ান্ত ব্যর্থতা সত্ত্বেও নানা গোষ্ঠী আর উপ দলের স্রোতে আজ বঙ্গ বিজেপির ‘ত্রাহি মধুসূদন’ অবস্থা। পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর যে নতুন রাজ্য সভাপতির নাম ঘোষণা করতে পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে দিল্লির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব। কারণ, সভাপতির নাম ঘোষণামাত্রই আড়াআড়ি ভাগ আরও প্রকট হবে। কোন কূল রাখবেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব? চব্বিশের লোকসভা ভোটের আগে ও পরে দু’টি ইস্যু নিঃসন্দেহে গোটা দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সন্দেশখালি ও আর জি কর, ডান-বাম নির্বিশেষে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মরা গাঙে কোহিনুরের সন্ধানে। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এমন যেন নির্বাচন ছাড়াই বাংলায় সরকার বদলে যাবে। কিন্তু টানা সাতমাস পরও কই নুড়ি পাথরও তো উঠল না! এই বাংলা মমতার ছিল, আছে এবং থাকবে। আপাতত ছাব্বিশের একবছর আগে এটাই প্রতিষ্ঠিত সত্য। কথা ছিল, পৌষ সংক্রান্তি কাটলেই একটা তাজা গেরুয়া ব্যক্তিত্বকে সভাপতি হিসেবে পাবে বাংলা। সংক্রান্তি কাটল। বলা হল, দিল্লি নিয়ে অমিত শাহরা বড্ড ব্যস্ত। সবুর করুন। তা ভোট পেরিয়ে দিল্লিরও সরকার গড়া শেষ। এখনও বিজেপির প্রতিষ্ঠিত নিয়ম ভেঙে এ রাজ্যে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীই সংগঠনের শীর্ষে। বিজেপি জানে, এ রাজ্যে তাঁদের যাবতীয় অস্ত্র একুশে এবং চব্বিশেই ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। আর দু’মাস বাদে যখন দীঘার জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধন তখন মমতা ‘হিন্দু নন’, এ রাজ্যে ‘মোল্লার সরকার’ চলছে—এক ফ্লপ দলবদলু নেতার এহেন আস্ফালন হালে পানি পাবে বলে মনে হয়? এসব সস্তা বাকোয়াস ধোপে টিকবে কি? নাকি বাঙালির মন অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ভুলে শুধু বিদ্বেষ আর বিভাজনে সায় দেবে। বিজেপি দিল্লি জয়ের পরে যতই বাংলাকে পাখির চোখ করুক, রেকর্ড দশ এগারো দিন আরএসএস প্রধান বাংলায় থেকে ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করে দিয়ে যান—উন্নয়ন নয়, বাংলার সাংস্কৃতিক প্রগতি নয়, একমাত্র ধর্মীয় বিভাজন এবং তাকে উস্কানি দিয়ে একটা বিষাক্ত সমাজ তৈরিতে ইন্ধন দেওয়া ছাড়া এ রাজ্যে বিজেপির আর কোনও কর্মসূচি দেখা যাচ্ছে না। তাই পড়শি বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনে তাদের চোখ চকচক করে ওঠে। কারণ, ওতে মেরুকরণ আর এক প্রস্থ ধারালো হবে। কিন্তু খড়কুটো আঁকড়ে ধরে কোনওরকমে ভেসে থাকা যায়, জেতা যায় না!
কী অবস্থা ‘শূন্য’ সিপিএমের? গত কয়েকমাস ধরে জেলায় জেলায় সম্মেলন পর্বে অস্তিত্ব হারানো একটা দল শুধু নিজেদের মধ্যে ঝগড়া আর একে অপরের বিরুদ্ধে ফন্দিফিকির এঁটেই গেল। এই গণ্ডগোল সামাল দিতে না পেরে পূর্ব মেদিনীপুর, মালদহ এবং কোচবিহার জেলায় দলের গঠনতন্ত্র অমান্য করে পুরনো পক্বকেশ নেতাকেই সম্পাদক পদে রেখে দেওয়া হয়েছে। তবে অনেক অঙ্ক কষেও ওই ফর্মুলা কাজ করেনি উত্তর ২৪ পরগনায়। অসুস্থ জেলা সম্পাদককে সরিয়ে নয়া নেতৃত্বকে মেনে নিতে কার্যত বাধ্য করা হয়েছে আলিমুদ্দিনের কর্তাদের। নতুন বছরে সিপিএমের মধ্যেকার গণ্ডগোল কতটা ভয়ঙ্কর তার প্রমাণ উপ নির্বাচনে বরানগরের পরাজিত প্রার্থী তন্ময় ভট্টাচার্যকে এক মহিলাকে নির্যাতনের অভিযোগে দল থেকে সাসপেন্ড করা। যে অভিযোগে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিস গ্রেপ্তার না করে ছেড়ে দেয়, সেই অভিযোগে দলের একজন নেতাকে সম্মেলন পর্বে বসিয়ে দেওয়া কোন পবিত্র গঠনতন্ত্রের কুফল? বিশেষ করে দলের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে ইন্ধন জুগিয়েছে কারা? তন্ময়বাবুর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছে কে? দল না বিরোধীরা? সেলিম বিমান সূর্যকান্তের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ উঠলে পার্টি তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেবে তো? দক্ষিণ ২৪ পরগনায় জেলা কমিটি গঠিত হওয়ার পরদিন একে একে পদত্যাগ প্রমাণ করে শূন্যের অপমান ঘোচানো নয়, অন্তর্দলীয় কূটকচালির মধ্যে দিয়ে ইতিহাস থেকে মুছে যাওয়াই সিপিএমের ভবিতব্য। সেই কারণেই চুরাশি পেরনো বিমান বসুকেও রাজ্য সম্মেলনের আগে বিবৃতি জারি করতে হয়। যদিও তা শোনার লোক পার্টিতে আর বড় একটা আছে বলে মনে হয় না। যখন ভোট রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার তুলনায় শূন্য হয়ে যাওয়া দলের
সংগঠনে নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার বাসনা উদগ্র রূপ নেয়, তখন বুঝতে হবে সেই দলের স্বখাত-সলিলে ডুবে মরা ছাড়া আর কোনও গতি নেই। কারণ, নেতৃত্ব জানে, তৃণমূল-বিজেপি বাইনারি এখনই ভাঙবে না। আর ৩৪ বছরে সিপিএম
নামটা এত ক্লিশে এবং কলঙ্কিত হয়ে গিয়েছে যে যতই মধু ঢালুন, ন্যায়-বিবেকের কথা বলুন না কেন, ভোটে ৩ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশের বেশি সমর্থন মিলবে না। পড়ে রইল তরুণ প্রজন্ম। মীনাক্ষী, দীপ্সিতা, সৃজন ও ‘কীর্তন’ সম্প্রদায়। তাঁরা কেউই তো রাজনীতিতে নতুন নন। এ পর্যন্ত ভোটে দাঁড়িয়ে এই উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা নিজেদের জামানতটুকুও কি বাঁচাতে পেরেছেন? এভাবে শুরুতেই কঠিন পিচে হারার জন্য খেলতে নামিয়ে মীনাক্ষীদের রাজনৈতিকভাবে শেষ করে দেওয়ার দায় এড়াতে পারে না রাজ্য নেতৃত্ব।
আসলে আসন্ন নির্বাচনে সিপিএম, বিজেপি কেউ ক্ষমতা দখলের জন্য লড়াই করছে না। সিপিএম লড়ছে শূন্যের গ্লানি মোচনের লক্ষ্যে। যদিও তাও খুব সহজ হবে না। আর বিজেপি লড়ছে, গতবারের ৭৭টি আসনের অন্তত অর্ধেক আসনে মানরক্ষার টার্গেট হাতে নিয়ে। যদি না মহারাষ্ট্র কিংবা দিল্লির মতো ভোটার তালিকায় ব্যাপক কারচুপির আশ্রয় রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল নিতে না পারে তাহলে এখনই বলে দেওয়া যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুর্থবার মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথগ্রহণ শুধু বছর ঘোরার অপেক্ষা। পাঁচবছর আগের চেয়েও একপেশে ভোট দেখবে এবার বাংলা। সিপিএম শূন্য থেকে এক, বিজেপি ৩০ থেকে ৪০...। আড়াইশোর আশপাশে তৃণমূল।